ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

বাজেট এবং খাদ্য নিরাপত্তা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:২৫, ১৫ জুন ২০২৪

বাজেট এবং খাদ্য নিরাপত্তা

.

বিগত জুন তারিখে মহান জাতীয় সংসদে (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে  সবচেয়ে বড় বাজেট পেশ করেন বর্তমান সরকারের  অর্থমন্ত্রী যাকে বলা হয়সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার এটি হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট, দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, সেই লক্ষ্য পূরণকে সর্বাগ্রে জোর দেওয়া হয়েছে আগামী বাজেটে। যার মধ্যে কৃষি বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। কৃষি খাতের অবদান তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘দানাদার শস্যের মোট উৎপাদন কোটি ৮০ লাখ টন থেকে প্রায় চার গুণ বেড়ে কোটি ৯২ লাখ ১৬ হাজার টন হয়েছে। মোট মৎস্য উৎপাদন ২১ দশমিক ৩০ লাখ টন থেকে আড়াই গুণ বেড়ে হয়েছে ৫৩ দশমিক ১৪ লাখ টন। আর গবাদিপশুর সংখ্যা কোটি ২৩ লাখ হাজার থেকে প্রায় দুই গুণ বেড়ে কোটি ৯৮ লাখ ৭৮ হাজার, পোলট্রির সংখ্যা ১৮ কোটি লাখ ২২ হাজার থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৫২ কোটি ৭৯ লাখ ১৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

নতুন অর্থবছরের বাজেটে কৃষি, মৎস্য প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা মোট বাজেটের দশমিক শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মন্ত্রণালয়ে বাজেট বেড়েছে মাত্র হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। শতাংশের হিসাবে মোট বাজেটের মাত্র দশমিক ৬৩ শতাংশ। অথচ মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ। এদিকে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হলেও বরাদ্দ কমেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে ২৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরে খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৩৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। সে হিসেবে মন্ত্রণালয়টির বরাদ্দ কমেছে হাজার কোটি টাকার বেশি। মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ছে। খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ রয়েছে হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। এদিকে কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার খাত বিবেচনা করে কাজু বাদামে আমদানি শুল্ক ১৫ থেকে হ্রাস করে শতাংশ এসেপটিক প্যাক আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫ থেকে হ্রাস করে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন, সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদন দ্বিগুণ করার কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মৎস্য প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন, খামারি জেলেদের সহায়তা এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত বাজেটে হাজার ২৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

কৃষি বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কৃষি অর্থনীতিবিদ . জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি খাতে অনেক বেশি বরাদ্দ দেওয়ার দরকার ছিল। সেটি দেওয়া হয়নি। গত বছরের চেয়ে এবার সব কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে। কৃষকের জন্য যে পরিমাণ ভর্তুকি আশা করেছিলাম, সে পরিমাণ বাড়ানো হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, দেশের কৃষকের সামনে চ্যালেঞ্জ ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো এবং তার ন্যায্যমূল্য পাওয়া। কৃষকের জীবন এখন পর্যন্ত ঋণের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত নয়। সরকার মনে করতে পারে সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধার জোগান সরকার দিচ্ছে, তাই কৃষকের ওপর আগের মতো আর খরচের চাপ পড়ে না। আমরা মনে করি, ধারণার ভুলগুলো চিহ্নিত এবং তা খতিয়ে দেখার এখনই সময়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি গ্রামীণ জীবন জীবিকার  প্রধান বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং পল্লী উন্নয়নের কথায় আসলেই কৃষি সবার আগে চলে আসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে কৃষিকে আধুনিক লাভজনক করতে নিরলস কাজ করছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে অঞ্চলভেদে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষিযন্ত্র দেওয়া হচ্ছেতথা প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিতে নতুন অধ্যায় সূচিত হলো।

এর মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে সময় শ্রম খরচ কমবে। কৃষক হবে লাভবান। কৃষিযন্ত্রের প্রাপ্তি, ক্রয়, ব্যবহার মেরামত সহজতর করতে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা পর্যায়ক্রমে স্থানীয়ভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি করতে চাই। বর্তমানে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তা আমরা কমিয়ে আনতে চাই। ইতোমধ্যে আমরা ইয়ানমার, টাটাসহ অনেক কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অনুরোধ করেছি যাতে তারা বাংলাদেশে কৃষিযন্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে ফসলের নিবিড়তা বাড়ছে চাষ ত্বরান্বিত হচ্ছে। দেশের বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থার আধুনিক তথা যান্ত্রিকীকরণের জন্য বাজেটে বাড়তি টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। বলা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি আরও এক ধাপ অগ্রগতি। সে ক্ষেত্রে শুধু নগরায়ণ শিল্পায়ন করলেই চলবে না, বরং প্রচলিত ধারার আবহমান কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নও একান্তভাবে কাম্য কাক্সিক্ষত। বর্তমানে শহর-নগর-বন্দরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষি জমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেনগ্রামকে নগরায়ণ করা হবে গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি সৌন্দর্য অক্ষুণœ  রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে গ্রামেও। তাই বলে কেবল উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন জীবিকা অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তবে বর্তমানে কৃষিকাজে উৎসাহী তথা কৃষিশ্রমিক পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। গত দুই বছর ধরে হাওড় অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা।

অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে এক মণ ধানের দাম বড় জোর ৮৫০-৯০০ টাকা। ইতোমধ্যে ধানের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে বিধায় ধান বীজ, চারা রোপণসহ সার কীটনাশক ছিটানো, নিড়ানি, সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াইসহ শুকানো, এমনকি সরাসরি সাইলোতে পাঠানো- সবই করা সহজে সম্ভব আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিতে প্রতিবছর কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে - হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বিবিধ প্রণোদনা খাতে। এখন থেকে বাকি তিন হাজার টাকা ব্যয় করা হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজে। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক, এই কাজটি শুরু হয়েছে  কয়েক বছর আগে থেকেই। তবে এর সার্বিক সুফল পেতে হলে টুকরো টুকরো জমির একত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। সমবায় প্রথা এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাও জরুরি। এর পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা।

কৃষি খাতের আগামী বছরের বাজেট পর্যালেচনায়  দেখা যায়মুরগি, মাছ গবাদিপশুর খাবার তৈরির উপকরণ আমদানিতে কাঁচামালে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, নিড়ানি, ঝাড়াই কল, কম্বাইন হারভেস্ট, থ্রেসার, রিপার, পাওয়ার টিলার, সিডার ইত্যাদি কৃষিযন্ত্রে কর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা সামগ্রিক কৃষির জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। কৃষি খাতের এই বজেটকে সাধুবাদ জানাতে চাই। কৃষি পল্লী উন্নয়ন খাত মিলিয়ে বর্তমান অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার শত ৮৫ কোটি টাকা। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়  ঘটানোর পাশাপাশি তাকে প্রকৃতিবান্ধবও করে তুুলতে হবে। বাজেট  বাস্তবায়ন শতভাগ হলে  দেশের কৃষি অর্থনীতি হবে চাঙ্গা।

 

×