ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আর্থিক খাতের সংস্কার না করলে কমবে প্রবৃদ্ধি

প্রকাশিত: ২২:০৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

আর্থিক খাতের সংস্কার না করলে কমবে প্রবৃদ্ধি

প্রবৃদ্ধি

মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে আর্থিক খাতের জোরালো সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, তবে তা না করলে ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধি আরো কমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়। 

একইসঙ্গে যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রসারের মাধ্যমে নতুন নতুন শহর তৈরির তাগিদ সংস্থাটির। রফতানি খাতে গার্মেন্টস নির্ভরতা কমিয়ে নতুন চালক তৈরির প্রতি জোর দিয়েছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি।
মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত বছরে ৭.৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি দরকার হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে হলে ১০ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে। এর জন্য দ্রুত উৎপাদন প্রবৃদ্ধি দরকার হবে। যা নগরায়ন ও যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে করা যাবে। 

আরো বেশি নারীর ক্ষমতায়ন দরকার হবে। যার জন্য নতুন নতুন রফতানি পণ্যের বাজার তৈরি করতে হবে। আর এসব বাস্তবায়নে আরো বেশি বিনিয়োগ দরকার। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশ ও জলবায়ুর বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

সংস্থাটির এক রিপোর্টে বলা হয় সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া না হলে গতানুগতিক গতিতে ২০৪১ সালে প্রবৃদ্ধি কমে ৫ শতাংশে দাঁড়াবে। আর মোটামোটি মানের সংস্কার করলে তা ৫.৯ শতাংশ হবে। তবে, জোরালো সংস্কার করলে ২০৪১ সালে দেশের প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ দশমিক ৫ হবে বলে ধারণা  করছে বিশ্বব্যাংক।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে দেশের অর্থনীতি নিয়ে ‘কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম-চেঞ্জ অব ফেব্রিক’-শীর্ষক এক রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। 

দেশে খেলাপী ঋণ বেড়ে যাওয়া বিষয়টি উল্লেখ করে ব্যাংকখাত সংস্কারেও পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর কথা বলা হয়। অন্যদিকে কর ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন না করলে সরকারের ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়বে না। 

তাই সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলাপ করে তা সংস্কার করার কথা বলা হয়। প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের কর হার এখনো অনেক বেশি। তাই তা যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস না করলে রফতানি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাাওয়া আশঙ্কা করা হয়।

২০২৬ সালে নিন্ম আয়ের দেশে থেকে উত্তোরণ হলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও চীনে আরো কর দিতে হবে। তখন এসব দেশে ১২টি পণ্যের ২২ শতাংশ রফতানি কমতে পারে। তাই বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। প্রাইভেট সেক্টরে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে তা মাথাপিছু আয়ে প্রায় ৪ শতাংশ অবদান রাখে বলেও জানানো হয়।

রিপোর্টে ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে হলে তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়। এরমধ্যে রয়েছে-বাণিজ্য সক্ষমতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করা এবং পর্যায়ক্রমে নগরায়ন গড়ে তোলা। একইসাথে প্রযুক্তির বিকাশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি নজর দিতে বলা হয়। প্রবৃদ্ধিও গতি বাড়াতে ঢাকার উপর চাপ কমিয়ে নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো শহর গড়ে তোলার কথা বলা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টও দানদান চেন বলেন, গত পাঁচ দশক যাবৎ বাংলাদেশ সেরা ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। তবে প্রসারিত অর্থনীতির জন্য সামনে নতুন পলিসি ও প্রাতিষ্ঠানিক নতুনত্ব দরকার। ২০৩১ সালে  উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে জোরালো ও স্বচ্ছ নীতিসহায়তা দরকার হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
  
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকাশিত রিপোর্টের উপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন সংস্থাটির জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ নোরা দিহেল এবং প্রধান অর্থনৈতিক পরামর্শক জাহিদ হোসেন। উপস্থাপনায় জাহিদ হাসান বলেন, পাশ্ববর্তী ৬টি দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি উর্ধ্বমূখী। তবে এখানে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন কৃষি থেকে শিল্প ও সেবায় বেশি শ্রম চলে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির গতির ক্ষেত্রে নীতি সহায়তার চেয়ে চলমান গতির প্রভাব বেশি। 

রিপোর্ট উপস্থাপনায় নোরা দিহেল প্রযুক্ত নির্ভর ও যোগাযোগ সমৃদ্ধ নুতন নতুন শহর তৈরির কথা বলেন। বাংলাদেশে দ্রত নগরায়ন হচ্ছে। যার হার ৩৮ শতাংশ। ২০৫০ সালে তা ৬০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। ফলে শহরের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফলে ঢাকায় নতুন করে আরো ৫ কোটি মানুষের আগমন ঘটতে পারে। তাই ঢাকার বাইরে নতুন শহর গড়ে তোলার কথা বলা হয়।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমন মান্নান বলেন, বছরের পর বছর আমরা বিশ্বব্যাংকের জ্ঞান, সহায়তা ও মূল্যায়ন কাজে লাগাচ্ছি। তবে এখানে অনেক বিষয় অলোচনা করা হয়েছে যা আমাদের কাছে নতুন না। অবকাঠামো, যোগাযোগ ও নগরায়ন নিয়ে গত ২ দশক ধরে অনেক কাজ হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী। এসময় ব্যাংকিং খাতের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে সংস্কার প্রয়োজন বলে একমত পোষন করেন তিনি। 

ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি তথ্যের সঙ্গে পাল্টা পরিসংখ্যান দিয়ে মন্ত্রী বলেন এ শতাব্দির শেষে দেশের জনসংখ্যা ৮ কোটি নেমে আসবে বলা হচ্ছে। আর গ্রাম হবে শহর-এমন লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। আর প্রবৃদ্বির উচ্চধারা বহাল রাখতে আর্থিক খাতের সর্বোচ্চ সংস্কার করা হবে বলেও জানান তিনি।

রাজনৈতিক সংঘাত নয় তবে অনিশ্চয়তা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে রাজনীতির কালো মেঘ থেকে ঝড় আসবে না বলে আশা করেন তিনি। লাঠিসোটা নিয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো যাবে না বলে বিশ্বমানের আচরণের দিকে আসতে বলেন মন্ত্রী।  আলোচনা-সভ্যতার পথে আসতে বলেন তিনি।

সভায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, সংস্কার পদক্ষেপগুলো সরকারও বলছে তবে কার্যকর হচ্ছে কিনা সেটাই প্রশ্ন। কয়েক দশক ধরে পোশাক খাতে সুবিধা দেওয়া হলেও অন্যখাতে  একই সুবিধা না দেওয়ায় একক নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। ছোট ব্যবসায়ে ঋণ না দিলে মধ্যম আয়ের দেশ সম্ভব না বলেও মনে করেন তিনি। কর ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে অনেক আলাপ হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না জানান এ অর্থনীতিবিদ। 

অন্য প্যানেল আলোচক  সোনিয়া বশির কবির বলেন, নতুন নতুন আবিষ্কার দরকার। তথ্যই নতুন কারেন্সি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। কালিয়াকৈর পরবর্তী ঢাকা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. জাহেদী সাত্তার বলেন, পোশাকে ভর্তুকি দেওয়া হলেও আমদানি বিকল্প শিল্প গড়তে তা দেওয়া হচ্ছে না। এটাকে তিনি পদ্ধতিগত ভুল বলে আখ্যা দেন।

প্রশ্ন-উত্তরপর্বে ডলার ছাড়া অন্য মূদ্রায় বাণিজ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাবনা জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে জাহিদ হাসান বলেন, ডলারে রফতানি ও আয় হয় আমাদের। তবে আমদানি বেশি ভারত ও চীন থেকে। কিন্তু এসব দেশে রফতানি কম হওয়ায় এটা সুবিধা হবে না। টাকাতে করা গেলে করা যেত। 

কিন্তু টাকাতে যেহেতু সম্ভব নয় তাই এটার মাধ্যমে সাময়িক সুবিধার জন্য নতুন সমস্যার তৈরি হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সোয়াপ লাভজনক হবে না বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনা মন্ত্রীও। এটা ব্যবসাকে দুই কারেন্সিতে সীমাবদ্ধ করবে বলেও মনে করেন সরকারের এ নীতি নির্ধারক। 

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক তার পার্টনার দেশগুলোকে নিয়ে নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। তারই অংশ হিসেবে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। 
 

এমএস

×