ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যবিত্তের ভাবনা ও মূল্যস্ফীতি

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশিত: ০০:২৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

মধ্যবিত্তের ভাবনা ও মূল্যস্ফীতি

.

আমাদের সমাজে বর্তমানে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনায় প্রধানত তিন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। আবার মধ্যবিত্তের মধ্যে যাদের একটু অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ তাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত বলা হয়। অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ, মাসিক বেতনের ভিত্তিতে কাজ করে, যাদের বেতনের বাইরে বাড়তি আয় নেই, উচ্চবিত্ত বাদ দিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপর যাদের বসবাস, তারাই মূলত মধ্যবিত্ত। তবে আমাদের সমাজে বসবাসরত এই তিন শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা ও অবজ্ঞার যে শ্রেণীটি তা হলো মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তদের আর্তনাদ একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কখনও লোকলজ্জার ভয়ে বা কখনও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে কারও কাছে হাত পেতে কিছু নিতে পারে না। সমাজের এই শ্রেণীটিকে সর্বদাই সংগ্রাম করে জীবনযাপন করতে হয়। বর্তমান বাস্তবতায় অনেকেই বলেছেন, একদম নিম্নবিত্তের চেয়েও বেশি হিসাব-নিকাশ করে চলতে হয় এই শ্রেণীকেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে মাথা পিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। এ খাদ্যের বেশিরভাগই চাল। তারা আরও বলেছেন, দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও তাদের ঘাড়ে চাপে বেশি। তাহলে আরও যে মৌলিক প্রয়োজন রয়েছে, যেমন বাসাভাড়া দেয়া, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ বহন করা, বস্ত্র ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ কোত্থেকে আসবে? আমাদের দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে নতুন করে দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমনটি প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে না পারলে দরিদ্র মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। করোনা পরিস্থিতির পর আমরা যখন অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম, ঠিক এমন সময় দেশে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য যে হারে বেড়ে চলেছে, তা সত্যিই পীড়াদায়ক।
বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরপরই মহামারী শুরু হয়েছে। গত দুই বছরে অন্যসব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলে ভালভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল এ দেশ। কিন্তু মহামারীর মতোই কোন পূর্বাভাস না দিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলো। তাতে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হল বিশ্ব বাণিজ্যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি প্রবাহ নড়ে উঠেছে উপর্যুপরি দুই ঝড়ে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। মূল্যস্ফীতির হার পৌঁছেছে দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচন্ড চাপ বাড়ছে।

এরইমধ্যে ডলারের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্য চাহিদা মেটাতে পণ্য আমদানি এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।যুদ্ধের জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পণ্যমূল্য বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। ক্রমশ বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি খেয়ে ফেলছে অর্থনীতির স্বাস্থ্য। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ হারে, যা ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের বাজারে সবচেয়ে জরুরী খাদ্যপণ্য চালের দাম এক মাসের ব্যাবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত।
অস্থিরতা আছে অন্যান্য পণ্যের দামেও। এসব ক্ষেত্রে অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি মধ্যবিত্তদের নিদারুণ কষ্টে জীবন কাটাতে হয়। তবে অর্থনীতিবিদরা আশা প্রকাশ করেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সঠিকভাবে হলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভালর দিকেই যাবে।

 

×