
ছবি: সংগৃহীত।
বিশ্বের অন্যতম সুসংগঠিত ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। আর সেই স্টকহোম মেট্রোই এখন পরিচিত বিশ্বের দীর্ঘতম আর্ট গ্যালারি হিসেবে। ৭০ বছর আগে শহরের সিটি কাউন্সিল গণপরিবহনে শিল্প সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে এই মেট্রো আজ যেন এক বিস্তৃত আর্ট ইনস্টলেশন মিউজিয়ামে রূপ নিয়েছে।
স্টকহোম শহরের মেট্রো নেটওয়ার্কজুড়ে প্রায় ১১০ কিমি দৈর্ঘ্যে ছড়িয়ে আছে ভাস্কর্য, প্রাকৃতিক শিলা, মোজাইক, চিত্রকর্ম ও লাইট ইনস্টলেশন। শহরের প্রায় ১০০টি মেট্রো স্টেশনের প্রতিটিতেই রয়েছে একেকটি ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পকর্ম।
শুরু যেভাবে:
১৯৫৭ সালে শিল্পী ভেরা নিলসন ও সিরি ডার্কার্টের প্রচেষ্টায় স্টকহোম সিটি কাউন্সিল মেট্রো স্টেশনে শিল্প সংযোজনের অনুমোদন দেয়। প্রথম ইনস্টলেশন করা হয় সবচেয়ে ব্যস্ততম কেন্দ্রীয় স্টেশন টি-সেন্ট্রালেন-এ। এরপর থেকে প্রায় ১৫০ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন এই প্রকল্পে।
প্রথম বড় ইনস্টলেশন আসে ১৯৬০-এর দশকে, যখন সিরি ডার্কার্ট ১৯৬৫ সালে ওস্তারমালমস্টরগ স্টেশনে নারীবাদ, শান্তি ও পরিবেশ নিয়ে স্যান্ডব্লাস্ট চিত্রকর্ম স্থাপন করেন। ১৯৭০-এর দশকে মেট্রো সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে আর্টও আরও বৃহৎ, ইমার্সিভ ও স্থানভিত্তিক হয়ে ওঠে। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে যুক্ত হয় ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। ২০১৫ সাল থেকে নতুন স্টেশনের জন্য পাবলিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিল্পী নির্বাচন করা হচ্ছে।
২০১৭ সালে শিল্পী লিভ স্ট্রমকুইস্টের ফেল্ট পেন স্কেচ, যাতে অনাবৃত নারীদেহ ও ঋতুকালে রক্তচিহ্ন ছিল, তা বিতর্ক সৃষ্টি করে।
ঘুরে দেখার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন
টি-সেন্ট্রালেন: স্টকহোমের প্রথম আর্ট স্টেশন। ব্লু লাইন প্ল্যাটফর্মে পার ওলোফ আল্টভেড্টের নীল পাতার ছায়াচিত্র স্টেশনটির ব্যস্ততার মধ্যে এক শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।
সলনা সেন্ট্রালেন: এই স্টেশনের লাল-সবুজ চিত্রপট শিল্পী কার্ল-ওলোভ বিয়র্ক ও আন্দের্স ওব্যার্গের কাজ। ১৯৭০-এর দশকের পরিবেশ ধ্বংস ও গ্রামাঞ্চল ত্যাগ নিয়ে বার্তা দেয়।
টেকনিস্কা হগস্কোলান: প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত এই স্টেশনটি বিজ্ঞানের সাথে শিল্পের সংমিশ্রণ। এখানে প্ল্যাটো’র পাঁচটি মৌলিক উপাদান (আগুন, পানি, বায়ু, মাটি, ইথার) এবং কপর্নিকাস, নিউটন, দা ভিঞ্চির ধারণাও রয়েছে।
কুংসত্র্যাগর্ডেন: শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, যেখানে আগে ছিল ফরাসি বাগান ও ম্যাকালোস প্রাসাদ। স্টেশনের ভেতরের রঙ ও ভাস্কর্য প্রাসাদের শিল্পকর্মের পুনরায় নির্মিত রূপ। এখানেই একমাত্র দেখা যায় গুহাবাসী মাকড়সা প্রজাতি Lessertia dentichelis।
সিটিবানান, ওডেনপ্লান: নতুন ট্রেন রুট সিটিবানানের অংশ ওডেনপ্লান স্টেশনে রয়েছে ১৪ শিল্পীর কাজ। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত “লাইফ লাইন”—শিল্পী ডেভিড সভেনসনের ঝুলন্ত আলোকরেখা, যা তার সন্তানের হৃদস্পন্দনের প্রতিরূপ।
জুন থেকে আগস্ট স্টকহোম ঘুরে দেখার সেরা সময়। আবহাওয়া মনোরম ও শহরে চলে নানা উৎসব। মার্চ-এপ্রিল ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে তুলনামূলক সস্তা, উপযুক্ত বাজেট ভ্রমণকারীদের জন্য।
শহরের কেন্দ্র তুলনামূলক ছোট হওয়ায় হাঁটাহাঁটি কিংবা সাইকেল চালিয়ে ঘোরা সহজ। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ইংরেজিতে নির্দেশনা থাকায় বিদেশিদের জন্য ব্যবহার সহজ। একটি মোবাইল অ্যাপ (SL App) বা কনট্যাক্টলেস কার্ড দিয়ে ৭৫ মিনিট পর্যন্ত ভ্রমণ করা যায়।
শিল্প, প্রযুক্তি ও পরিবেশসচেতনতা-এই তিনের সম্মিলনে গড়ে ওঠা স্টকহোম মেট্রো এখন কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ভ্রমণপিপাসু ও শিল্পপ্রেমীদের জন্য এটি এক অনন্য গন্তব্য।
মিরাজ খান