ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: ধলঘাটের মাটিতে জন্ম নেওয়া অগ্নিকন্যার ইতিহাস

মো. রাশেদুল্লাহ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পটিয়া, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১৪:১০, ২৫ জুলাই ২০২৫

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: ধলঘাটের মাটিতে জন্ম নেওয়া অগ্নিকন্যার ইতিহাস

ছবি: সংগৃহীত

শান্ত এক গ্রাম, নাম তার সমুরা—চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নে অবস্থিত। এখানেই ১৯১১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী প্রথম নারী শহিদা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। পটিয়ার এই নিভৃত জনপদের বুক চিরেই এক সময় ধ্বনিত হয়েছিল বিপ্লবের দামামা। আজও ধলঘাটের বাতাসে মিশে আছে প্রীতিলতার শপথ, ত্যাগ ও সাহসিকতার স্মৃতি।

জন্ম ও শিক্ষা: ছোট গ্রাম থেকে শহরের সংগ্রামে

প্রীতিলতা ছিলেন জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভাময়ী দেবীর কন্যা। বাবা জগবন্ধু ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রধান কেরানি। পাঁচ সন্তানকে নিয়ে তারা থাকতেন চট্টগ্রাম নগরের আসকার দীঘি এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতা ছিলেন মেধাবী, সংগ্রামী ও সাহসী মনোবৃত্তির অধিকারী।

তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এরপর ইডেন কলেজে এইচএসসি ও পরে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বেথুন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে বিএ পাস করেন। সেই সময় বাংলার নারী সমাজে উচ্চশিক্ষা ছিল দুষ্প্রাপ্য; কিন্তু প্রীতিলতা শুধু সেই বাধা অতিক্রম করেননি, বরং দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছিলেন।

বিপ্লবের পথে: মাস্টারদা সূর্য সেনের ছায়ায়

১৯২৮ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তরুণ-তরুণীরা তখন স্বপ্ন দেখছিলেন স্বাধীন এক মাতৃভূমির। এই সময়েই প্রীতিলতা যুক্ত হন মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলে। দলের অন্যতম শর্ত ছিল—প্রয়োজন হলে দেশের জন্য প্রাণও দিতে হবে। প্রীতিলতা তা-ই করেন।

চট্টগ্রামের ধলঘাট ছিল তখন বিপ্লবীদের অন্যতম ঘাঁটি। মাস্টারদার সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়ে প্রীতিলতা পা রাখেন ধলঘাটের বিপ্লবী সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে। সেখানে ব্রিটিশ পুলিশ ও বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। ইতিহাসে এটি ‘ধলঘাট যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ: অগ্নিকন্যার আত্মাহুতি

১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব, যেখানে লেখা ছিল—“Dogs and Indians not allowed।” এই বর্ণবাদী বার্তা প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ব্রিটিশ শোষণ ও অবমাননার।

প্রীতিলতা নেতৃত্ব দেন ওই ক্লাব আক্রমণে। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ অস্ত্রাগার দখলে নেওয়া। তবে অভিযানের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ধরা না দিয়ে তিনি পান করেন পটাশিয়াম সায়ানাইড, আত্মহননের মাধ্যমে বেছে নেন শহিদের মর্যাদা।

মৃত্যুর পূর্বে একটি চিরকুটে তিনি লিখে যান…

“ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে জন্ম নয় আমার। আমি বিপ্লবী কন্যা, চট্টলকন্যা, অগ্নিকন্যা। ইংরেজের শক্তি নেই, আমাকে বন্দী করে।”

আরেকটি চিরকুটে তার আক্ষেপ ধরা পড়ে…

“দেশের মুক্তিসংগ্রামে পুরুষ ও নারীর পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করেছিল। ভাইয়েরা যুদ্ধে নামতে পারলে, আমরা বোনেরা কেন পারব না?”

প্রীতিলতার উত্তরাধিকার ও ধলঘাটের ইতিহাস

২৩ বছর বয়সে যিনি নিজের জীবন দিয়ে মাতৃভূমির প্রেমে আত্মোৎসর্গ করেন, সেই প্রীতিলতার শেকড় ছিল এই ধলঘাটেই। বর্তমানে প্রীতিলতার পৈতৃক ভিটায় বসবাস করছেন শোভারানী দাশের পরিবার। স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতায় গঠিত হয়েছে—

‘দক্ষিণ সমুরা বিপ্লবী পূর্ণেন্দু-অর্ধেন্দু-সুখেন্দু-প্রীতিলতা স্মৃতি সংরক্ষণ সংসদ’।

এই বসতভিটার পাশেই ১৯৭০ সালে স্থাপন করা হয় একটি স্মৃতিফলক। এটি তৈরি করেন প্রীতিলতার সহযোদ্ধা ও বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার।

প্রীতিলতা কমপ্লেক্স: প্রজন্মের কাছে বিপ্লবের বার্তা

ধলঘাটের সেই বিপ্লবী মাটিতে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রীতিলতা কমপ্লেক্স।
২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এই ঐতিহাসিক কমপ্লেক্স উদ্বোধন করেন।

ছয়তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে রয়েছে—

  • প্রীতিলতা গণসাংস্কৃতিক মঞ্চ

  • মাস্টারদা সূর্য সেন রিসার্চ সেন্টার

  • সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার

  • প্রীতিলতা শিশুকানন বিদ্যানিকেতন

  • কল্পনা দত্ত যোশী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

এই প্রতিষ্ঠানটি আজ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি প্রজন্ম তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।

শেষ কথা

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার শুধুই একজন বিপ্লবী নন; তিনি এক সাহসিকতার নাম, আত্মত্যাগের প্রতীক, নারীর অগ্রযাত্রার অগ্নিসাক্ষ্য। ধলঘাটের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই কন্যা ইতিহাসকে নাড়িয়ে দিয়েছেন, প্রেরণা হয়েছেন হাজারও নারীর।

আজও যখন আমরা নারী স্বাধীনতা, শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার কথা বলি—প্রীতিলতা যেন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন:

"নিজেকে দুর্বল ভাববে না। ত্যাগই শ্রেষ্ঠ শক্তি।"

মুমু ২

×