
.
ঢাকায় থাকে তুহিন। তার বড় ভাই তানভীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তুহিন খুব ভালোবাসে তার অনিক ভাইয়াকে। ভাইয়া যখন গল্প করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, শিক্ষক, বই আর বন্ধুদের কথা- তুহিন তখন তা মন দিয়ে শোনে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে টিএসসি, রাজু ভাস্কর্য, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ডা. মিলন চত্বর, মধুর ক্যান্টিন, আর্টস ফ্যাকাল্টি। তার ভাই এসব স্থানের এমন সব গল্প তাকে শোনায় যে, তা তার কাছে কল্পনার মতো মনে হয়। প্রতিদিন তাই ভাইয়ার বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকে তুহিন।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকেলে ভাইয়া অনিক বাসায় ফিরলেন অনেক ক্লান্ত হয়ে। মুখে ধুলাবালি, গায়ে ঘাম। চোখেমুখে এক ধরনের দীপ্তি। অনিককে এমন অবস্থায় দেখেনি তুহিন কখনো। সেও বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল।
- ভাইয়া, আজ কী হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
অনিক হেসে বলেন,
- আজ আমি আন্দোলনে গিয়েছি। আমরা চাইছি, সবাই যেন মেধার ভিত্তিতে চাকরি পায়। কেউ যেন অন্যায়ভাবে বেশি সুযোগ না পায়।
তুহিন বুঝতে পারে না। সে আবার প্রশ্ন করে,
- তুমি কি বলছ, কেউ কেউ বেশি সুবিধা পায়, আর কেউ বঞ্চিত হয়?
ভাইয়া মাথা নেড়ে বললেন,
- হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমরা বলছি- যাদের সত্যিই দরকার, তারা যেন চাকরির সুযোগ পায়। সেই সুযোগটা হোক ন্যায্য। এই দাবি জানাতে গিয়ে আজ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার আন্দোলন করতে গেলে নিরস্ত্র আবু সাঈদের বুকে গুলি করেছে পুলিশ। তাতে তিনি মারা গেছেন। এ দৃশ্য দেখা ও জানার পর আর আমি স্থির থাকতে পারিনি। আমার ভাইকে ওভাবে হত্যা করা দেখে তা মেনে নিতে পারিনি। তাই আমি আজ আন্দোলনে গিয়েছি। আমি কোনো রাজনীতি করি না। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় আজ মিছিলে যোগ দিয়েছি। স্লোগান দিয়েছি- ‘কোটা না মেধা?/ মেধা মেধা’।
তখন চারদিকে থমথমে অবস্থা। কারফিউ চলছে। ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। ঢাকা কার্যত অচল হয়ে গেছে। তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে আন্দোলন। ছাত্রদের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে আস্তে আস্তে যোগ দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
পরের দিন তুহিন টেলিভিশনে দেখল, ছাত্ররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ব্যানার হাতে। তারা গাইছে-
‘ছাত্রদের ন্যায্য দাবিতে,/ আগুন জ্বালো আন্দোলনে।’
তুহিনের মধ্যে কেমন যেন উত্তেজনা দেখা গেল। তারও ইচ্ছে করে আন্দোলনে যোগ দিতে। সেও তো ছাত্র। এ আন্দোলন তারও। এ আন্দোলন একটি মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার। কিন্তু বাইরে যাওয়া নিষেধ। মা খুব ভয় পান। অগত্যা তুহিন রঙ-তুলি বের করল। একটি কাগজে লিখল: ‘আমি চাই মেধা যেন জয় পায়!’
সেই পোস্টার জানালার পাশে ঝুলিয়ে দিল। তা দেখে মা বললেন, ‘এটা কী করছো?’
তুহিন গর্ব করে বলে,
-আমি বড় হয়ে অনিক ভাইয়ার মতো হব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলব!
মা হেসে বললেন, ‘তাহলে তুমি তো এখনই একজন ছোট্ট নায়ক।’
তুহিনের কাছে অন্যরকম আনন্দ লাগে। সেও একরকমভাবে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন জানালা থেকে একটা করে নতুন নতুন হাতে আঁকা পোস্টার বাইরে লাগিয়ে দেয়। তাতে এক এক রকম স্লোগান। কোনোটাতে ‘আমার ভাই মরল কেন?/জবাব চাই, দিতে হবে’। কোনোটাতে ‘আবু সাঈদ আমার ভাই,/ খুনিরে তোর রক্ষা নাই’। এমন সব স্লোগান লিখে সে। তাদের বাসা মহল্লার এক গলিতে। ওই গলি দিয়ে যারাই চলাচল করেন, তারাই তুহিনের পোস্টার দেখেন। তারাও একই রকম স্লোগান ধরেন।
ঢাকার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষের একজন। কিন্তু অদম্য ছাত্রদের থামিয়ে রাখা যায় না। তাদেরকে থামাতে অনেক কৌশল নেওয়া হয়। দেওয়া হয় টোপ। কিন্তু সেই ফাঁদে পা দেননি ছাত্রনেতারা। বরং আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন বেগবান করেন। ওদিকে একের পর এক হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে থাকে পোষা বাহিনী। তাতে অসংখ্য মানুষ মরে। আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দেয়। তা থেকে সরাসরি গুলি করা হয়। সেই গুলি খেয়ে বাসার বারান্দায় খেলতে যাওয়া শিশু নিহত হয়। আগুন জ্বলে পুরো ঢাকায়। প্রতিবাদের আগুন। সত্যিকার আগুন। সেই আগুনে দগ্ধ হয় অত্যাচারী। তার গায়ে আগুনের উত্তাপ লাগতে থাকে।
হঠাৎ ৫ আগস্ট পাল্টে যায় ঢাকার চেহারা। তুহিন শুনতে পায় বাইরে লাখ লাখ মানুষের স্লোগান। দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। তাদের স্লোগানে মুখরিত ঢাকা। আকাশ-বাতাসে প্রতিধ্বনি উঠছে- ‘আবু সাঈদ আমার ভাই,/ খুনিরে তোর রক্ষা নাই’। এই স্লোগান শুনে তুহিন আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। সে যখন বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই দেখে তার মা প্রস্তুত হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিও আজ মিছিলে যাবেন। তুহিনের হাত ধরে পথে নামলেন। তারা সবাই মিলে স্লোগান দিতে লাগল- ‘খুন হয়েছে আমার ভাই,/ খুনির কোনো রক্ষা নাই’। এ দিনটা আনন্দে ভেসে গেল পুরো ঢাকা, বাংলাদেশ। রাস্তায় গিয়ে দেখা হলো অনিক ভাইয়ার সঙ্গে। তিনি তুহিনকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-‘তুইও তো আন্দোলনের অংশ ছিলি। তোর পোস্টারটা আমি ছবিতে দেখেছি!’
তুহিন মুচকি হেসে বলল,
-‘কারণ আমি অন্যায়ের রঙ বুঝি ভাইয়া; সত্যের রঙই সবচেয়ে উজ্জ্বল!’