ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

মুন্সীগঞ্জে কালের সাক্ষী মোগল স্থাপত্য

ইদ্রাকপুর কেল্লা নান্দনিক স্থাপত্য শৈলী  এখন জাদুঘর

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২৩ জুন ২০২৪

ইদ্রাকপুর কেল্লা নান্দনিক স্থাপত্য শৈলী  এখন জাদুঘর

মুন্সীগঞ্জের ঐতিহাসিক ইদ্রাকপুর কেল্লা

মোগল স্থাপত্য ইদ্রাকপুর কেল্লা। এই জলদুর্গ ঘিরেই পরে মুন্সীগঞ্জ শহর গড়ে ওঠে। সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকাকে সুরক্ষা ও প্রধান নদীগুলোতে মগ, পর্তুগীজ, হার্মাদ জলদস্যুদের  দমন ও গতিবিধি লক্ষ্য রাখতেই এটি নির্মাণ করা হয়। ৩৬৪ বছর আগে বিক্রমপুর পরগণার ইদ্রাকপুর এলাকাটি ইছামতি-ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার সংগমস্থল ছিল। মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র, ইছামতি ও ধলেশ্বরীর গতি পরিবর্তনের ফলে এখনকার মুন্সীগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থল পুরনো কাছারি সড়কের পশ্চিম পাশে কোর্টগাঁও এলাকায় অবস্থিত। চতুর্দিকে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত দুর্গের মাঝে মূল দুর্গ। প্রাচীর শাপলা পাপড়ির মতো। প্রতিটি পাপড়িতে ছিদ্র রয়েছে। রক্ষণব্যূহ হিসাবে ছিদ্র ব্যবহার করা হতো বন্দুকের গুলি ও তীর ছোড়ার জন্য। সিঁড়ি দিয়ে মূল দুর্গের চূড়ায় ওঠা যায়। মূল ভূমি হতে ২০ ফুট উঁচু। দেওয়ালের বর্তমান উচ্চতা ৪ থেকে ৫ ফুট। প্রাচীরের দেওয়াল ২ থেকে ৩ ফুট পুরু। দুর্গে প্রবেশদ্বারের উত্তর পাশে একটি গুপ্ত পথ ছিল। এটি আটকে দেওয়া হয়েছে। 
২শ’ ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ২৪০ ফুট প্রস্থের দুর্গটি এখনো অক্ষত অবস্থায়। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সেনাপতি ও বাংলার সুবেদার  মীর জুমলার  আমলে ১৬৫৮ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে দুই বছরে সম্পন্ন হয় ১৬৬০ সালে। এতে ব্যবহার করা হয় ইট, চুন ও সুরকি। কেল্লাটি পশ্চিম ও পূর্বাংশে বিভক্ত। বৃত্তের মাঝ বরাবর একটি ৫ ফুট উচ্চতার দেওয়াল রয়েছে। প্রাচীরের উত্তর পাশে কামান বসানোর তিনটি মঞ্চ। দক্ষিণ পাশে  রয়েছে দুটি।

দুর্গে প্রবেশের মূল পথটি উত্তরপাশে। কেল্লায় আবুল হোসেন নামে একজন সেনাধ্যক্ষ সর্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকতেন। তিনি ছিলেন নৌবাহিনী প্রধান। তার নিয়ন্ত্রণে ২০০ নৌযান পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির তীরে প্রস্তুত থাকত। কেল্লার নিয়ন্ত্রণে নৌযান ছিল কোষা, জলবা, গুরব, পারিন্দা, বজরা, তাহেলা, সলব, অলিল, খাটগিরি ও মালগিরি। আর কেল্লার নিয়ন্ত্রণে পদাতিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন সদলি খান। দুর্গের পশ্চিমের অংশে চারকোণে চারটি হেভি বুরুজ রয়েছে। বুরুজগুলোর দেওয়ালের গায়ে কৌণিক ছিদ্র রয়েছে গোলা ছোড়ার জন্য। ১৯০৯ সালে এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক উৎখননের ফলে দুর্গে  মোগল সময়কালে নির্মিত প্ল্যাটফর্ম, মেঝে, পানি নিষ্কাশন নালা, অস্ত্রাগার উন্মোচিত হয়। এছাড়া দুর্গটি সংস্কারের সময় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কাঠামোসমূহের মধ্যে মেঝে নির্মাণের বিশেষ কৌশল হিসেবে সারিবদ্ধ কলসের ওপর বর্গাকার টালি, ইট বসানো অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, আর্দ্রতাকে হিসেবে এই কৌশল ব্যবহার করা হতো। মোঘল ঢাকার ৩টি জলদুর্গের মধ্যে এটি অন্যতম।
মূল কেল্লার উপরে টালির চালার ভবন করে ১৮৪৫ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মহকুমা প্রশাসনের বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এটির দেখভাল করে। আব্দুল কুদ্দুস নামের একজন প্রতœতত্ত্ব বিভাগের স্টাফ দীর্ঘদিন এখানে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, সঠিক সংরক্ষণ অতিব জরুরি।  নয়ত এই মহামূল্যবান পুরাকীর্তিটি চ্যালেঞ্জে পড়বে। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। কেল্লার পরিচর্যা আর এর সঠিক ইতিহাস এবং নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর সঠিকভাবে কাজ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপন। অযতœ আর অবহেলায় অনেক ক্ষতি হয়েছে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এই প্রাচীন নিদর্শনটির। কেল্লার পাশেই ব্রিটিশরা নির্মাণ করে সাবজেল। যা আগে জেলার জেলখানা হিসেবে ব্যবহার হয়। নতুন কারাগার তৈরির পর এটি পরিত্যক্ত হয়। সেখানেই এখন জাদুঘর করা হয়েছে। জাদুঘর তৈরি করে রাখার ৮ বছরের মাথায় এটি চালু হয়। জেলখানার উপরের তলার অংশটি ছেঁটে ফেলে একতলা ভবনটি জাদুঘরে রূপান্তরের পর দর্শনার্থী বেড়েছে। নানা অঞ্চল থেকে আসছেন পর্যটক।

জাদুঘরে স্থান পেয়েছে  পোড়ামাটির মৃৎপাত্র, ঢাকনা, পিরিচ, ল্যাম্পস্ট্যান্ড, কলস ও পাথরের নান্দনিক প্রাচীন টুকরোসহ নানা প্রতœবস্তু। তবে প্রাচীন সভ্যতার জনপদ বিক্রমপুরের সমৃদ্ধ প্রত্ন সম্পদ জাদুঘরে রাখার দাবি দর্শনার্থীদের। বিক্রমপুরের সমৃদ্ধ জনপদের এই জাদুঘরে এসে অনেকটা বিস্মিত হন দর্শনার্থীরা। জাতীয় জাদুঘরের অনেক প্রত্ন সম্পদ এই বিক্রমপুরের। এর লেশমাত্র নেই এখানে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় জাতীয় জাদুঘরের গুদামে পড়ে আছে বিক্রমপুরের বহু প্রতœনিদর্শন।  অন্তত সেগুলো এই জাদুঘরে প্রদর্শনের দাবি করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা ক্যাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর সরকার মন্টু। এছাড়া মোগল স্থাপত্যটির অযতœ আর অবহেলার চিত্র দেখে ক্ষোভ তাদের। সকাল ১০টা থেকে  বিকেল ৬টা  পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত। সাপ্তাহিক ছুটি থাকছে রবিবার। পরের দিন সোমবার দুপুর ২টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত আধাবেলা খোলা থাকছে। সাধারণের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা। আর মাধ্যমিক পর্যন্ত শিশুদের প্রবেশ ফি ৫ টাকা। বিদেশীদের জন্য ১০০ ও সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১৯ মার্চ চালু হওয়া এই জাদুঘরে ১৮ জুন পর্যন্ত ৯৮ হাজার ৮৩০ দর্শনার্থীর ১২ লাখ ২৬ হাজার ৩৭০ টাকার প্রবেশ মূল্য জমা হয়েছে।
 

×