![বাংলার ঐতিহ্য ॥ পুণ্যাহ থেকে হালখাতা বাংলার ঐতিহ্য ॥ পুণ্যাহ থেকে হালখাতা](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2023May/Raja-2404191604.jpg)
.
পুণ্যাহ, তৎকালীন বঙ্গীয় অঞ্চলে জমিদারি ও নবাবী শাসনকালীন সময়ে রাজস্ব আদায়ের জন্য বাৎসরিক একটি বন্দোবস্ত ও উৎসবের নাম। বর্তমানে এটি একটি বিলুপ্ত ও ইতিহাসে নামসর্বস্ব উৎসব হিসেবে পরিচিত। এই উৎসবটি বিলুপ্ত হলেও এটার আঙ্গিকে এখনো গ্রাম-গঞ্জে হালখাতা নামে একটি অনুষ্ঠান করা হয়। সেখানে উৎসবের আমেজ না থাকলেও আনুষ্ঠানিকতা থাকে বেশ।
পুণ্যাহ ছিল রাজস্ব আদায় এবং বন্দোবস্ত সংক্রান্ত বিষয়ের প্রাক-ব্রিটিশ সময়ের একটি পদ্ধতি। যে ব্যবস্থায় সরকার কর্তৃক সকল জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার এবং অন্যান্য রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিদের বছরের নির্দিষ্ট দিনে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী বছরের রাজস্ব আদায় এবং নতুন বছরের বন্দোবস্ত প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো।
ইতিহাসেও সওয়ার হয়ে জানা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পুণ্যাহ উৎসব বাংলা নববর্ষের সমার্থক হিসেবে প্রতি বছর বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে নিয়মিতভাবে পালন হয়ে আসছে। ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ সাধনের পাশাপাশি পুণ্যাহ উৎসবের বিলুপ্ত ঘটে।
১৭৬৬ সালে, ইংরেজদের দেওয়ানি লাভের পর, প্রথম পুণ্যাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মুর্শিদাবাদ কোর্টে ইংরেজদের রাজনৈতিক আবাসস্থল মতিঝিলে। লর্ড ক্লাইভ এ উৎসবের সভাপতিত্ব করেন। তিনি এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং প্রতিবছর এ উৎসব পালনের পক্ষে ছিলেন। তবে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ফোর্ট উইলিয়ম সরকারকে এ পুণ্যাহ উৎসব পালন না করার নির্দেশ দেন।
চলে গেছে ইংরেজরা, নেই আর জমিদারি বা নবাবী শাসন ব্যাবস্থাও। তাই হারিয়ে গেছে জমিদার, নবাব বা ইংরেজদের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা পুণ্যাহ উৎসব। তারপর শুরু হয় মহাজনি ঋণ ও গ্রাম-গঞ্জের বড় বড় দোকানিদের থেকে এক শ্রেণির আস্থাভাজন ক্রেতা ও পাইকারি ক্রেতাদের বকেয়া মালামাল খরিদ করার ব্যবস্থা। একমাত্র পাইকারি ব্যবসায়ীরা ছাড়া অন্যান্য ক্রেতারা নেহায়েত বিপদে না পড়লে বাকিতে মালপত্র কেনে না কেউ।
যারা এমন বাকিতে মালপত্র কেনে তাদের থেকে বছরের বৈশাখের ১ তারিখ থেকে শুরু করে পুরো মাস বকেয়া আদায়ের জন্য যে আনুষ্ঠানিকতা পালন করে মহাজন ও দোকানিরা সেই আনুষ্ঠানিকতাই মূলত হালখাতা নামে পরিচিত।
বকেয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে হালখাতা অনুষ্ঠানে মহাজন ও দোকানিরা তাদের ক্রেতা ও শুভাকাক্সক্ষীদের জন্য রাখে হালকা খাবার ব্যবস্থা থেকে ভূরিভোজের ব্যবস্থাও। হালখাতার দিন সকাল থেকেই দোকানিরা সকল কাজ বন্ধ রেখে বকেয়া পরিশোধ করতে আসা ক্রেতাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকে। ক্রেতারা বকেয়া পরিশোধ করে, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তৃপ্তির হাসি নিয়ে পান মুখে বাড়ির পথ ধরে।
এখনো গ্রাম-গঞ্জে হালখাতার দিনে সারাদিন মাইক বাজিয়ে গান বাজনা চালানো হয়, দূর-দূরান্তের মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য হালখাতার প্রায় দিন পনেরো আগেই চিঠির মাধ্যমে মহাজন ও দোকানিরা বকেয়াধারী ক্রেতাদের জানিয়ে দেয় তাদের বাকির সম্ভাব্য হিসাব। এই চিঠিতেও পাওয়া যায় বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ছোঁয়া।