.
রাজকুমার বীর যখন মায়ারাজ্যের রাজা হলেন তখন রাজ্যে আর খুশি ধরে না। কারণ তিনি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ রকম প্রজাবৎসল, ভালো মানুষ এবং পরোপকারী। তাকে রাজা হিসেবে পেয়ে রাজ্যের সবাই ভয়ানক খুশি। বীর মায়ারাজ্যের শাসনকার্য হাতে পেয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেলেন। সারাদিন কাজ আর কাজ। প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর করা, কৃষকের ক্ষেতে গিয়ে ফসলের অবস্থা দেখা, রাজ্যের পথ-ঘাট সংস্কার সবকিছুই তিনি তার দক্ষ হাতে পরিচালনা করতে লাগলেন। তার আমলে মায়ারাজ্য স্বর্গপুরীতে পরিণত হলো। শস্য শ্যামলা, মায়ারাজ্য ফুল- ফলে ভরে উঠল। ঘরে ঘরে সুখের বন্যা। কোথাও কোনো অভাব নেই।
মায়ারাজ্যের প্রতিটা মানুষ, গাছের প্রতিটা পাখি, বনের প্রতিটা ফুল তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বীরের বাবা আলাউদ্দিন শাহ মনে মনে ভীষণ খুশি। তিনি ভাবলেন এবার ছেলেকে বিয়ে করানো উচিত। তিনি ছেলেকে ডাকলেন,
বীর, তোমার এখন বিয়ের সময় হয়েছে, তুমি সম্মতি দিলে আয়োজন করি?
বাবা, বিয়ে করতে পারি একটা শর্তে।
কী শর্ত, বীর? তুমি চাইলে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর? মেয়েটিকে মায়া রাজ্যের রানী করে আনতে পারি।
না, বাবা। আমার শর্ত অন্য।
ঠিক আছে, বলো তোমার শর্ত। রাজা আলাউদ্দিন শাহের কণ্ঠে কৌতূহল।
আমি বিয়ে করতে চাই এমন একজনকে যে হবে সত্যবাদী। জীবন গেলেও সে মিথ্যার আশ্রয় নেবে না।
কিন্তু সে রকম মেয়ে কোথায় পাব? আর বুঝবই বা কীভাবে, কে সত্যবাদী? কে মিথ্যে বলে?
বাবা, সেটি আমি দেখব। আপনি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। আশপাশের রাজ্যে জানিয়ে দিন। আগ্রহী রাজকন্যারা অনুষ্ঠানে আসুক। আমি সেখান থেকে বেছে নেব সত্যবাদী রানী। কিন্তু খবরদার কেউ যেন আমার শর্তের কথা না জানে।
ঠিক আছে, বীর তাই হবে।
রাজ্যে রাজ্যে ঢোল পড়ে গেল। মায়ারাজ্যের রাজা বীর বিয়ে করবেন। তিনি আগ্রহী কন্যাদের নিমন্ত্রণ করেছেন।
মায়ারাজ্যেও আনন্দ আর ধরে না। তাদের প্রিয় রাজা বিয়ে করবেন। প্রজারা নাচে, ফুলেরা নাচে, পাখিরা নাচে, মায়ারাজ্যে যেন সুখের ঢেউ।
নির্ধারিত দিনে মায়ারাজ্যের রাজপ্রাসাদের বিশাল সভাকক্ষে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।
আশপাশের রাজ্য থেকে রাজকুমারীরা বর্ণাঢ্য সাজে সেখানে উপস্থিত। তারা এত সেজেছে যে তাদের চেহারাই ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না। রাজা বীর একে একে রাজকুমারীদের সঙ্গে কথা বললেন। সবার পরিচয় নিলেন।
রাজা বীর সভাকক্ষের একপাশে একজন সাধারণ মেয়েকে বসে থাকতে দেখেন। তিনি এগিয়ে যান তার দিকে।
তুমি কি রানী হতে চাও? তাই এসেছ? বীর মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন।
জি - মহারাজ।
কোন রাজ্য থেকে এসেছ?
মহারাজ- আমি এ মায়ারাজ্যেরই মেয়ে। আমার নাম চাঁপালতা। আমার বাবা আপনার রাজ্যের দক্ষিণ পাশের এলাকাগুলো দেখাশোনা করেন।
বীর চাঁপালতার বাবাকে চিনতে পারেন।
তুমি এখানে কীভাবে আসলে। এখানে তো বিভিন্ন দেশের রাজকন্যারা এসেছে।
কিন্তু মহারাজ আপনার ঘোষণায় তো এমন করে বলেনি যে, রাজকন্যারা ছাড়া কেউ এ উৎসবে আসতে পারবে না।
হুম তা ঠিক। বীর চাঁপালতার কথায় সম্মত হলেন।
কিন্তু তুমিতো একদমই সাজগোজ করে আসোনি? সবাই কত সুন্দর হয়ে এসেছে।
সে সাজগোজ লাভ কী যে সাজ মুখ ধুলেই উঠে যায়। চাঁপালতার সাফ সাফ জবাব।
বীর চাঁপালতার কথায় মুগ্ধ হয়ে যান। একে একে সব রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বীর বলেন,
রূপেগুণে সব রাজকন্যাই অতুলনীয়। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। তিনি সব রাজকন্যাকে একটি করে ছোট কাঁচের কৌটা দেন। দিয়ে বলেন এই কৌটাগুলো আজ সবাই নিজ নিজ বাড়ি নিয়ে যাবে এবং কৌটার ভেতরে যা আছে তা দিয়ে শরবত বানিয়ে আগামীকাল এখানে নিয়ে আসবে। যার শরবত বেশি সুস্বাদু হবে, তাকেই আমার রাজ্যের রানী বানাব। কিন্তু সাবধান আমি খাওয়ার আগে কেউ শরবত খেতে পারবে না।
রাজ্যকন্যারা খুশি মনে রাজ্যে ফিরে আসে। পরদিন সবাই শরবত তৈরি করে নিয়ে হাজির হয়।
মায়ারাজ্যের রাজপ্রাসাদের সভাকক্ষে রাজকন্যারা বসে আছে। সবার সামনেই শরবতের জগ।
রাজা বীর একে একে সব রাজকন্যার কাছে যান। সবার শরবত একটু একটু করে পান করেন। সবশেষে আসে চাঁপালতার পালা। বীর চাঁপালতার শরবত মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। চাঁপালতা তো ভয়েই অস্থির। তার বুক দুরু দুরু করছিল।
‘বাহ অপূর্ব!’ পুরো গ্লাস শরবত শেষ করে বলে ওঠেন রাজা বীর।
তিনি সভা কক্ষে ঘোষণা দেন চাঁপালতার শরবত বেশি সুস্বাদু। তিনি চাঁপালতাকেই এ রাজ্যের রানী করতে চান।
চাঁপালতা এ কথা শুনে খুশি হলো ঠিকই কিন্তু অন্যসব রাজকন্যা ভীষণ রেগে গেল।
তারা বলতে লাগল, আমরা কত রকম সুগন্ধী, কিশমিশ, পেস্তা, এলাচ, গোলাপ জল দিয়ে শরবত করেছি। তাছাড়া আমরা খেয়েও দেখেছি অসাধারণ স্বাদের শরবত। আর আপনার ভালো লাগল চাঁপালতার শরবত? তাছাড়া রাজা বীর তো তার কৌটায় লবণ ছাড়া তো কিছুই দেননি। লবণ দিয়ে কি শরবত হয়? আমরা তো ওসব ফেলে দিয়েছি।
তোমার শরবতে এমন কী ছিল বলোতো চাঁপালতা?
সব রাজকন্যা একটু একটু করে চাঁপালতার শরবত খায় আর থু থু করে ফেলে দেয়।
কী ছিল তাতো জানি না। মহারাজ আমাকে যে কৌটা দিয়েছেন ওটার ভেতরে যা ছিল তা দিয়েই শরবত তৈরি করেছি। তাছাড়া শরবত তো খেয়ে দেখার নিয়ম ছিল না। চাঁপালতা নরম কণ্ঠে জবাব দেয়।
মহারাজ বীর উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলেন, চাঁপালতা শরবতের স্বাদ পরীক্ষা করেনি এবং অন্য কিছু না মিশিয়ে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছে। সে তার কার্যসিদ্ধির জন্য কোনো ছলনার আশ্রয়ও নেয়নি। তার সততার পুরস্কার হিসেবেই আমি তাকে এ রাজ্যের রানী করতে চাই। একজন নির্লোভ এবং সৎ রানীরই মায়ারাজ্যে দরকার।
এরপর মহাধুমধামে রাজা বীর ও চাঁপালতার বিয়ে হয়ে যায়। সে খুশিতে মায়ারাজ্যের আকাশ হাসে, বাতাস হাসে, ফুল হাসে, পাখি হাসে।