ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশী পিঠার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচয়ে উদ্যোগ

ফাস্টফুড কালচার নয়, ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২২:২০, ২৫ নভেম্বর ২০২২

ফাস্টফুড কালচার নয়, ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়

যশোরের পিঠা পার্কে গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া ১৩০ রকমের পিঠা পাওয়া যায়

দেশীয় ঐতিহ্যের পিঠার সম্ভার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে যশোরের ‘আইডিয়া পিঠা পার্ক’। শুধু ফিরিয়ে আনাই নয়, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এর পরিচয় ঘটিয়ে ‘বিদেশী ফাস্টফুড’কে হটিয়ে দেওয়ারও প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি ইতোমধ্যে পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে। মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পথচলা সেই সংগঠনের পাঁচ বছরে কলেবর বেড়েছে অনেক। এখানে কলেজ শিক্ষার্থীদের বিকল্প উপার্জনের পাশাপাশি লভ্যাংশের পুরোটা দিয়েই চলছে নানান সামাজিক কাজ। তাই প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই ব্যতিক্রমী এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা জানান, আইডিয়া পিঠা পার্ক মূলত শিক্ষার্থীদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি উদ্যোগ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যশোরের খড়কী শাহ্ আব্দুল করিম রোডে আইডিয়া পিঠা পার্ক যাত্রা শুরুর পর থেকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ভিন্ন আয়োজনের এই প্রতিষ্ঠানটিকে। প্রথম থেকে আইডিয়া পিঠা পার্কে ১০১ রকম পিঠা দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০ রকমের ঝাল-মিষ্টি পিঠার সম্ভারে। থরে-থরে সাজানো পিঠা যা দেখে চমকিত হবেন যে কেউ। যেসব পিঠায় দাদি-নানিদের স্পর্শ ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতায় তা হারিয়ে যেতে বসেছে। সেইসব পিঠা যেন একত্রিত হয়ে নতুন প্রাণ পেয়েছে এখানে। ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ অনুযায়ী সকাল থেকে রাত অবধি স্বাদ নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এখানে নিরলস পরিশ্রম করছেন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী। যারা সবাই কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একঝাঁক আলোকিত উদ্যোক্তা প্রতিনিয়ত নিরলসভাবে কাজ করছেন পিঠাশিল্প রক্ষায়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে তৈরি আইডিয়া পিঠা পার্কের পণ্য এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। উদ্যোক্তা জানান, পিঠা পার্ক থেকে অর্জিত লভ্যাংশ শুধু সদস্যরাই নেন না বরং এর একটা বড় অংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ও সামাজিক কাজের জন্য ব্যয় করা হয়। অপরদিকে, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই সংগঠনের মাধ্যমে গত কয়েক বছর সুবিধাবঞ্চিত শিশুর মধ্যে খাবার ও পোশাক বিতরণ করা হয়।

এ ছাড়া রোজার মাসে তারা শীতল পানি সরবরাহ, মসজিদে অজুখানা বানিয়ে দেওয়াসহ নানারকম সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা আইডিয়া সমাজ কল্যাণ সংস্থার স্বপ্নদ্রষ্টা যশোর সরকারী এমএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, প্রথমে লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। শিক্ষার্থীরা চাকরির পিছনে না ছুটে কর্মমুখী হতে পারে। সেই লক্ষ্য নিয়েই মাত্র তিন হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। আইডিয়া পিঠা পার্কের ঊষালগ্নে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার হওয়া লেগেছে। জায়গা সংকটে নিজের বাসা ছেড়ে দিয়ে আমি বাসা ভাড়া নিয়ে থেকেছি শিক্ষার্থীদের জন্য। পিঠা পার্কে পাটিসাপটা, পাকান, পুলি, ভাঁপা, চিতইসহ দেশীয় ১৩০ রকমের পিঠা তৈরি করা হচ্ছে।
হামিদুল হক শাহীনের মতে, আজকের জনপ্রিয় ফাস্টফুড কোনো নিক্তিতেই এ দেশের পিঠাপুলির চেয়ে এগিয়ে ছিল না। যদিও শক্তিশালী মার্কেটিং আর করপোরেটের ছোঁয়া আমাদের খাদ্যাভ্যাসে এনে দিয়েছে পরিবর্তন। আমরা হারাতে বসেছি বাংলার বৈচিত্র্যময় পিঠার সম্ভার। দেশীয় ঐতিহ্যের পিঠার সম্ভার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা যে সংগ্রামে নেমেছিলাম সেটা সফল হয়েছে। আমরা অবাক হয়েছি, যে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছিলাম মানুষ পিঠাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। মানুষ পিঠাকে ভুলেনি। পিঠার মতো এমন অনন্য খাদ্যসম্ভার যে আমাদের রয়েছে, যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারলে পিঠাই হতে পারে আমাদের অর্থনীতির আরেকটি প্রাণশক্তি। আইডিয়া পিঠা পার্কের কো-অর্ডিনেটর সোমা খান বলেন, আমরা মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি পিঠা শুধু শীতের খাবার না; এটা সকল ঋতুর খাবার। আগে মানুষের পিঠার চাহিদা থাকলেও সহজলভ্যতা ছিল না। এখন আমরা শহরের মধ্যে সহজলভ্যতা তৈরি করেছি। পিঠা নিয়ে এতদূর আসা যায়, আমাদের অকল্পনীয় ছিল। পিঠা নিয়ে আমাদের অনেকদূর যাওয়ার ইচ্ছা। সোমার মতে, মার্কেটিং ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব কাটিয়ে দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বদরবারে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে বাংলার পিঠা।
এদিকে, আইডিয়া পিঠা পার্কের ৫ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী পিঠাপার্বণ উৎসব শুরু হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। উৎসব উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সেজেছে সংগঠনটির কার্যালয়। তিনদিন ব্যাপী এই উৎসবে যশোরের সবশ্রেণির মানুষ পিঠার সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সঙ্গে আনন্দে মেতেছেন। এদিন পিঠা নিয়ে বাংলাদেশ পিঠা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম প্রকাশনা ‘বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক পিঠার সম্ভার’ মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মর্জিনা আক্তার, বিশেষ অতিথি ছিলেন যশোর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অমল কুমার বিশ্বাস, যশোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আশরাফ-উদ-দৌলা, প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান, প্রেস ক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ববিদ ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।

 

×