
এ্যাওয়ার্ড পার্কে ব্রিটিশ সম্রাট সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের স্ট্যাচু
প্রতিদিন হাজারও মানুষ বগুড়ার এ্যাডওয়ার্ড পার্কে ঘুরতে যায়। গাছগাছালি পাখপাখালির মধ্যে ছোট্ট একটি উন্মুক্ত খুপরিতে ব্রিটিশ রাজকীয় ইতিহাসের এক সম্রাট পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রমণার্থীরা তাকে দেখে। জানতে চায় না কে তিনি। গোল পাথরের স্তম্ভে তার নাম লেখা আছে এম্পেরর এ্যাডওয়ার্ড দ্য সেভেন। তারপর কোথাও তার ছোট্ট হলেও কোন পরিচিতি নেই। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই (এবং অনেক প্রবীণ ও মধ্যবয়সী) জানেন না কিভাবে তিনি স্ট্যাচু হয়ে এলেন। কেনই বা পার্কের নাম এ্যাডওয়ার্ড হলো। এ্যাডওয়ার্ড কি বগুড়া এসেছিলেন। অনেকগুলো প্রশ্ন জড়ো হয়। কেউ উত্তর খুঁজে পায় না।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হওয়ার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (ব্রিটিশ) দখল করে নেয় এই উপমহাদেশ। তারপর এই অঞ্চলের শাসনভার চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। সেই ব্রিটিশদেরই এক স¤্র্রাট এই এ্যাডওয়ার্ড। মূল নামের সঙ্গে এ্যাডওয়ার্ড যুক্ত নামে আটজন স¤্র্রাট ছিলেন। এই সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের শ্বেত পাথরের স্ট্যাচু শুধু বগুড়ায় তার নামের পার্কে আছে (খোঁজখবর করে জানা যায় দেশের অন্য কোথাও তার এমন স্ট্যাচু নেই)।
ব্রিটিশ মহারানী ভিক্টোরিয়ার (এলিজাবেথের আগে) ছেলে এমপেরর (স¤্র্রাট) আলবার্ট এ্যাডওয়ার্ড। তার ডাক নাম বিরটি। কেন তিনি সেভেনথ এ্যাডওয়ার্ড হলেন তার ইতিহাস অস্পষ্ট। তবে স¤্র্রাট অষ্টম এ্যাডওয়ার্ডের চমকপ্রদ প্রেমের ইতিহাস অনেকের জানা। বিশ্বে একমাত্র এই স¤্র্রাট প্রেমের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। অষ্টম এ্যাডওয়ার্ড ভালবেসেছিলেন লেডি সিম্পসনকে। প্রণয়ের খবর জানলেন মহারানী ভিক্টোরিয়া। সিম্পসন রাজ পরিবারের ছিলেন না। যে কারণে রানী ভিক্টোরিয়া অষ্টম এ্যাডওয়ার্ডের প্রণয় মেনে না নিয়ে দুটি অপশন দেন। ১. বিয়ে করলে সিংহাসন ত্যাগ করতে হবে। ২. বিয়ে না করলে সিংহাসন বহাল থাকবে। অষ্টম এ্যাডওয়ার্ড প্রথমটি (সিংহাসন ত্যাগ) বেছে নেন। সেই থেকে প্রেমের জন্য সিংহাসন ত্যাগ সারাবিশ্বে উদাহারণ হয়ে আছে। সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের ভাগ্যে একটি প্রণয় ছিল। তবে তিনি সেই প্রণয় ত্যাগ করে তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। তার পরিচিতি প্রিন্সেস অব আলেকজান্ড্রা অব ডেনমার্ক। সপ্তম এ্যাওয়ার্ডের জন্ম বাকিংহাম প্যালেসে ১৮৪১ সালের ৯ নবেম্বর। তিনি মারা যান ১৯১০ সালে। এই সময়ের মধ্যে সপ্তম এ্যাডওয়ার্ড ব্রিটিশ নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীতেও ছিলেন। সপ্তম এ্যাডওয়ার্ড অষ্টম এ্যাডওয়ার্ডের মতো সিংহাসন লোভী ছিলেন না। তিনি বিশ্বময় ঘুরে বেরিয়েছেন। ১৯০১ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া মারা যাওয়ার পর একই বছর ২২ জানুয়ারি স¤্র্রাটের আসনে বসতে হয় সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডকে। তিনি ছিলেন উদারপন্থী। ব্রিটিশ রক্ত শরীরে থাকার পরও তিনি ব্রিটিশ শাসনের কলোনিয়াল প্রথার অনেক কিছুই মেনে নিতে পারেননি। এজন্য পরবর্তী মহারানীদের সঙ্গে তার বিরোধ হয়। তারপরও সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডকে সবকিছু মানতে বাধ্য করা হয়। স¤্র্রাট হওয়ার আগে সপ্তম এ্যাডওয়ার্ড ছিলেন প্রিন্স অব গোথা সেক্সকোবার্গ ও প্রিন্স অব ওয়েলস।
স¤্র্রাটের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করার পর তার অধীনে চলে আসে যুক্তরাজ্য (ইউকে) গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড। তিনি ভারতবর্ষ ঘুরে দেখেন। ওই সময়ে বগুড়া অঞ্চলে তিনি এসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। তবে তার মা মহারানী ভিক্টোরিয়া এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার নামে বগুড়ার একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় আছে। বগুড়া নগরীর সার্কিট হাউসের বিপরীতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (ভিএম) গার্লস স্কুল বর্তমানে সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। লোকমুখে এখনও এই স্কুলের নাম ‘ভিএম স্কুল’। সেই হিসাব কষে বলা যায় সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের স্বল্প সময়ের জন্য বগুড়ায় আগমন বিচিত্র নয়। কারণ সপ্তম এ্যাডওয়ার্ড ভ্রমণ পিপাসু ছিলেন।
বিতর্কের এই অধ্যায় বাদ দিয়ে এ্যাডওয়ার্ড পার্কের বিষয়ে জানা যায় বগুড়ার নওয়াব পরিবারের নবাব আলতাফ আলী এই পার্কের জন্য ৯ দশমিক ৬৬ একর ভূমি দান করেন। বিষয়টি জানালেন বগুড়ার পৌরসভার সাবেক মেয়র এ্যাডভোকেট মাহবুবর রহমান। তিনি বলেন নওয়াব আলতাফ আলী ও তার ছেলে মোহাম্মদ আলী (তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) বগুড়া পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালীন বগুড়ার সৌন্দর্য বাড়াতে পার্কে অনেক কিছুই স্থাপন করেন। যেমন বগুড়ার ওই পার্কে স্থাপিত হয় ঘুর্নায়মান রঙ্গমঞ্চ। এই ঘুর্নায়মান রঙ্গমঞ্চ ছিল কলকাতার পরই বগুড়ায়। নওয়াব আলতাফ আলী ও মোহাম্মদ আলী ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলের ভারতবর্ষের ১৪টি রাজ্যের একটির লেজেসলেটিভ (আইনপ্রণেতা)। জনশ্রুতি আছে নওয়াব আলতাফ আলীর সঙ্গে স¤্র্রাট এ্যাওয়ার্ডের আলাপ পরিচয় ছিল। তিনি (নওয়াব আলতাফ আলী) সিদ্ধান্ত নেন বগুড়ার পার্কটি স¤্র্রাট সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের নামেই হবে এবং স¤্র্রাটের একটি শ্বেত পাথরের স্ট্যাচু পার্কে স্থাপিত হবে। এই স্ট্যাচু কলকাতা থেকে বানিয়ে আনা হয়। সেই থেকে স্ট্যাচুটি এ্যাডওয়ার্ড পার্কে আছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের স্ট্যাচুটি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর এ্যাডওয়ার্ড পার্কে সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের স্ট্যাচুটি পুনর্স্থাপিত হয়। যে স্ট্যাচু এখনও অনেকের কৌতূহলের বিষয়।