ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আধুনিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অগ্রদূত

প্রকাশিত: ২২:৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

আধুনিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অগ্রদূত

‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে যিনি ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করেছেন, সেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল (১৮২০-১৯১০) ছিলেন যুক্তরাজ্যের একজন নার্স, সমাজ সংস্কারক ও পরিসংখ্যানবিদ। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি আধুনিক নার্সিং বিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা। নার্সিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। ক্রাইমিয়ান যুদ্ধে নার্স হিসেবে তাঁর যে অভিজ্ঞতা সেটিই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে তাঁর মধ্যে আধুনিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ লাভ করতে সাহায্য করেছে। তাঁকে ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতির আইকন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তিনি যে সংস্কার সাধন করেছেন তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পুরো বিশ্বে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। এই মহীয়সী নারী ১৮২০ সালে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীর এক অভিজাত ও ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-মাতা ছিলেন উইলিয়াম শোর নাইটিঙ্গেল ও ফ্রান্সেস নাইটিঙ্গেল। খুব অল্পবয়স থেকেই ফ্লোরেন্স সমাজসেবা ও মানবসেবায় নিজের ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের পারিবারিক ভূসম্পত্তির আশপাশের গ্রামগুলোতে গরিব ও অসুস্থ রোগীদের সহায়তার কাজে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে এসে তিনি বুঝতে পারলেন যে সেবিকা হওয়ার ব্রত নিয়েই তাঁকে এগিয়ে যেতে হবে এবং এটা তাঁর এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনা। ভিক্টোরিয়ান যুগে তাঁর মত ধনী ও অভিজাত পরিবারের একজন সুন্দরী তরুণী নার্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে তা যে কোন বাবা-মায়ের কাছে কল্পনাতীত ছিল। বিয়ের জন্য ধনী ও সুদর্শন কোন যুবককে বেছে নেয়ার পরিবর্তে, বাবা-মায়ের আপত্তি উপেক্ষা করে, ১৮৪৪ সালে তিনি জার্মানির লুথেরান হসপিটাল অফ পাস্ত্তর ফ্লিয়েডনায় নার্সিংয়ের ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হন। ১৮৫০ সালের শুরুর দিকে তিনি লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন ও মিডেলসেক্স হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। কর্মক্ষেত্রে তাঁর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কর্তৃপক্ষকে বিমুগ্ধ করে ও তিনি এক বছরের মধ্যেই তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। যখন কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে এই সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তখন নাইটিঙ্গেল হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উন্নতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমাতে সাহায্য করেন। ক্রাইমিয়ান যুদ্ধ শুরু হয় ১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য দখল নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার ব্রিটিশ সৈন্যদের কৃষ্ণসাগরে পাঠানো হয় যেখানে খাদ্যের রসদ প্রায় ফুরিয়ে আসছিল। ১৮৫৪ সালে ১৮০০০ সৈন্য সেনাবাহিনীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ছিল। সেই সময় ক্রাইমিয়ার কোন হাসপাতালে নারী নার্স ছিল না। নারী নার্সদের নিয়ে দুর্নাম থাকার কারণে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রক অফিসগুলো নারীদের নার্স হিসেবে নিতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু আলমা যুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে অসুস্থ ও আহত সৈন্যদের প্রতি অবহেলার কারণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এসব সৈন্যরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল কারণ পুরো ব্যবস্থাটি সঠিকভাবে পরিচালনা করার মতো লোকবল ছিল না। আর অস্বাস্থ্যকর ও অমানবিক পরিবেশ এই অবস্থাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ১৮৫৪ সালের শেষের দিকে ফ্লোরেন্স সিডনি হারবার্ট থেকে একটি চিঠি পান। তিনি তাঁকে কিছু সেবিকাকে সঙ্গে নিয়ে ক্রাইমিয়াতে এসে আহত ও অসুস্থ সৈন্যদের দেখভাল করার অনুরোধ করেন। তিনি এতে সাডা দেন। তিনি খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন ধর্মানুসারী ৩৪ জন সেবিকাকে সঙ্গে নিয়ে ক্রাইমিয়াতে রওনা হয়ে যান। যদিও তাদের ওখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল কিন্তু স্কেটারিতে ব্রিটিশ বেইস হাসপাতালে তারা যা দেখলেন তা ছিল এক কথায় অবর্ণনীয়। পরিবেশ ছিল নোংরা আবর্জনায় ভরপুর, জিনিসপত্রের সরবরাহ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে কম, কর্মরত লোকজনের অসহযোগিতা ছিল চরমে আর হাসপাতালে রোগীদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তিনি কলেরা ওয়ার্ডে কাজ করতে শুরু করলেন। তাঁর আসার পাঁচ দিনের মাথায় বালাকলাভা ও ইনকারম্যান যুদ্ধ থেকে আহত সৈন্যরা স্কেটারিতে আসতে শুরু করল। তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সমস্ত সুযোগ-সুবিধার উপর বড় ধরনের চাপ পড়তে শুরু করল। নাইটিঙ্গেলের ভাষায় এটা তখন হয়ে উঠেছিল ‘নরকরাজ্য’।
×