ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ এমএ আজিজ

করোনাকালে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেতনতা

প্রকাশিত: ২১:১৭, ২৪ জুলাই ২০২০

করোনাকালে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সচেতনতা

কোভিড-১৯ প্রথম শনাক্তকরণের পর ইতোমধ্যে ছয় মাস পেরিয়েছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ছয় লাখের অধিক। করোনা সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এটি অনুধাবন করা যায় যে করোনার তা-ব সহসাই থামছে না। করোনার প্রভাবে প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষের জীবনযাপন, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ বিশ্বের সর্বক্ষেত্রেই আজ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা মেনে চলার ব্যাপারে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশনের ন্যায় কিছু শব্দের প্রচলন হয়েছে যা অনেকের কাছেই নতুন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক দুর্বোধ্য শব্দ সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা ছাড়াই সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। দুর্বোধ্য ও অপরিচিত এই শব্দগুলো সাধারণ মানুষের কাছে সহজতর ও বোধগম্য করা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। কোভিড-১৯ : কোভিড-১৯ হলো সংক্রামক ব্যাধি অর্থাৎ ছোঁয়াচে রোগ যার জন্য দায়ী হলো একটি আবরণীবদ্ধ আরএনএ ভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চাযনার উহানে ‘নিউমোনিয়া (শ্বাসতন্ত্রের রোগ)’ রোগ ধরা পড়ে যার কারণ ছিল অজানা। পরে এর কারণ হিসেবে দেখা যায় যে করোনাভাইরাসের নতুন একটি প্রজাতি (ঝঅজঝ-ঈড়ঠ২)-এর জন্য দায়ী এবং এর পর থেকে ২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস’ নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ‘কোভিড-১৯’ নামে নামকরণ করা হয়। ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) : ইমিউনিটি হলো মানবদেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার গুণমান বা অবস্থাকে ইমিউনিটি বলা হয়। বিশেষত কোন প্যাথোজেনিক অনুজীবের বিকাশ রোধ করার মাধ্যমে বা এর উৎপাদিত বস্তুসমূহের প্রভাবগুলো প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি বিশেষ রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হওয়ার অবস্থাই শরীরের ইমিউনিটি হিসেবে বিবেচিত হয়। হার্ড ইমিউনিটি : একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার ৪০ হতে ৬০ শতাংশ জনগণের মাঝে যদি কোন সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তখন সেই জনসংখ্যার যে সব লোকের মাঝে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়নি তাদের মাঝে রোগ সংক্রমণ বাধাগ্রস্ত হয়; একে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বলে। দেহে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বা সেই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তৈরি হতে পারে। সামাজিক দূরত্ব : কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজের বাড়ির বাইরের মানুষের সঙ্গে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় ৬ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একেই সামাজিক দূরত্বও বলে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার : এক ধরনের তরল জীবাণুনাশক যা হাত বা শরীরের সংস্পর্শে আসা জীবাণুকে মেরে ফেলতে পারে। এনডেমিক : একটি রোগ বা ব্যাধি যা একটি নির্দিষ্ট লোকালয় বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিনিয়ত কম-বেশি বর্তমান থাকে তাকে এনডেমিক বলে। যেমন : পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি ম্যালেরিয়ার জন্য এনডেমিক জোন। পেনডেমিক (মহামারী) : সমগ্র দেশ বা মহাদেশ বা বিশ্বব্যাপী কোন রোগ বা ব্যাধির প্রাদুর্ভাব। সার্ভিলেন্স (সন্দেহভাজন মানুষের ওপর কড়া নজর রাখা) : যে সমস্ত কারণ কোন ব্যক্তির অসুস্থতার জন্য দায়ী সে সমস্ত কারণ, উপাদান বা ঘটনাকে সর্বক্ষণিক নিরীক্ষণ করাকে সার্ভিলেন্স বলে। সেরোলজি সার্ভিলেন্স : রক্তের সিরামে কোন এ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করাকে সেরোলজি বলা হয়। একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার মাঝে কোন রোগের প্রাদুর্ভাব বা সংক্রমণের ব্যাপ্তি দেখার জন্য সেরোলজি সার্ভিলেন্স করা হয়। কন্টাক্ট ট্রেসিং (যোগাযোগ অনুসন্ধান করা) : এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে শনাক্তকরণ, যাচাইকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। আইসোলেশন (পৃথকীকরণ) : এটি সংক্রামক রোগের বিস্তার বন্ধ করার জন্য সর্ব প্রাচীন পদ্ধতি। সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আলাদা রাখা হয়, যেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যদের মধ্যে রোগ বিস্তার করতে না পারে। কোয়ারেন্টাইন : সংক্রামক রোগের বিস্তার বন্ধ করার জন্য কোন সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্য সুস্থ মানুষ (যারা সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসে নাই) থেকে আলাদা রাখাকে কোয়ারেন্টাইন বলে। কোয়ারেন্টাইনের সময়কাল জীবাণুর উন্মেষকালের সমান হয়। হোম কোয়ারেন্টাইন : সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে নিজের বাড়িতে একটি রুমে অন্যদের থেকে আলাদা রাখাকে হোম কোয়ারেন্টাইন বলে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন : সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষকে কোন প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে অন্যদের থেকে আলাদা রাখাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বলে। লকডাউন : সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধের জন্য জনসাধারণকে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অত্যাবশকীয় প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে না বের হওয়াকে লকডাউন বলে। জোনিং : নির্দিষ্ট এলাকায় সংক্রমণের হার ভিন্নতায় এলাকাসমূহ সবুজ, হলুদ এবং লাল- এভাবে চিহ্নিত করাকে জোনিং বলা হয়। সবুজ এলাকা (গ্রীন জোন) হলো কোন নির্দিষ্ট এলাকাতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মাঝে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিন জনের নিচে থাকে। হলুদ এলাকা (ইয়েলো জোন) হলো কোন নির্দিষ্ট এলাকাতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মাঝে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩-৫৯ জন হয়ে থাকে। লাল এলাকা (রেড জোন) : কোন নির্দিষ্ট এলাকাতে প্রতি লাখ জনসংখ্যার মাঝে যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ জন বা তা চেয়ে বেশি থাকে। ট্রায়াজ (পৃথকীকরণ) : হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ ও নন কোভিড-১৯ রোগীদের পৃথকীকরণ করে চিকিৎসা প্রদান করা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ট্রায়াজ বলতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিৎসার ব্যবস্থাকে বোঝায়। আরটিপিসিয়ার (রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন রিয়েল টাইম পলিমারের চেন রিএ্যাকশন) : আরটিপিসিআর হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাসের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। (ডঐঙ) কর্তৃক অদ্যাবধি একমাত্র স্বীকৃত, নির্ভরশীল এবং বিশ্বব্যাপী। গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যক্তির কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নমুনা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় কেবল আরএনএ বের করা হয়। তারপর এক্সট্রাক্ট আরএনএকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার করে কম্পলিমেন্টারি ডিএনএতে রূপান্তর করা হয় এবং পলিমারেজ চেন রিএ্যাকশন (পিসিআর) ব্যবহার করে প্রাপ্ত ডিএনএর একটি অংশকে পরীক্ষা করে এটি ঝঅজঝ-ঈড়ঠ-২ এর জেনেটিক কোডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) : পিপিইর মধ্যে রয়েছে চশমা/ফেসশিল্ড, মাস্ক (মুখ বেষ্টনী), ক্যাপ, গাউন, কভার অল, সার্জিক্যাল গাউন, গ্লাভস, সু-কাভার যা চিকিৎসকগণ রোগীর চিকিৎসা প্রদানের সময় ব্যবহার করে থাকেন। তবে সাধারণ জনগণের জন্য করোনা প্রতিরোধে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। অক্সিজেন থেরাপি : রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে বা শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে হাসপাতালসমূহে চিকিৎসকের পরামর্শে নিম্নের যে কোন পদ্ধতি অবলম্বনে অক্সিজেন থেরাপি দেয়া হয়। * অক্সিজেন সিলিন্ডার : অক্সিজেনকে অত্যধিক প্রেশারে তরল করে। সরবরাহ করা হয় যা দিয়ে প্রতি মিনিটে ২-১৫ লিটার অক্সিজেন দেয়া যায়। * হাই ফ্লো নেজাল ক্যানুলা : এই যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চ চাপে নেজাল ক্যানুলার সাহায্যে রোগীকে প্রতি মিনিটে ৭০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। বর্তমান বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। * অক্সিজেন কনসেনট্রেটর : এটি একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র যার সাহায্যে বাতাস থেকে অক্সিজেনকে ঘন করে রোগীকে সরবরাহ করা হয়, ফলে রোগীকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘসময় ১-১০ লি. পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর * বাইপেপ (ইর-চঊচ): বাই পেপ মেশিনের সাহায্যে যাদের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) আছে যা ফুসফুসের এক ধরনের জটিল রোগ তাদের প্রতি মিনিটে ১৫০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেয়া যেতে পারে। * সি-পেপ : সি-পেপ মেশিনের সাহায্যেও প্রতি মিনিটে ১০০-১৫০ লিটার অক্সিজেন দেয়া যায়। * লাইফ সাপোর্ট / মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর: এই যন্ত্রের সাহায্যে রোগীর সম্পূর্ণ শ^^াস-নিশ্বাস মেশিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) : আইইডিসিআর হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ সরকারের একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট যা বাংলাদেশে মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধি গবেষণা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয় নিয়ে কাজ করে। মহামারী প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ৩১ দফা নির্দেশনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের ১২ দফা স্বাস্থ্যবিধির প্রস্তাবনার সুফল আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। অন্য সব ক্ষেত্রের ন্যায় ডিজিটাল বাংলাদেশে টেলিমেডিসিনের জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষের মাঝে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর সুফল পাচ্ছেন। সরকারের সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিই হবে সঙ্কট উত্তরণের পথ। সঠিক তথ্য সহজ করে তুলে ধরার মাধ্যমে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনসাধারণকে দৈনন্দিন কর্মকা-ে, অফিস-আদালতে স্বাস্থ্যবিধিসমূহ (যেমন ২০ সেকেন্ড ধরে বার বার হাত ধৌত করা, মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে, তবেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, আমরাও ফিরে আসব সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে। লেখক : মহাসচিব, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)
×