ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফুটবলে অশনিসংকেত, চেয়ার দখল নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি

ভোটের লড়াইয়ে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১ জুলাই ২০২০

ভোটের লড়াইয়ে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ

জাহিদুল আলম জয় ॥ ২০১৬ সালে ভুটান লজ্জা কাটিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল ফের জেগে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। গত বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ আশা জাগানিয়া পারফরমেন্স প্রদর্শন করেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। করোনা মহামারী কাটিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরার পালা জামাল-সাদদের। এর মধ্যে ফিফা বিশ্বকাপ বাছাই ফুটবল সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু ফুটবলারদের মাঠের খেলায় প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নির্বাচন নিয়ে তৈরি হওয়া কাদা ছোড়াছুড়িতে। বাফুফের ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য দুটি পক্ষ একে অপরকে নিয়ে বিষেদগারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যার বাজে প্রভাব মাঠের ফুটবলে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচনকে ঘিরে চলছে দুই পক্ষের কথার লড়াই। অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের ফিরিস্তি পৌঁছে গেছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার দরবারে। ক্ষমতার এই চেয়ার দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব ক্ষতি করছে দেশের ফুটবলের এমনটাই মনে করেন সংগঠকরা। এ কারণে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে ফুটবলের উন্নয়নে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রকৃত সংগঠকরা। নির্বাচন আসলে দুই পক্ষ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক হলেও এবার অভিযোগের লড়াই যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের সবকিছুকে। বর্তমান মেয়াদের কমিটিতেই আছেন অভিযোগ করা দুই সহ-সভাপতি বাদল রায় ও মহিউদ্দিন আহমেদ। বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির অসহযোগিতার অভিযোগ থাকলেও নিজেদের দোষত্রুটি নিজেরাই সমাধান না করে উল্টো ফিফার দ্বারস্থ হয়েছেন তারা। এতে করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। মূলত আসছে নির্বাচনে কাউন্সিলরশিপ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন মেরুকরণ। ভোটার হওয়া আর হতে না দেয়ার অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। এখানেও দ্বারস্থ হতে হয়েছে আদালতের। মাঠের সংগঠকদের মতে, চেয়ার দখলের এই অনৈতিক খেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ফুটবল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বহুল প্রতীক্ষিত বাফুফে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই ঘোষণায় গত ২০ এপ্রিল বাফুফে ভবনে হওয়ার কথা ছিল এজিএম ও নির্বাচন। কিন্তু মরণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছুর মতো স্থগিত হয়ে গেছে বাফুফে নির্বাচনও। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা ও এএফসির অনুমতি নিয়ে নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনে নতুন কমিটি গঠন হওয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান কমিটিকে দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাওয়ার অনুমতিও দিয়েছে ফিফা। নির্বাচন স্থগিত হলেও ভোটের বড় একটি কাজ এগিয়ে রেখেছে বাফুফে। সেটা হলো তাদের সদস্য সংস্থাদের প্রতিনিধিদের নাম সংগ্রহ। যারা আগামী এজিএমে ভোট দিতে পারবেন। এই প্রতিনিধি/কাউন্সিলর/ভোটার নিয়েই বিস্তর অভিযোগ তোলা হয়েছে বাফুফের বিরুদ্ধে। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত ও ফিফা পর্যন্ত। বিষয়টি নিয়ে গত কিছুদিন ধরে দু’পক্ষের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে আক্রমণ করছেন! নির্বাচন সামনে রেখে কাউন্সিলরদের নাম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল গত ৭ জুন। কিন্তু কাউন্সিলরের নাম জমা দেয়া নিয়ে হুলুস্থূল কা- চলছে। সাবেক জাতীয় ফুটবলার হাসানুজ্জামান খান বাবলু অভিযোগ করেন, টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমি তাদের কাউন্সিলর হিসেবে তাঁর (বাবলু) নাম পাঠালেও সেটি অন্যায়ভাবে বাতিলের চেষ্টা করছে বাফুফে। এমন অভিযোগ আছে আরও অনেকের। তবে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, বাফুফের গঠনতন্ত্র মেনেই সব চলছে। কোন অনিয়ম হচ্ছে না। এর প্রেক্ষিতে কাউন্সিলরশিপসহ আরও কয়েকটি অভিযোগ করে কিছুদিন আগে ফিফার কাছে চিঠি দেন বাফুফের বর্তমান সহসভাপতি বাদল রায় ও মহিউদ্দিন আহমেদ। তারা জানান, বাফুফে তড়িঘড়ি করে নির্বাচন করতে চায়। এমন অবস্থায় ফিফা বাফুফেকে নির্দেশনা দিয়েছে। তারা বাফুফেকে করোনার মধ্যে নির্বাচন আয়োজন না করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বাফুফের বর্তমান কর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি এতে থামেনি। এ প্রেক্ষিতে বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জানিয়েছেন, বাফুফে নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। বাফুফেকে নিয়ে তোলা তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এর আগে নির্বাচন নিয়ে বাফুফেকে জরুরী বার্তা পাঠায় বিশ্ব ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফা। যে চিঠিতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এজিএম ও নির্বাচন আয়োজন না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফিফার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের চিঠি পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে বাফুফে করোনাভাইরাসের এ পরিস্থিতির মধ্যেই নির্বাচন করতে চায়। তাই নির্বাচন সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটা যেন ফিফাকে অবহিত করা হয়।’ নতুন করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ার আগেই নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তাপ বেড়ে গেছে। অনেক পদে নির্বাচন হলেও মূলত সভাপতি পদ ঘিরেই থাকে সব উন্মাদনা। গত প্রায় আড়াই বছর ধরে শোনা যাচ্ছিল এবারের নির্বাচনে সভাপতি পদে কাজী মোঃ সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব তরফদার মোঃ রুহুল আমিন। কিন্তু গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি নিজেকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরিয়ে নেন। তরফদারের পিছুটানে সভাপতি পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি বাদল রায়। এ কারণে এখন পর্যন্ত সভাপতি পদে প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিন ও বাদল রায়। লম্বা সময় ধরে সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন বলে প্রচারণা চালালেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন তরফদার রুহুল আমিন। তবে তিনি অন্য পদে নির্বাচন করতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে। তাঁর এই সিদ্ধান্তের পর বাফুফে নির্বাচন নিয়ে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। এখন গুঞ্জন শুরু হয়েছে, বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন পুনরায় নির্বাচত হতে যাচ্ছেন কিংবা তাঁকেও সরে যেতে হতে পারে! সেক্ষেত্রে বাফুফে সভাপতি পদে নতুন মুখের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এবার ১৪৩ জন ভোটার। বাফুফের দফতরে জমা হওয়া কাউন্সিলর তালিকা পর্যবেক্ষণের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি আছে। বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এবং নির্বাহী কমিটির দুই সদস্য হারুনুর রশিদ ও আবদুর রহিমকে নিয়ে গঠিত এ কমিটি কাউন্সিলরের তালিকা দেখেশুনে চূড়ান্ত করবে। বাংলাদেশের ক্রীড়া ফেডারেশনের নির্বাচনগুলোয় কলকাঠি নাড়েন জেলা ও বিভাগের কাউন্সিলররা। ১৪৩ ভোটারের মধ্যে তাদের সংখ্যা ৭২ (৮ বিভাগ ও ৬৪ জেলা)। এরপর বেশি ভোটার ক্লাবের। এর মধ্যে প্রিমিয়ার, চ্যাম্পিয়নশিপ ও প্রথম বিভাগের ভোট ৩৯টি। এর বাইরে আছে দ্বিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগ লীগের ক্লাব। সবমিলিয়ে বাফুফে নির্বাচনের ১৪৩ ভোটারের মধ্যে আছে জেলা ৬৪, বিভাগ ৮, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের ক্লাব ১৩, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগের ক্লাব ১৩, প্রথম বিভাগ লীগের ক্লাব ১৩, দ্বিতীয় বিভাগ লীগের ক্লাব ১০, তৃতীয় বিভাগ লীগের ক্লাব ৮, ৫ শিক্ষা বোর্ড, ৬ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি করে মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, রেফারিজ এ্যাসোসিয়েশন ও কোচেস এ্যাসোসিয়েশন। এর বাইরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে একজন করে নন ভোটার কাউন্সিলর অংশ নেবেন বাফুফের এজিএমে। বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন। ২০০৮ সাল থেকে চার বছর মেয়াদী কমিটিতে টানা তিনবার সভাপতি হয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন দেশের কালজয়ী এই ফুটবলার। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি টানা চতুর্থবারের মতো প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। শুধু বাফুফে সভাপতি হিসেবে হ্যাটটিক নয়, সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সভাপতি হিসেবেও হ্যাটট্রিক করেছেন সালাউদ্দিন। বিতর্ক থাকলেও এবারের নির্বাচনেও সালাউদ্দিন সভাপতি পদে ফেবারিট বলে মনে করছেন অনেকে।
×