ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবার কি মানবজাতি মানবিক হবে?

প্রকাশিত: ০৮:০৮, ১৬ এপ্রিল ২০২০

এবার কি মানবজাতি মানবিক হবে?

সত্যই এবার এ প্রশ্নটি সবার মনে বার বার উদয় হচ্ছে যে, এই করোনাভাইরাসের প্রকোপ একদিন শেষ হবে। লকডাউনের ফলে সে কোণঠাসা হয়ে পরে ধ্বংস হবে অথবা নতুন টিকা, ওষুধ বা প্লাজমা কৌশল ব্যবহার করে মানুষ এই বিধ্বংসী ভাইরাসকে পরাজিত করবে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী লকডাউনের ফল উপার্জন ও চাকরিহীন মানুষ, স্তব্ধ হয়ে পড়া ব্যবসাবাণিজ্য যে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্যাভাবের মুখে সব দেশের সব জাতিকে ফেলবে, ফেলছে, তা থেকে মানবজাতি বের হয়ে আসতে পারবে, যদি সব দেশ যুদ্ধ-সহিংসতা বর্জন করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে একে অপরের প্রয়োজন পূরণে সর্বোচ্চ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ তথ্য তো সবার জানাÑ বিশ্ব ব্যবস্থা এখন একটি অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত। সে জন্য প্রত্যেকটি দেশ আরেকটি দেশের ওপর নানা প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য নির্ভরশীল। করোনা যদি শুধু উহানে, চীনে সীমিত থাকত, তাহলেও বাংলাদেশসহ অনেক দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হতো। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশই করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে মানুষের প্রাণ রক্ষাকে প্রথম কর্তব্য গণ্য করে সবরকম অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। ফলে কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, স্কুলসহ সবকিছুর কর্মকা- বন্ধ হয়ে গেছে। দেখছি মানুষ মানুষের জন্যÑ এমন ভাবনা থেকে অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান জীবিকা-আয়হীন মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। নিরাপত্তা বাহিনীও খাদ্য সাহায্যে সরকারের পাশে তৎপর হয়েছে। তাছাড়া বিদেশে শৃঙ্খলা মানা, স্বদেশে পদে পদে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা এই জাতিকে ঘরে রাখতে, জমায়েত তৈরি না করতে তারা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বও পালন করছে। তবে, এখনও বেসরকারী হাসপাতাল চিকিৎসকদের সরকারী হাসপাতাল ও সরকারী হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সদের পাশে ভাইরাসবিরোধী বা এর সংক্রমণ রোধে কোন তৎপরতাই দেখা যাচ্ছে না। এর একটাই কারণÑ সংক্রমণের ভয় ও মৃত্যু ভয়। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মধ্যে চিকিৎসক সেবা না দিয়ে চেম্বার বন্ধ রেখে ঘরে সাধারণ মানুষের মতো বসে থাকবেনÑ এটি মেনে নেয়া যায় না। কারণ, পুরো দেশের ষোলো কোটি মানুষকে প্রাণঘাতী ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করতে শুধুই সরকারী হাসপাতাল ও চিকিৎসক সেবা দিতে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করলেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন। এর পাশে, দু’একটি বেসরকারী হাসপাতাল করোনা রোগের চিকিৎসা সেবা দেবে শুনলাম। কিন্তু বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতেও যদি করোনা ইউনিট খুলে রোগ-পরীক্ষা, রোগের চিকিৎসা সেবা দেবার ব্যবস্থা রাখা হতো, তাহলে অনেক বেশি মানুষের দেহে রোগের পরীক্ষা করা সম্ভব হতো। ধরে নেয়া যায়, জ্বর-সর্দি-কাশির ৮০ ভাগ রোগী তিন –চার দিনে সেরে যায়, যারা বাড়িতে থেকে চিকিৎসকের নির্দেশে চিকিৎসা সেবা নিতে পারতেন। বিশ ভাগের হয়তো হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে, যার মধ্যে ৩ ভাগের মতো রোগীর ভেন্টিলেটর সেবা, অর্থাৎ আইসিইউ সেবা দরকার হবে। আমার তো মনে হয়, বেসরকারী হাসপাতালগুলো এতদিন ধনীদের, গ্রামের বড় ধনী কৃষকদের এবং প্রবাসী স্বচ্ছল পরিবারদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, অনেক অর্থ উপার্জন করেছেনÑ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসকরাও। এবার অন্তত জাতির এই মহাবিপর্যয়ের সময়, অনেকটা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজে নামার কথা ছিল, তাই নয় কি? গণস্বাস্থ্য নগর ও সাভার হাসপাতালে যেহেতু আমি নিজের, কাজের লোক, গাড়িচালকদের অনেকের চিকিৎসা করিয়েছি, সেজন্য বলতে পারি, এই একটি বেসরকারী হাসপাতাল অল্প মূল্যে সরকারী হাসপাতালের মতোই চিকিৎসাসেবা দেয়। অন্য কোন বেসরকারী হাসপাতালে আমি এত দরিদ্র নি¤œবিত্তের মানুষকে সেবা নিতে দেখিনি। এখানে যেসব রোগীর ভিড় দেখি, তাদের মতো নিম্নবিত্তের রোগীদেরই দেখতে পাই মেডিক্যাল কলেজে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে। উল্লেখ্য, একবার আমার কাজ থেকে অবসর নেয়া প্রাক্তন এক গৃহকর্মী গ্রাম থেকে তার অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য আমাকে ফোন করে। আমি ওকে আসতে বলি একজন কাউকে সঙ্গে নিয়ে। ও এলো ওর ছোট ভাই ও এক আত্মীয়াকে নিয়ে। প্রথমে নগর হাসপাতালে পাঠালাম, সম্ভবত ওকে বই করে দিয়েছিলাম। ওখানে ডাক্তার দেখে ওর অপারেশান দরকার বলে ওকে সাভারে চিকিৎসা নিতে ওরাই নিয়ে যাবে বলে জানায়। অপারেশনে চার হাজার টাকা ব্যয় হবে। তবে অন্য কিছু খরচ ওকে করতে হবে। আমি চার হাজার টাকা দিলাম। অন্য খরচ ওর আছে জানাল। এত সস্তায় এত ভাল চিকিৎসা একমাত্র সরকারী হাসপাতালেই হয় দেখেছি। চারদিন পর ও বাসে বাড়ি ফিরে গেল। আজ ৮/১০ বছর হয়ে গেছে, ও সুস্থ আছে! আমার মনে হয়, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের গবেষকরা যে পরীক্ষার কিট তৈরি করেছে, সেটি সারাদেশের হাসপাতালে-ক্লিনিকে বিতরণ করে এই রোগ পরীক্ষার সক্ষমতা নিজ দেশের উদ্ভাবিত কিট দিয়ে করা উচিত হবে। গণস্বাস্থ্য সাভার হাসপাতালকে একটি করোনা চিকিৎসা ইউনিট খুলতেও আহ্বান করা প্রয়োজন। অথবা, গণস্বাস্থ্য নিজেই উদ্যোগী হয়ে এ রোগের চিকিৎসায় এগিয়ে এসে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারে। এখনই টিভির খবরে জানলাম, দেরিতে হলেও বেসরকারী হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা শুরু করবে। করোনা উত্তরকালে জাতিতে জাতিতে দেশে দেশে সম্পর্ক আরও মানবিক হয়ে উঠবে এ আশায় আছে মানবজাতি। জানতে পারছি, ইতালির বহু রোগীকে জার্মানি, সুইজারল্যান্ডে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রকে না পাঠালে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে ভারতের কাছ থেকে অবশেষে ওষুধ আনতে পেরেছে। তাতে অবশ্য হতাশ হতে হয়। কিন্তু আমরা আমাদের যা আছে, তা দিয়ে আমরা ইতালি, যারা আমাদের গার্মেন্ট বাণিজ্যের সহযোগী, তাদেরকে পিপিই পাঠাতে পারি। আমাদের উদ্বৃত্ত খাদ্য, আলু, অন্য সবজি, ফল আমরা রাশিয়া, ইতালি, স্পেনসহ অনেক দেশে পাঠাতে পারি। বিনিময়ে আমাদের গার্মেন্ট পণ্যের বাজারটি রক্ষা করতে অনুরোধ করতে পারি। আশা করি, মধ্যপ্রাচ্যের মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশের শ্রমবাজার আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পাবে এবং কর্মহীন শ্রমিকরা জীবিকা ফিরে পাবে। তবে, দেশে দেশে যুদ্ধাবস্থা প্রশমিত করার মতো নেতৃত্বের উত্থান দরকার। বড় একটি মুসলিম তাবলীগ জামাত দল এই করোনার ভেতরেও জমায়েত হয়ে অকারণে দিল্লী, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে করোনা বিস্তারে ভূমিকা রাখল, যা শুধু লজ্জাজনক নয়, অজ্ঞতার পরিচায়ক। এখন তো আইএস, তালেবান, আল কায়েদা ইত্যাদি ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদের কাল শেষ হওয়া উচিত। নতুবা মানুষে মানুষে মৈত্রী, একতা, সাম্য কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? মানুষকে নতুনভাবে মানবজন্ম নিতে হবে। করোনা হয়তো এ বার্তাই দিচ্ছে। একটি বড় অভিনন্দন সরকারী চিকিৎসক ও নার্সদের প্রাপ্য। তাদের প্রায় সবাই জাতির বিপর্যয় কালকে কাটিয়ে ওঠার কাজে সম্মুখ যুদ্ধে নিয়োজিত থেকেছেন বিশাল মৃত্যুঝুঁকিকে পরাজিত করে। এবার ভিন্ন বিষয়ে একটু না বললেই নয়। খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিত করে ছয় মাসের জামিনে মুক্তিলাভ এবং তার পরপরই বঙ্গবন্ধুর খুনী, শেখ রাসেল হত্যাকারী, জেলে চার নেতা হত্যাকারী ক্যাপ্টেন (অব) মাজেদের দীর্ঘ চব্বিশ বছর পলাতক জীবন থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে ঢাকা শহরে স্ত্রীর বাড়িতে (সম্ভবত সেনা সদস্য হিসেবে প্রাপ্ত জমি) গ্রেফতার হওয়ার মধ্যে কি কোন যোগসূত্র নেই? জিয়ার মতোই তো খালেদা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার বন্ধ করা ইনডেমনিটি আইনটি বলবৎ রেখে খুনিদের ফ্রিডম পার্টি গঠনে সাহায্য করে সংসদে স্থান দিয়েছিলেন। তারা তো শুধু ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-আল বদরের পরম মিত্র নয়, তারা তো বঙ্গবন্ধুর খুনি, জেলহত্যার খুনি, ৭ নবেম্বরের মুক্তিযোদ্ধা হত্যার খুনিদের পরম বন্ধু! তা না হলে ২০০৪-এ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ এ শাহ কিবরিয়া হত্যা সংঘটিত করেছিল কারা? দশ ট্রাক অস্ত্র এনেছিল কারা? এরা দু’জন তো মাসতুতো ভাই-বোন। স্বার্থ ওদেরকে এক করে আরও কোন হত্যাকা- সংঘটিত করতে কাছে টেনে এনেছে কি? চির-ষড়যন্ত্র প্রেমী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী খালেদা-তারেক ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যে এখনও বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের ধ্বংসের লক্ষ্যে কাজ করছে না, তা বিশ্বাস করা কঠিন। সীমান্ত লকডাউনের মধ্যে কারা মাজেদকে সহজে দেশে প্রবেশ করতে দিল? তাদের পেছনে বড় শক্তি কারাÑ এসব সত্য উদঘাটন করোনা নিরোধের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকারকে সদাসতর্ক হতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×