ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠা ভাল উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা প্রতিষ্ঠা ভাল উদ্যোগ

বার বার আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নের উপায় বের করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। তবু যাকে বলে মানসম্মত শিক্ষা তার কাছাকাছি আমরা পৌঁছাতে পারিনি। এর মোটা দাগের কারণগুলো সবার, বিশেষত নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই জানা। তবু আরেকবার মনে করা যেতে পারে- প্রথমত, আমাদের বিশাল জনসংখ্যা, যেটি যে কোন উন্নয়নের ফলকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলে। এখনও আমরা শূন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অর্জন করতে সক্ষম হইনি। বঙ্গবন্ধুর আমলে, এমনকি পাকিস্তান আমলের শেষে প্রায় সব উচ্চ শিক্ষিত নারী, পুরুষ, ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ নীতি অনুসরণ করে দুই সন্তানের বেশি সন্তান গ্রহণ করিনি। অর্থাৎ বাবা, মা দু’জন যখন দু’সন্তান রেখে মারা যান, তখনি শূন্য জন্ম হার গণ্য করা হয়। অর্থাৎ মা-বাবার দুটি শূন্যস্থান দুটি সন্তান পূরণ করবে। দুঃখজনক যে, খালেদার বিএনপি-জামায়াত আমল জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমই বন্ধ করে দিয়ে ছোট দেশকে জনসংখ্যার বিপুল ভার দিয়ে এদেশের সব রকম উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। ’৯৬-এ শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে আবার নতুন করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম প্রবর্তন করেছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নতুনভাবে কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে পরিচালনা করা শুরু হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্য করণীয়Ñ খাদ্য, বসত, স্কুল, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকাসহ সব রকম কর্মসূচীর সফলতার জন্য। একটি বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীপূর্ণ ক্লাসে একজন শিক্ষকের পক্ষে মানসম্পন্ন পাঠদান করা কতটা কষ্টসাধ্য ও অসম্ভব হয়ে ওঠে তা আমরা যে কেউ বুঝতে পারি। ততটাই বিদেশের সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীর শ্রেণীকক্ষে সফলভাবে পাঠ দান সহজসাধ্য এবং সম্ভব হয়। এটা কোন ম্যাজিক নয়, বাস্তবতা মাত্র। দ্বিতীয়ত, দরিদ্র ও নিরক্ষর পিতা-মাতার লাখ লাখ অসুবিধাগ্রস্ত শিক্ষার্থীর জন্য পাঠে বেশি সময় ধরে ভাষা ও গণিতের মৌলিক দক্ষতাগুলো চর্চা করার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের অভাব রয়েছে। যা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষকের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে এরা, যারা বাড়িতে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাবা, মা ও টিউটরের সাহায্য পায় না বলে শিক্ষিতের সন্তানেরা শিক্ষিত বাবা, মা ও বাসায় কোচিংয়ের যে সাহায্য পায়, তার ফলে অসুবিধাগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা তাদের থেকে শিক্ষার মানে অনেক পিছিয়ে পড়ে। যেটি পূরণ করতে তাদের অনেকের বাবা, মা নিজেদের কষ্টের অর্থ ব্যয় করে সন্তানদের কোচিংয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কম টাকায় ভাল মানের উচ্চ মূল্যের কোচিং বা টিউটরিংয়ের অভাব থেকেই যায়। ফলে এই দুই শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মানের ক্ষেত্রে বিশাল বৈষম্য তৈরি হয়েছে! এটি দূর করার অনেক রকম পন্থা আমি অনেক কলামে, সেমিনারে উপস্থাপন করেছি। যা কোন প্রাথমিক স্কুলেও বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানতে পারিনি। গরিবের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এসডিজি বা জাতির স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও শিক্ষা বৈষম্য হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। হবে না, এটা কমন সেন্স। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের শিক্ষার মান কাক্সিক্ষত না হওয়ার পেছনে ওপরে বলা কারণ দুটো প্রধান ভূমিকা রাখে। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দরিদ্র, নিরক্ষর পরিবারের সন্তান। যারা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভিড়ে কতটা মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এতে তাদের নিজেদের কোন দোষ নেই। তা ছাড়া, শিক্ষার যে দুর্বলতা নিয়ে তারা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা সেই দুর্বলতা পূরণ করে তাদের মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষা দিতে। বিশেষ করে মফস্বলের বেশির ভাগ স্কুলের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষকরা দুর্বল থাকে। অথচ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর কিন্তু প্রধানত প্রাথমিক শিক্ষকের সরবরাহকারী! কারণ, এরপর, এইচএসসির দুই বছরের শিখন স্তরে দুর্বলতা বা ঘাটতি আর পূরণ করা সম্ভব হয় না। স্কুলের, শিক্ষকের আন্তরিকতা, আচার-আচরণ, ভৌত কাঠামো ইত্যাদির প্রশ্ন বাদ দিয়েই উপরোক্ত কথাগুলো বলছি। এখন, টিভিতে দেখলাম বিদেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটির শাখা ক্যাম্পাস দেশে স্থাপনের একটি ভাল উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এটা তো জানা কথা যে, প্রতিবছর আমাদের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেও মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রায় অর্ধ লাখের বেশি ছেলেমেয়ে আন্ডার-গ্রাজুয়েট শিক্ষা গ্রহণ করতে বিদেশের বিশ্বব্যিালয়গুলোতে ভর্তি হচ্ছে। এ ছাড়া মাস্টার্স ও পিএইচডি করতেও অনেক শিক্ষার্থী বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, দেশের শিক্ষার মান সন্তোষজনক না হওয়া। যার ফলে মেধাবী ছেলেমেয়েরা, যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে, ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেলে ভাল বা মাঝারি ফল করেছে, তারা দেশের শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। উপরন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কাজ করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পক্ষে শিক্ষার্থীর মধ্যে জমা হওয়া শিখন ঘাটতি বা দুর্বলতা পূরণের কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকে না। আমার জানা নেই- বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থীকে আমরা মেধাবী হিসেবে জানি, তারা পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে কেমন ফল করছে। কারণ, প্রায় বছর পনেরো আগে একবার একজন শিক্ষক সদস্যের অনুরোধে আমি পিএসসির ভাইভা বোর্ডের সদস্য হয়ে কাজ করেছিলাম। আমার সেই অভিজ্ঞতা আমাকে এতটা আশাহত করেছিল যে, আমি ভবিষ্যতে আর সদস্য না থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। সেবারে আমাদের সামনে যেসব শিক্ষার্থী ভাইভা দিয়েছিল তাদের র‌্যাঙ্কিং করে দেখেছি শিক্ষার মানে প্রথম- ঢাবি, দ্বিতীয়- চট্টগ্রাম বি., তৃতীয় রাজশাহী বি., চতুর্থ- জাহাঙ্গীরনগর বি.। এটি মাত্র একটি ব্যাচের সম্ভবত ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থীর ওপর আমার পর্যবেক্ষণ। তবে সার্বিকভাবে খুব ভাল এমন শিক্ষার্থী দেখিনি বললেই সঠিক বলা হয়। পেয়েছি মাঝারি ও নি¤œ মাঝারি মানের শিক্ষার্থীদের। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পাসের হার জনগণকে জানিয়ে দেয়, আমাদের শিক্ষার মান কোথায় অবস্থান করছে। শতকরা যদি ১২-১৫% পার্সেন্ট পাস করে তাহলে তারা গোল্ডেন এ পেলেও তাদের শিক্ষার মান সন্তোষজনক হয়নি বলেই গণ্য করতে হয়। আমার শারণা বিদেশী নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ শিক্ষা প্রদান করবে। তারা মাধ্যমিক স্তরের ভাষা, গণিত, বিজ্ঞানের দক্ষতাগুলো শেখাবে না। তবে, তারা এলে হয়ত বিদেশী মুদ্রায় বিদেশে পড়ার হার একটু কমে আসবে। একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবেÑ বিদেশে সর্বক্ষণিক ইংরেজি ভাষার আবহে বসবাস করার একটি ইতিবাচক ফল শিক্ষার্থীরা লাভ করে। ইংরেজী ভাষার দক্ষতায় তারা যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে। সে আবহ দেশে অনুপস্থিত। এমনকি ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানেও ইংরেজী ভাষার শিক্ষার মান অনেক উন্নত। ফলে এসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় অনেক বেশি ভাল করে। এর কারণ সম্ভবত ভারত, পাকিস্তানে বহুভাষী প্রদেশবাসীর মধ্যে ইংরেজী যোগসূত্র স্থাপনকারী ভাষা। শ্রীলঙ্কায় শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উচ্চমানের, ইংরেজীও খুব উচ্চমানের। বিপরীতে আমাদের দেশে ভাষা একটিই, বাংলা। ইংরেজী স্কুলের বইতেই সীমিত। ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে বাংলা-ইংরেজীতে কথা বলা হয়, শ্রেণীকক্ষে অবশ্য ইংরেজীতেই কথা বলা হয়। সেখানে ইংরেজীর মান সাধারণত স্কুল থেকে উচ্চ মানের। বলা বাহুল্য, ভাষার সাহায্যেই সব বিষয়ের শিক্ষা দান ও গ্রহণ করা হয়। সে জন্য ভাষার মান সব বিষয় ভালভাবে শেখার একটি পূর্বশর্ত। তা ছাড়াও, মাতৃভাষা যে যত ভালভাবে রপ্ত করতে পারে সে শিক্ষার্থী তত ভালভাবে বিদেশী ভাষাও শিখতে পারে। কারণ ভাষার দক্ষতা সব ভাষাতেই একই। তাই মাতৃভাষার দক্ষতা অর্জনের মান অন্য ভাষা শেখার সময় শিক্ষার্থীকে সহায়তা করে। ফলে সে ভাল মানের বাংলা জানলে ভাল মানের ইংরেজী ভাষাও শিখতে পারে। একটা বিষয়ে আমার কৌতূহল রয়েছে। বিদেশে আমাদের দেশের পাবলিক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উচ্চ শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করেছেন। তারা ওইসব খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত শিক্ষা কার্যক্রম, কারিকুলাম, গবেষণা, শিক্ষার উন্নত মান অর্জনের লক্ষ্যে সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অনুসরণ করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন করেন না কেন? অন্য একটা বিষয়ও আমি দীর্ঘদিন যাবত লক্ষ্য করেছি। যেমন, সেন্ট জোসেফ, সেন্ট গ্রেগরি, হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের প্রডাক্টরদের ইংরেজী ভাষার ব্যবহারে বেশ পার্থক্য আছে! হয়ত, যে বিশপ বা সিস্টাররা যেমন ইংরেজী শিখেছেন, সেটা দেশ ও ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন, যার প্রভাব উক্ত স্কুলগুলোতে পার্থক্য তৈরি করেছে। এটা দেখেছি যে, সুইডেন, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসের নাগরিকের ইংরেজী ইংল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের ব্যবহার করা ইংরেজী থেকে আলাদা। তবে আমাদের দেশে কারিকুলামে কাজ করার সময় থেকে আজ অবধি দেখছি ইংরেজী শেখানোর জন্য কত রকম পদ্ধতি, প্রক্রিয়া বিদেশী সাধারণত ব্রিটিশ কনসালটেন্টদের হাতে ব্যবহৃত হয়েছে! ফলÑ একই রকম ঘাটতিপূর্ণ শিক্ষা বছরের বছর রয়ে গেছে, কোন উন্নতি দেখি না। আমার বিশ্বাস, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজী তাদের চাইতে যাদের, যেমন সুইডেন, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ইংরেজী ভাষাকে বিদেশী ভাষা হিসেবে আমাদের মতো শেখে তাদেরই ইংরেজী শেখানোর উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া উচিত। তারাই ইংরেজী শিক্ষার ভাল পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাল পাঠ্যবই তৈরি করতে পারবে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ক্যাম্পাসের শিক্ষকরা শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে বাঙালী শিক্ষার্থীদের পাবে, তারা তেমন মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনি। তাহলে তাদের কিভাবে বিদেশী শিক্ষকরা উচ্চ মানের শিক্ষা দিতে সক্ষম হবেন? সম্ভবত ইংরেজী মাধ্যমের উচ্চবিত্তের যেসব সন্তান বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, তারাই এই শাখা ক্যাম্পাসে উচ্চ মানের শিক্ষা লাভের আশায় এখানে ভর্তি হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×