ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খুররম মমতাজ

স্মৃতির নদী ও ইনকা উপকথা

প্রকাশিত: ১২:২২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

স্মৃতির নদী ও ইনকা উপকথা

হিমালয়ের নদীগুলো যায় দক্ষিণের সমুদ্রে। আর আমার স্মৃতির নদী যায় উল্টোমুখে, অতীতের দিকে। সেই নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে আমিও যাই উজানে ইলিশ মাছের মতো। যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছাই বহুদূরেÑ কাস্পিয়ান সাগরের তীরে, রুশ ভাষা শেখার দিনগুলোতে। সেখানে সাগর পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ী শহর। শহরের নাম বাকু। সেই শহরে রুশ ভাষার পাশাপাশি আমাদের ইতিহাস পড়ান একজন শিক্ষক। সেদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলেন তিনি। সেই ইতিহাস ভুলে গেছি বহুদিন আগে, তাদের ঐতিহ্যের কথাও আর মনে নেই তেমন, কিন্তু পড়াতেন যে শিক্ষক কিরিল, তাকে ভুলতে পারিনি। তাঁর পুরো নাম কনস্তানতিন ইগোরোভিচ কিরিল, তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আহত যোদ্ধা। তাঁর মুখের একটা পাশ ছিল বোমার আঘাতে ঝলসানো, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতেন তিনি। মাঝে মাঝে আমাদের শহরে নিয়ে যেতেন কিরিল। একবার নিয়ে গেলেন একটা ভাস্কর্যের সামনে। ভাস্কর্যের নাম- ‘বাকুর ছাব্বিশজন শহীদ’। দেয়ালের গায়ে কালো পাথরের ম্যুরাল, তাতে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মূর্তি। কেউ কেউ গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, বাকিরা অপেক্ষা করছে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে। একদম বাঁয়ে একজনÑ সে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও হাত তুলে কিছু একটা স্লোগান দিচ্ছে। দেখে আমার মনে পড়ে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় স্লোগান- জ...য় বাংলা! কিরিলের ক্লাসও ছিল অন্যরকম, খুব আকর্ষণীয়। প্রায়ই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে নিতেন ক্লাসের সামনে, বোর্ডের কাছে। তারা নিজ নিজ দেশের ইতিহাস-ভূগোল-ঐতিহ্য যা খুশি নিয়ে কথা বলতে পারতো। সেভাবেই প্রস্তুত হয়ে আসতো সবাই। ভিয়েতনামি ছেলেরা বলতো তাদের দেশে টনকে টন বোমা ফেলেছিল আমেরিকানরা, নাপাম বোমা। সেই বোমার আগুনে জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের দেশ। তবুও মাটির টানেল থেকে গভীর রাতে বেরিয়ে আসতো ভিয়েতকং যোদ্ধারা, প্রতিশোধের আগুন জ্বলতো তাদের বুকেÑ তারা জীবন দিতো অকাতরে আর জীবন নিতো দখলদার আমেরিকান সৈন্যদের। এসব কথা বলতো ভিয়েতনামি ছাত্ররা গর্বের সঙ্গে। কিউবার অস্কার বলতো ফিদেল ক্যাস্ত্রো আর চে গ্যেভারার বন্ধুত্বের কথাÑ সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ের বন্ধুত্ব। সবই ভাঙা ভাঙা রুশ ভাষায়। তবু বুঝতে আমাদের কারোই কোনো অসুবিধা হতো না। পেরুর মেয়ে তানুশকা সবার চেয়ে ভালো রুশ বলতো। সে বলতো ইনকা রাজাদের কথা। ইনকা রাজা তুপাক আমারু যুদ্ধ করেছিল স্প্যানিশ কনকুইস্তাদরদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেন রাজা। রাজার চার হাত-পায়ের সঙ্গে দড়ি দিয়ে জুড়ে দেয়া হলো চারটা শক্তিশালী ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়ে বসলো অশ্বারোহী স্প্যানিশ সৈন্য। তারপর ঘোড়াগুলো ছুটিয়ে দিলো তারা। খ--বিখ- হয়ে গেল ইনকা রাজার শরীর। সারা ক্লাস স্তব্ধ নীরবতায় শুনেছিল সেদিন ভয়ঙ্কর গল্পটা, দেখেছিল রাগে দুঃখে রক্তিম হয়ে গেছে তানুশকার বাদামি মুখ। ধীরে ধীরে ও নিজের সিটে গিয়ে বসলো। আমারও সুযোগ এলো একদিন। আমি বললাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা। কতটুকুই বা ভাষা জানি তখন! তবু নিজের চোখে দেখা পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে চেষ্টা করলাম আমি। বললাম- ভিয়েতকংদের মতো, কিউবার পাহাড়ে বিপ্লবীদের মতো বাংলাদেশের মানুষও মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং জয়ী হয়েছে। বক্তার কথা বলা শেষ হলে কিরিল সবসময় ক্রাচ ঠকঠক করে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করতেন, ধন্যবাদ দিতেন ছাত্র-ছাত্রীকে। আমার সঙ্গেও হাত মেলালেন, ধন্যবাদ দিলেন, তারপর বললেন, ‘কিন্তু তোমরা তোমাদের নেতাকে মেরে ফেললে!’ মাত্র কিছুদিন আগে ঘটে গেছে সেই মর্মান্তিক ঘটনা। তখনো দগদগে ক্ষতের মতো হয়ে আছে তা আমাদের মনে। কিরিলের আক্ষেপ তাই কঠিন অভিযোগের মতো শোনালো আমার কানে। আমি বললাম, ‘আমরা মারিনি। মেরেছে পরাজিত শত্রু।’ ‘তার মানে শত্রু আবার শক্তিশালী হয়ে গেছে তোমার দেশে,’ কিরিল বললেন, ‘এখন কী হবে?’ ‘তা তো জানি না কনস্তানতিন ইগোরোভিচ,’ আমি বললাম। ‘তবে, এদেরও একদিন হারাবো আমরা, আপনি দেখবেন।’ পেরুর মেয়েটার আসল নাম রিয়া। ভালো রুশ জানে বলে রুশ ভাষার শিক্ষক মীরা হাসানোভনা ওকে খুব ভালোবাসেন। প্রায়ই ক্লাসে সামনের দিকে ওর ডাক পড়ে। একদিন মীরা বললেন তেত্রিশ নম্বর পৃষ্ঠা খোলো সবাই। আমরা পৃষ্ঠা খুললাম। মীরা বললেন দুই বন্ধুর ডায়ালগ আছে দেখো। দু’জন আসো এখানে। দুই বন্ধুর একজন ছেলে, একজন মেয়ে। প্রথমেই রিয়ার ডাক পড়লো। ছেলে কে যাবেÑ মীরা খুঁজছেন, আমি মাথাটা একটু নিচু করে আছি। কিন্তু পড়বি পড় মালির ঘাড়েÑ মীরা বললেন তুমি লুকাচ্ছো কেন মমতাজ? তুমি আসো। বইতে যে ডায়ালগ আছে, সেখানে মেয়েটার নাম তানিয়া ছেলের নাম সেরগেই। রাশানরা নামদুটো বদলে নিয়ে ডাকে তানুশকা আর সিরিয়োজা। তানুশকা আর সিরিয়োজার মধ্যে হোস্টেলে দেখা হয়েছে রান্নাঘরের সামনে। দু’জনের মধ্যে কথা হচ্ছে- ‘প্রিভেত তানুশকা, কেমন আছো?’ ‘প্রিভেত সিরিয়োজা ভালো আছি। তোমার হাতে হাঁড়ি দেখছি, কী রাঁধবে?’ ‘আলু ভাজি আর সসেজ।’ ‘বাহ্ চমৎকার! তুমি বুঝি ভালো রাঁধতে পারো?’ ‘পারি মোটামুটি। আসো না, টেস্ট করে দেখো।’ ‘আজকে না সিরিয়োজা। আমার ক্লাসটেস্ট আছে আগামীকাল।’ ‘ঠিক আছে তানুশকা। সিনেমা হলে একটা ভালো মুভি চলছে, যাবে নাকি উইক এন্ডে?’ ‘কী মুভি?’ এরপর ওরা মুভি নিয়ে কথা বলতে লাগলো এবং সপ্তাহের শেষে মুভি দেখতে গেলো। এসবই সিরিয়োজা আর তানুশকা ডায়ালগের মধ্যে দিয়ে দেখালো। বাস্তবে তানুশকার সঙ্গে মুভি দেখার সুযোগ আমার হয়নি, তবে ওর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। আর সেদিন থেকে ক্লাসের সবার কাছে রিয়া হয়ে গেল তানুশকা। পরীক্ষা এসে গেল। ভালোই দিলাম, রেজাল্টও হয়ে গেল। এবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষার পালাÑ কে কোথায় যাবে, পছন্দমতো শহরে পড়তে যেতে পারবে কিনা। পৃথিবীর অনেক দেশের ছেলেমেয়ে এখানে, আবেদনকারী অনেক। মীরা জানতে চেয়েছিলেন কে কোন শহরে যেতে চায়। অধিকাংশই বললো মস্কো যাবে, বাঙালী ছাত্রদেরও প্রথম পছন্দ মস্কো। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম লেনিনগ্রাদ যেতে চাই। মীরা অবাক হলেন, জিজ্ঞেস করলেন লেনিনগ্রাদ! কেন বলো তো? আমি তাকে বহুদিনের ইচ্ছেটার কথা বললাম, দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের কথা বললাম। বুঝিয়ে বললাম যে, দেশে থাকতে এই রুশ সাহিত্যিকের উপন্যাস পড়ে আমার ইচ্ছে হয়েছে লেনিনগ্রাদে লেখাপড়া করবো। সেজন্যই আমি রাশিয়ায় এসেছি। মীরা অবাক হলেন, খুশিও হলেন। ভাষা শেখার কোর্স শেষ। এই উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান হলো ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে। মঞ্চে বসে আছেন ইনস্টিটিউটের হোমরা-চোমরা ব্যক্তিরা। ভিসি, কয়েকজন ডিন, রেজিস্ট্রার... তাদের মধ্যে কনস্তানতিন কিরিলকেও দেখলাম। ক্লাসে যেমন স্যুট-কোট-টাই পরে আসেন, আজকেও তাই পরেছেন। তবে আজকে বিশেষ দিন, তাই কোটের উপরে তার বুকের কাছে খুদে খুদে কয়েকটা ক্রেস্ট লাগানোÑ যুদ্ধে তার বীরত্বের স্বীকৃতি। বক্তৃতার সময় কিরিল সেই ঘটনাটা বর্ণনা করলেন, যে ঘটনায় তিনি তার পা হারিয়েছেন। যে ঘটনায় তার মুখের ডান পাশ ঝলসে গেছে। কিরিল বললেনÑ এই ঘটনায় বীরত্ব তেমন নেই, কেননা সেই সময় তার বয়সি সবাই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। আহতও হয়েছিল অনেকে, তিনি ভাগ্যবান, ফিরে আসতে পেরেছেন যুদ্ধ থেকে। অনেকেই ফেরে নাই। যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল বাইশ বছর। নানা ফ্রন্টে পোস্টিংয়ের পর তাকে পাঠানো হয়েছিল স্তালিনগ্রাদে। সেখানে তখন লড়াই চলছিল মরণপন। দুইপক্ষই মরিয়া। দুইপক্ষই জানে এখানে স্থির হবে মহাযুদ্ধের জয়-পরাজয়, এই স্তালিনগ্রাদে। সময়ের হিসাব তখন চলছে মানুষের জীবন গুনে গুনে। ঘন্টায় কত প্রাণ গেল, কত সৈন্য হতাহত হলো। আক্রমণ তীব্র করেছে জার্মানরা। নদীর এপারে-ওপারে যুদ্ধ হচ্ছে। শহরের মধ্যেও লড়াই চলছেÑ প্রতিটা দালান, কারখানা আর রাস্তা দখলের তীব্র, মরণপন মুখোমুখি লড়াই। ভোলগা নদীর এদিক দিয়ে শত্রু এখনও পার হতে পারেনি। তাদের আটকে রাখার দায়িত্বে আছে কয়েকটি দল, পাশাপাশি লড়ছে তারা, এদের মধ্যে কিরিলের দলও আছে। ওপার থেকে আসছে গোলাগুলি, ওরা নদী পার হতে চায়। এপারে যদি চলে আসতে পারে, তাহলে পরাজয় নিশ্চিত। তাই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছে সোভিয়েত বাহিনী। তাদের উপর হুকুম আছেÑ এক পা-ও পেছানো যাবে না, শত্রুকে ঠেকাতেই হবে, যে কোন মূল্যে। ট্রেঞ্চে ছিল লেফটেন্যান্ট কিরিল। প্রায় মিনিট কুড়ি একনাগাড়ে গুলি বিনিময়ের পর কিরিল দেখলো ওদিক থেকে উড়ে আসছে পাঁচ-ছ’টা লুফৎওয়াফে বোমারু বিমান। একটা সামনে, বাকিগুলো দু’পাশে একটু পেছনে, তীরের ফলার মতো। বিন্দু থেকে দ্রুত বড় হয়ে গেল ওগুলো। সোভিয়েত এ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্ট কামান গর্জে উঠলো এপাশে একসঙ্গে অনেকগুলোÑ কামান চালাচ্ছে স্তালিনগ্রাদের মেয়েরা। তার মধ্যেই টপাটপ বোমা ফেলতে লাগলো জার্মান পাইলট। চারপাশে শিলাবৃষ্টির মতো বোম পড়ছে। একটা করে পড়ে, আর প্রচ- বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পায়ের তলার মাটি। সরাসরি কিরিলের ট্রেঞ্চে পড়লো একটা বোমা। কাদামাটির সঙ্গে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়তে পড়তে মানুষের চিৎকার আর গোঙানি কানে এলো তার। কাদার ভেতর থেকে উঠবার সময় সে টের পেল চিৎকার আর গোঙানি আসলে তার নিজেরই। এরপর জ্ঞান হারালো কিরিল। যুদ্ধ শেষে তিনি শিক্ষক হলেন। এতদিন কিরিল শুনেছেন ছাত্র-ছাত্রীদের গল্প। আজকে তারা শুনলো শিক্ষকের গল্পটা। গল্প শেষে মঞ্চের উপর ঠকঠক শব্দ তুলে কিরিল তার আসনে ফিরে গেলেন। অনুষ্ঠান শেষে পানাহার আর নাচ-গান চললো অনেক রাত পর্যন্ত। নাচ জানি না, তাতে কী, উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে নাচতে চাইলে নাচ জানতে হয় না, শুধু ইচ্ছা থাকলেই হয়। আমি আর সালাউদ্দিন উঁকি দিলাম ফ্লোরে। সালাউদ্দিন স্মার্ট খুব। সে আজারবাইজানি এক মেয়েকে গিয়ে ডেকে নিলো। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি এখান থেকে পালাবো কিনা। এমন সময় তানুশকাকে পেয়ে গেলাম হঠাৎ। ওর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমার, ও আমাকে কয়েকটা স্প্যানিশ শব্দও শিখিয়েছে। আমি বললাম, ‘কমাস তাস, আমিগো?’ তানুশকা জবাব দিলো, ‘ভালো আছি আমিগো। নাচছো না কেন?’ ‘নাচ তো পারি না তানুশকা।’ ‘কেউ পারে না, আসো।’ তানুশকাও নাচতে পারে না। আমি তো পারিই না, কাজেই কোন অসুবিধা হলো না। প্রচ- শব্দ নাচের আসরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়। সেভাবেই কথা বলতে লাগলো তানুশকা। ‘গতকাল মীরার ওখানে খুব মজা হয়েছে, তাই না?’ ‘হ্যাঁ সত্যি, খুব মজা হয়েছে।’ ‘তাহিরার বরটা খুব গল্প করতে পারে।’ তানুশকা বললো, ‘বেচারা তাহিরা! বরের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল, আর সারাক্ষণ শুধু বলছিলÑ অ্যাই তুমি থামবে, অ্যাই তুমি থামবে...!’ আমরা হাসতে লাগলাম গতকালের কথা মনে করে। গতকাল বিকেলে মীরা আমাদের ডেকেছিলেন তার বাসায়। ছোট্ট সুন্দর ফ্ল্যাট মীরার, ক্যাম্পসের কাছেই। আমরা কয়েকজন বাঙালী ছাত্র, সঙ্গে তানুশকা আর মেক্সিকোর অস্কার। মীরা আমাদের বাসায় তৈরি কেক আর চা খাওয়ালেন। মীরার ছোটবোন তাহিরা আর তার স্বামীও ছিল সেখানে। বোনটা একদমই চুপচাপ আর লাজুক ধরনের। স্বামীটা কথা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল আজারবাইজানি যুবকরা খুব প্রাণবন্ত আর কৌতুকপ্রিয় হয়Ñ একের পর এক কৌতুক বলছিল ইয়াকুব। হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যথা। এবার নিজের বউয়ের পিছে লাগলো সেÑ ‘আমার বউকে দেখে খুব চুপচাপ আর শান্ত মনে হয়,’ ইয়াকুব আমাদের বললো, ‘কিন্তু জানো ওর কথায় লেফট-রাইট করি আমি? সারাক্ষণ আমাকে ধমকায়Ñ মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যেও লাফ দিয়ে উঠিÑ একবার চা খাচ্ছি, ওর ধমক শুনে চমকে উঠে আমার ঠোঁটই পুড়ে গেল। তারপর তো বউকে আর চুমু খেতে পারি না...’ তখনই চা ঢালতে ঢালতে লাজুক তাহিরা বলেছিলÑ এ্যাই তুমি থামবে...! সেই কথা মনে করে আমরা হাসতে লাগলাম। একটু পরে তানুশকা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাদের যাওয়া কখন?’ আমি বললাম, ‘আগামীকাল। তুমি আমাকে ইনকা উপকথা শোনাবে বলেছিলে, তানুশকা।’ ‘এখন শুনবে? চলো বাইরে যাই।’ বাইরে বাগানে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম আমরা। তানুশকা বাকুতেই থেকে যাবে। জিওলোজি পড়বে। চারজন বাঙালী ছেলে নাম লিখিয়েছে ছাত্রদের একটা দলে। এই দলটা যাবে সামার জব করতে। এই দলে আমিও আছি। সালাউদ্দিন, আমি, সেলিম আর আজিম। আজিম কাজ শেষে বাকুতে ফিরে আসবে। সেলিম যাবে মস্কো। আমি আর সালাউদ্দিন যাব লেনিনগ্রাদে। আগামীকাল দলটা যাত্রা করবে। মীরা আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। পাঁচ বছর থাকবো আমি লেনিনগ্রাদে, আমার স্বপ্নের শহরে। সেখানে পড়বো জিওফিজিক্স। এই বিষয়টাও আমার পছন্দ। জিওফিজিক্স পড়লে তেল অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে কাজ করতে পারবো, তাঁবুতে থাকতে পারবো খোলা আকাশের নিচে। বেশ এ্যাডভেঞ্চার হবে। এ্যাডভেঞ্চার আমার পছন্দ। এ্যাডভেঞ্চার তানুশকারও পছন্দ, তাই সে জিওলোজি পড়বে। এইসব গল্প হচ্ছিল তানুশকার সঙ্গে। একসময় আমি বললাম, ‘তোমার সেই উপকথাটা শোনাও তানুশকা।’ ...আন্দিজ পাহাড়ে ছিল লারিস নামে এক গ্রাম। সেখানে বাস করতো এক রাখাল আর তার মা। তাদের ছিল কয়েকটা লামা। উপত্যকা যখন সবুজে ছেয়ে যেত, পাহাড় থেকে লামাগুলো নিয়ে নিচে নেমে আসতো রাখাল আকোয়ানাপা। সারাদিন লামা চরাতো সে আর বাঁশি বাজাতো। ওই পথে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল সূর্যের মেয়ে সুকি। রাখালের বাঁশি শুনে সে মুগ্ধ হয়ে নেমে এলো। দুজনের পরিচয় হলো, ভাব হলো। বাড়ি ফিরে রাতে আর ঘুমাতে পারে না সুকি। শুধু ভাবে রাখালের কথা। বুঝতে পারে রাখালকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু তার এই ভালোবাসার কোন দাম নেই। কেননা তার বাবা সূর্য এটা মেনে নেবেন না, সুকি জানে। বিষণœ মনে সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো স্বর্গের পাখি চেকোলো এসেছে তার কাছে, জিজ্ঞেস করছে, তুমি এত বিষণœ কেন সুকি? সুকি তাকে সব কথা বললো। পাখি বললো, আগামীকাল তুমি ঝর্ণার কাছে যাবে, ঝর্ণাকে গান শোনাবে। ঝর্ণাও যদি তোমাকে গান শোনায়, তাহলে জানবে তোমার আর রাখালের মিলন হবে...। প্রাচীন ইনকা উপকথা বলে চলেছে তানুশকা। চারপাশে বাকুর গ্রীষ্মকাল, কাস্পিয়ানের দিক থেকে হুহু হাওয়া আসছে। বার্চ গাছের পাতাগুলো অল্প অল্প দুলছে হাওয়ায়। ভেসে আসছে নাচের আসরের শব্দÑ সেই শব্দ যেন তানুশকার গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে বাজছে। এই মিউজিক যেন আজকের সন্ধ্যার নাচঘরের নয়, যেন দূর বহুদূর অতীত থেকে ভেসে আসছে এই অপার্থিব মিউজিক। ...পরদিন ঝর্ণার কাছে গিয়ে ঝর্ণাকে গান শোনালো সুকি। একটু পরে ঝর্ণাও গান গেয়ে উঠলো। সেদিন রাতে চুপিসারে প্রাসাদ থেকে পালালো সুকি। এসে হাজির হলো রাখালের কুঁড়েঘরে। রাখাল তাকে দেখে অবাক আর খুব খুশি। সে-ও তো মনে মনে সুকির কথা ভেবেছে এই ক’দিন। সুকি জানে তার পিছে পিছে আসবে প্রাসাদের গার্ড আর রাজার প্রহরী। তাকে ধরে নিয়ে যাবে, আর আকোয়ানাপার গর্দান যাবে সূর্যের মেয়েকে ভালোবাসার অপরাধে। দুজনে ঠিক করলো পালিয়ে যাবে। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলো আকোয়ানাপা। এদিকে ভোর হয়ে গেছে। রাজকন্যা পালিয়েছে টের পেয়ে খুঁজতে বের হয়েছে রাজার প্রহরীরা। কাছে চলে এসেছে তারা, ক্রমশ এগিয়ে আসছে তাদের ঘোড়ার খুরের খটাখট শব্দ। কুঁড়েঘর ছেড়ে জঙ্গলের পথ ধরলো সুকি আর আকোয়ানাপা। ছুটতে লাগলো দুজনে। ছুটতে ছুটতে সুকির জুতোর ফিতে গেল ছিঁড়ে। জুতোটা হাতে নিয়ে ছুটলো সুকি। কিন্তু ঘোড়সওয়ার প্রহরীরাও এসে গেছে পিছে পিছে। একেবারে পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে সুকি আর আকোয়ানাপা। পেছনে ঘোড়সওয়ার। আর উপায় নেই...। আমার দিকে পাশ ফিরে গল্প বলছিল তানুশকা। ওর মুখের অর্ধেকটায় আলো অর্ধেকটায় ছায়া। সুন্দর মুখটাকে ফ্রেমে ধরে আছে কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা ঘন কালো চুল। ওদিকে জোড়ায় জোড়ায় ছেলে-মেয়েদের বেরোতে দেখা যাচ্ছে হলঘর থেকে। দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে তারা। কাঁচ ভাঙার মতো তীক্ষè হাসির শব্দ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। গল্প বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেছে তানুশকা। কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টি ওর চোখে। খুব আস্তে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর?’ তানুশকা বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো গল্পের শেষটাÑ ...আকোয়ানাপার হাতটা ধরলো সুকি। খাদের কিনারে এসে বললো ঝাঁপ দাও। মুহূর্তের জন্য থমকালো আকোয়ানাপা। সুকির মুখের দিকে তাকালো। সুকি তাকে অভয় দিয়ে বললো- ভয় নেই, আমি আছি তোমার সঙ্গে। দু’জনে ঝাঁপ দিলো একসঙ্গে। গল্প শেষ করে থামলো তানুশকা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ওরা দুজন এখনও আছে জমাট পাথরের মূর্তি হয়েÑ কালকা শহর আর হুয়ালাপাম্পা শহরের মাঝখানে ওদের মূর্তি আছে। সুকির একটা জুতো পায়ে, আরেকটা হাতে। অন্য হাতে সে ধরে আছে তার ভালোবাসার মানুষ আকোয়ানাপার হাত...। পরদিন সকাল নটায় ট্রেন ছাড়লো বাকু স্টেশন থেকে। নানা দেশের ছেলেদের নিয়ে বিশাল একটা ছাত্রবাহিনী। প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন ছাত্র। তার মধ্যে আমরা চারজন বাঙালী। আট-দশটা কম্পার্টমেন্ট দখল করে যাচ্ছি আমরা। আমাদের কম্পার্টমেন্টে অস্কারসহ চারজন মেক্সিকান ছাত্র, দুজন রাশান আর দলের কমান্ডার ইসিনবায়েভ। ট্রেনটা ধীরে ধীরে স্টেশন ছাড়লো। গতি বাড়তে না বাড়তেই মাথার উপর থেকে গিটার নামিয়ে গান ধরলো অস্কার আর তার বন্ধুরা- ওয়াং তানামেরা... ওয়াহিরা ওয়াং তানামেরা... ওয়াং তানামে...রা ওয়াহিরা ওয়াং তানামে...রা লাইনগুলো ঘুরে ঘুরে আসতে লাগলো বারবার। প্রথম দু’লাইন উঁচুতে শুরু হয়, শেষ দু’লাইন খাদে নেমে যায়। শুনে শুনে একটু পরে আমরাও গলা মেলালাম। ট্রেন ছুটে চললো খোলা প্রান্তরের ভেতর দিয়ে, তীব্র গতিতে।
×