ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দীপংকর দীপক

মহাখালির চাঁদনী

প্রকাশিত: ১১:৩২, ৩১ মে ২০১৯

 মহাখালির চাঁদনী

এক. মহাখালি। সুলম্বিত রেললাইনটার পাশ দিয়ে সারি সারি বাঁশ-টিনের চালাঘর। সবগুলো ঘরই পূর্বমুখী করে থরে থরে সাজানো। কোনো ঘরের দরজা আছে, কোনোটির নেই। কোনোটি মোটা পলিথিন, কোনোটি ঘুণধরা কাঠখন্ড কিংবা কোনোটি ছালা-বস্তা দিয়ে মোড়ানো। অধিকাংশ ঘরেই আধোভাঙা চৌকি পাতা। ঘরের ভেতর ঢুকতে হয় কুব্জো হয়ে। সোজা হয়ে দাঁড়ালে মাথা ঠেকে চালে। প্রতিটি ঘরে সদস্য সংখ্যা দুই থেকে সাতজন। একেকটি চৌকিতে তিন-চারজন ঠাসাঠাসি করে শোয়। শ’খানেক ঘরের মধ্যে মাত্র আট-দশটিতে টিভি রয়েছে। তবে অধিকাংশ পরিবারের বড়কর্তা মোবাইল ব্যবহার করে থাকেন। আধুনিক যুগ তো, বস্তিতেও তার ছোঁয়া লেগেছে। চাঁদনীদের ঘরটা প্রায় মাঝামাঝিতে। বাপ-মেয়ের ছোট্ট সংসার। বছর দু’য়েক আগে তার মা মারা গেছেন। বাবাও রোগাক্রান্ত। দিনভর কাশতে থাকেন। তার কাশির সঙ্গে মুখ থেকে বের হয় একেকটি কফের দলা। পশ্চিম দিকের ভাঙা বেড়া দিয়ে মুখ বের করে সেগুলো থুক করে ফেলেন তিনি। কফদলাকে ঘিরে বড় জাতের মাছিগুলো সারাদিন ভ্যান ভ্যান করতে থাকে। এ নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কাশেমের রাতদিন ঝগড়া লেগেই থাকে। চাঁদনীর বয়স ১৬। টগবগে যুবতী। কিন্তু তার দুঃখের অন্ত নেই। সংসারের ঘানি তাকেই টানতে হচ্ছে। যতদিন মা ছিল, কোন চিন্তা ছিল না। বাবা রিকশা চালাতো। মা ঝিগিরি করত। টেনেটুনে হলেও সংসারটা ভালোই চলত। কিন্তু বছর খানেক ধরে বাবা বিছানায় পড়ে রয়েছেন। শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছেন। রিকশার প্যাডেলে ধাক্কা দেয়ার শক্তি তার নাই। তারপরও মাঝে মধ্যে দু’চারটা মালা-চিরুনি-আয়না ও রঙ-বেরঙের ফিতা নিয়ে ফ্লাইওভারের নিচে বসেন। দু’চার টাকা রোজগারও হয়। তা দিয়ে ঔষধ কিনতে কিনতেই শেষ। কিন্তু রোগ তো আর সারে না। এখন খোদার ওপর ভরসা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। চাঁদনীর মা’র স্বপ্ন ছিল মেয়েকে পড়াশোনা করাবেন। মেয়েরও স্কুলে যাওয়ার বেশ সাধ ছিল। থ্রি-ফোর পর্যন্ত পড়েছিলও। তারপর আর সামর্থ্যে কুলোয়নি। কষ্ট হলেও তার মা আরও কিছুদূর পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা একদিন মোটা গলায় বললেন, ‘তোর পড়াশোনার মুখে ইয়ে করি। ভাত জোটে না, আবার পড়াশোনা! ঝিয়ের মেয়ে তো ঝি’য়েই হবি।’ এই বলে ড্রেনে সব বইপত্র ছুড়ে ফেলে দিলেন। ওইদিনই চাঁদনীর স্কুলে যাওয়ার সব সাধ চুকেবুকে যায়। তারপর কয়েকটা বছর রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটেই চাঁদনীর কেটে যায়। তখন কেবল তার বুক বাড়তে শুরু করেছে। নানা রঙের কাপড়ে তালি লাগানো একটি গোল গলার গেঞ্জিই সে বেশি পরত। বুকের কাছে এসে গেঞ্জিটা কিছুটা উঁচু হয়ে থাকত। বিষয়টি যেন চাঁদনীর নজরেই আসেনি। একদিন বাসু এসে তার বুকে আলতো করে টিপি দিয়ে বলল, ‘আর কতকাল এসব পরবি। খুলে ফেল ওটা।’ তারপর একটা নতুন কামিজ হাতে দিয়ে বলল, ‘নে, এটা তোকে দিলাম। কিন্তু টিপুনির কথা তোর বাবা-মা’কে বলিস না কিন্তু।’ চাঁদনী খুশি হয়ে বামে-ডানে মাথা ঘুরালো। তা দেখে বাসু বলল, ‘কাল থেকে রোজ দুপুরে এই ঝোপের কাছে আসবি, বুজলি। তোকে প্রতিদিন চকলেট খাওয়াবো।’ তারপর আবার বুকের ওপর হাত দিয়ে বলল, ‘এখানে ছেলেদের হাত পড়লে তুই তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবি, বুজলি তো চাঁদমুখী।’ এর বছর খানেক পরেই বাসুর বাঁ পা ট্রেনে কাটা পড়ে। এরপর আর তার হকারগিরি করা হয়নি। ক্রেচে ভর দিয়ে ভিক্ষার থালা তুলে নেয় সে। ওদিকে ক’দিনের মধ্যেই চাঁদনী বড় হয়ে ওঠে। তার বুকটা যেন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। চুলগুলো কোমর ছুঁয়ে যাচ্ছে। চাঁদনী রেললাইনের ওপর দিয়ে হেলেদুলে হাঁটে। তা দেখে অসহায় বাসু ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে থাকে। দুই তখন সন্ধ্যা। চাঁদনী বাসায় ফেরে। তার বাবা আধো ঘুমাচ্ছন্ন ছিলেন। চাঁদনীর ডাকে চোখ খুললেন তিনি। ‘ও, তুই এসে গেছিস!’ ‘চোখ দিয়ে দেখতে পাও না’- কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলে চাঁদনী। ‘তুমি নাকি বাসুর কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়েছ?’ ‘কে বলল তোকে?’ ‘পলি বলেছে, পলি।’ ‘ও-ই তো সেধে দিল।’ ‘দিল বলে নিবা। শোধ করবা কীভাবে? শালার ভিক্ষুকের বাচ্চা ভিক্ষুক। ভিক্ষা জোটে না, আবার টাকা ধার দেয়।’- চাঁদনীর চোখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোয়। তারপর আর সময়ক্ষেপণ না করে ধপ করে বসে পড়ে পিঁড়িতে। চৌকির নিচ থেকে ভাতের পাতিলটা টেনে বের করে। থালা আনে, গ্লাসে পানি ঢালে। তারপর পা দুটো দু’দিকে ছড়িয়ে দেয়। ডাল আর পোড়া মরিচ দিয়ে দু-দু’থালা ভাত মাত্র কয়েক মিনিটেই সাবাড় করে ফেলে। কাশেম দু’তিনটা শুষ্ক কাশি দিয়ে ঢোক গিলে বলে, ‘কয় টাকা কামাইলি আজ?’ চাঁদনী থালায় পানি ঢালতে ঢালতে বলে, ‘সারে পাঁচশো।’ ‘ক্যান, সারে পাঁচশো, ক্যান!’ ‘হালার দালাল। হোটেল থেকে বের হতেই গেটে ধরে বসল। বলে কী না, তিন তিনটা ক্লায়েন্ট দিছি, আমারে গিফট দিবি না। আমি তো আর ফকির নই যে, ১০ টাকা ধরিয়ে দেবো। দিয়ে দিলাম ৫০ টাকা। যা শালা.....। মাগির টাকা, বউ রে গিয়ে খাওয়া।’ ‘বাসু, তোর কথা কইছিলো। কইলো ২০০ টাকা সে যোগাড় কইরগ্যা ফ্যালাইছে।’ ‘ওই ল্যাংডাটা অতো ফ্যাচোর ফ্যাচোর করে ক্যান। ওর সাথে মুই শোব না, তা তো আগের তাই কইয়া থুইছি।’ ‘এতো যহন চায়, যদি...।’ ‘হ, মালাউনডারে কইও যদি ৫০০ টাকা দিতে পারে, তইলে মুই রাজি আছি।’ কাশেম বিছানায় পড়ে যাওয়ার পর বাপ-মেয়ে কতদিন যে আধপেটা খেয়ে থেকেছে, তার ইয়ত্তা নেই। অচেনা এই শহরে কে দেবে তাদের খাবার! হঠাৎ একদিন আবাসিক হোটেল স্বপ্নালয়ের দালাল করিম এসে তার বাসায় হাজির। মেয়েটিকে দেখে তার বেশ পছন্দ হয়। শ্যামবর্ণা, সুঠাম দেহ, মায়াবী চোখ, রক্তিম ঠোঁট, সুউচ্চ বুক আর কৃশকায় কোমর। এ ধরনের মেয়েকে পছন্দ না করার কী জো আছে! করিম দালাল কাশেমের হাতে ৫০০ টাকা তুলে দেয়। এরপর বলে, ‘মেয়েটিকে আমার ওপর ছেড়ে দাও। ভার্জিন আছে, প্রথমেই বড় কোনো ক্লায়েন্ট পাওয়া যাবে।’ এমন দুর্দিনে কে কাকে সাহায্য করে! তাছাড়া সংসার চালানোর জন্য এর বাইরে আর কোনো পথ ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে কাশেম করিমের কাছে মেয়েকে তুলে দেন। হোটেলের প্রথমদিনের স্মৃতি চাঁদনী কোনভাবেই ভুলতে পারে না। এক প্রকার টানাহেঁচড়া করেই তাকে নিয়ে যওয়া হয়েছিল। তারপর নতুন জামা-প্যান্ট পরিয়ে তাকে সাজানো হয়। ভয়ে চাঁদনী কাঁপছিল। তবে জুলেখা আপা সেদিন বেশ সাহস দিয়েছিল তাকে। একটি বদ্ধ রুম। চাঁদনীর সামনে বিছানার ওপর প্রায় ৫০ বছর বয়সী এক পুরুষ। লম্বা-চওড়া দেহ, গায়ের রঙ ফর্সা। চাঁদনীকে দেখেই তিনি মুচকি হাসেন। এরপর তার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলেন, ‘কোন ভয় নেই তোমার। বিছানায় মেয়েদের ভয় থাকলে চলে না। বিছানা যেমন সাজিয়ে রাখে নারীরা; তেমনি মাতিয়ে রাখে রমণীরা। তুমি তো এখন আমার রমণের রমণী। এসো কাছে এসো। কি সুন্দর একখানা গোলগাল কচি মুখ। ভাগ্যে না থাকলে তোমায় পেতাম কী করে!’ চাঁদনী তার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বোঝেনি। গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। পুরুষ লোকটা তার ডান হাত দিয়ে চাঁদনীর থুতনি কিছুটা তুলে ধরে বলে, ‘ধর, তোমার আমার বিয়ে হয়েছে। আজ আমাদের ফুলশয্যা। সারারাত তুমি আর আমি রোমাঞ্চ করে পার করব, বুঝেছ।’ এই বলে পুরুষ লোকটা দুটো আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে তার বুকের ওপর রেখা আঁকতে থাকে। চাঁদনীর দেহটা মুহূর্তেই শিউরে ওঠে। তারপর...। উহ্, আর ভাবতেই পারে না চাঁদনী। লোকটা তার নাম বলে ছিল প্রিন্স। সে রাতে তার বেশ প্রশংসাও করেছিল। উপহারস্বরূপ চাঁদনীকে তিনি একটি মোবাইল ও সোনার আংটি দিয়েছিলেন। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও আংটিটি তার অনামিকায় এখনো জ্বলজ্বল করছে। মোবাইলেও মাঝে মধ্যে কল করে লোকটা। কিন্তু এরপর আর তার সঙ্গে চাঁদনীর দেখা হয়নি। তিন আকাশে চাঁদ উঠেছে। অর্ধগোলাকার চাঁদ। কিন্তু শহরের কৃত্রিম আলোর তোড়জোড়ে চাঁদটাকে কেমন যেন ঝাপসা মনে হচ্ছে। চাঁদনী আর পলি রেললাইনের ওপর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছে। বস্তির তরুণরা তাদের দিকে খাই খাই চোখে চেয়ে আছে। কিন্তু সেদিকে তাদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। চাঁদনী মাঝে মধ্যে বুকে হাত তোলে। হাত নামানোর সঙ্গে সঙ্গে তার সুউচ্চ বক্ষজদ্বয় বারকয়েক দোল খায়। তা দেখে তরুণদের হৃদয়ে যেন কামনার আগুন জ্বলে। কিন্তু চাঁদনী-পলির তাতে কিছু যায় আসে না। তারা তো আর পৃথিবীর সব পুরুষের কামনার আগুন নেভানোর দায়িত্ব নেয়নি। হ্যাঁ, তবে টাকা হলে তাদের নেভাতে আপত্তি নেই। কথায় আছে, টাকায় বাঘের দুধও মেলে। আর তো তাদের সাধারণ দেহ। পলি বলে, ‘তোর নাগর আর তোরে ফোন দেয় না?’ ‘দেয় মাঝে মধ্যে। উনি নাকি আমারে ভুলতে পারছেন না। আবার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ততার কারণে দেখাও করতে পারছেন না। পুরুষজাত; নারীর চেয়েও বেশি রহস্যময়। নারীর রহস্য ভাঙা যায়; আবার টাকা দিয়ে কেনা যায়। কিন্তু পুরুষের রহস্য ভাঙেও না, বিকোয়ও না।’ ‘তোকে আংটিটায় কিন্তু দারুণ মানিয়েছে। আমাকে দিবি ক’দিন পরতে?’ চাঁদনী ডানে-বামে মাথা ঝুলায়। ‘দিলে, এমন কী হবে?’ ‘কিছুই হবে না গো। এটা যে ওর স্মৃতি...।’ ‘বাব্বা, প্রেম কত! আমাদের প্রেম করে কোনো লাভ নেই, জানিস তো। এ প্রেম দেহেতে ওঠে আবার দেহতেই মিইয়ে যায়। তাছাড়া কল্পনার প্রেম বড় ভয়ঙ্কর। এ প্রেম মৃত্যুকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। দেবদাসকেও ডেকেছিল।’ ‘থাম তুই। আর জ্ঞান দিস না। মেট্রিক পাসটা তো আর করতে পারলি না।’ ‘তোর জন্যই তো। বললি, ওখানে কাড়ি কাড়ি টাকা। না খেয়ে থাকতে হবে না। মাও রাজি হয়ে গেল। ফেল করা দুই সাবজেক্টে আর পরীক্ষা দেয়া হলো না।’ দু’জনে হেলেদুলে সামনের দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ট্রেনের হুইসাল শোনা যায়। রাস্তা কাঁপিয়ে ট্রেনটা তাদের দিকে শোঁ শোঁ করে ছুটে আসে। পলি এক ঝটকায় চাঁদনীকে টান দিয়ে লাইনের এক পাশে নিয়ে যায়। চাঁদনী স্বাভাবিক হয়ে বুকে থু থু ছিটায়। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে। এই রেললাইনটা তাদের বস্তির কতজনের প্রাণ নিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। চাঁদনীর ছোট ভাইটাও ট্রেনে কাটা পড়েছে। টগবগে বাসু আজ ল্যাংডা হয়ে ভিক্ষে করছে। ক’দিন আগে রাসেলের বউ ছোট্ট বাচ্চা রেখে ট্রেনের নিচে মাথা দিয়েছে। আধুনিক সভ্যতা; গরিব-অসহায়দের জন্য ভয়ঙ্কর! পলি কিছুক্ষণ আনমনে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাসুর কী করলি?’ ‘ওইডা তো সারাদিন ঘ্যানোর ঘ্যানোর করে, বুজলি।’ ‘দিয়ে দে না, এক রাত।’ ‘অত সহজ না।’ ‘কেন, ওতো টাকা দিতে চায়।’ ‘ওরে ভাল্লাগে না। আর যারে পছন্দ না হয়, তার সাথে শুইলে গা ঘিনঘিন করে।’ ‘ঠিক বলেছিস; তবুও তো কত শুইতে হয়।’ ‘হ। ওরে তোর কথা বলে দেই।’ ‘আমিই বলেছিলাম। ও রাজি, না। অত কষ্ট করে টাকা যোগাড় করেছে! ও তোকেই চায়।’ ‘হারামজাদা, মালাউন।’ ‘তোদের ঘরের সামনে দিয়ে যখন আসছিলাম, তখন দেখলাম ও তোদের বাসায় ঢুকতেছে।’ ‘তাই নাকি! তায়লে চল। আজ দেখাবো একটা খেলা!’ ‘না, তুই যা। আমি তোর এ খেলার মধ্যে নাই।’ ‘উহ্...ঢং।’- এই বলে চাঁদনী একাই বাসার দিকে দ্রুত পায়ে রওনা হয়। চার বাসু চৌকির ওপর বসা। কাশেম গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। চাঁদনী পাশের মোড়াটি টেনে দুই পা মেলে বসে। তারপর বাসুকে চোখ মেরে মুচকি হেসে বলে, ‘কি-রে বাসু দা। এতো রাতে এ ঘরে কেন?’ ‘এমনি, কাশেম চাচার সাথে গল্পগুজব করছিলাম, আর কি।’ চাঁদনী তার বুকের ওপর থেকে ওড়নাটা সরাতে সরাতে বলল, ‘কত টাকা আনলি রে...।’ এ কথা শুনে বাসু প্রথমে ঢোক গিলল। তারপর চাতক পাখির মতো তার বুকের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল, ‘সাড়ে চার শ’, হবে না এতে...!’ তার কথা শুনে চাঁদনী কিছুক্ষণ উ™£ান্তের মতো হাসে। তারপর বাঁ চোখ ছোট করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কমড়ায়। আর গোল গলার কামিজটা টেনে কিছুটা নিচের দিকে নামিয়ে বলে, ‘আর পঞ্চাশ কই? আমার কথার কোন নড়চড় নাই রে...।’ বাসুর দেহটা ধুঁক করে নাড়া দিয়ে ওঠে। তার দৃষ্টি চাঁদনীর স্বচ্ছ বুকের ওপর আঁকড়ে থাকে। সে আর কিছুই বলতে পারে না। কাশেম কিছুটা মাথা তুলে বলে, ‘নে, অত ঢং করিস না। তোর ঢং দেখলে গায়ে জ্বালা ধরে। বেচারি কত কষ্ট করে টাকাগুলো জোগাড় করেছে। তাছাড়া ও তো আগের থেকেই মোর কাছে পঞ্চাশ টাকা পায়।’ ‘তাতে কী! আমার লাগবে পাক্কা ৫০০ টাকার চকচকে একটি নোট।’- এই বলে হি হি করে হাসতে থাকে সে। তার হাসি ট্রেনের বাঁশির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ১৫-২০ মিনিট অন্তর অন্তরই ট্রেন আসা যাওয়া করে। চাঁদনী ঘর থেকে বাসুকে ট্রেন দেখিয়ে বলে, ‘মোরে না পাইলে, তুমি কী ওই ট্রেনের নিচে মাথা দেবা বাসু দা?’ চাঁদনীর কথাগুলো বাসুর হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধে। তার মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। তারপর ক্রেচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘এরপর আসলে, গুনে গুনে পাঁচ শ’ নিয়ে আসবো দেখিস।’ এ কথা শুনে চাঁদনী হো হো করে হেসে ওঠে। পাশের সাজুগুজুর পাত্র থেকে গোলাকার ছোট্ট আয়না ও লাল রঙের লিপিস্টিকটি হাতে নিয়ে বলে, ‘দাঁড়াও...দাঁড়াও, কই যাচ্ছো বাসু দা! কথা তো এহনো শেষ হয় নাই।’ বাসু দাঁড়িয়ে পড়ে। চাঁদনী আয়নায় নিজের মুখ দেখে। তারপর দু’দুবার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে। ধীরে ধীরে নিচের ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগাতে লাগতে বলে, ‘শুনো, বাসু দা।’ তারপর কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা থামায়। বাসু অতি আগ্রহে তার মনের কথা শোনার অপেক্ষায় থাকে। চাঁদনী ঠোঁট থেকে লিপিস্টিকটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘মনে কিছু করবা না কইলাম।’ তারপর আবার কথা থামায়। বাসু তার কথার রহস্যের কূল খুঁজে পায় না। এরপর চাঁদনী তার লুঙ্গির দিকে কটাক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কাইটা আসতে হবে, কইলাম’ বাসু রাগে ফুঁসে ওঠে। কাশেম তার মেয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পাঁচ তখন রাত গভীর। ট্রেন লাইনের আলোর কারণে চাঁদনীদের ঘর সবসময়ই আলোকিত থাকে। তবে দরজা আটকিয়ে দিলে আলো কম ঢুকে। তারপরও ভাঙা বেড়া চিরে যে আলো ঢুকে তাতেই ঘরের মধ্যে সবকিছু পরিষ্কার দেখায়। আজ আর কাশেমের ঘুম আসে না। শুধু এপাশ ওপাশ করে। পাশে তার মেয়ে নাক ডেকে ঘুমায়। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর, ঘুমাবেই না কেন! চাঁদনীর দু’পা দুদিকে ছড়ানো। বাঁ পা কাশেমের হাঁটুর ওপর তুলে দিয়েছে। আস্তে আস্তে কাশেম পা’টি সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সরে না। তারপর ডান হাত দিয়ে পা’টি সজোরে ধাক্কা মারে। পা’খানা চৌকির ওপর দুম করে পড়ে। দেহটা নড়ে ওঠায় ঘুণ ধরা চৌকিতে কড়মড় শব্দ হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও মেয়েটির কোনো টু শব্দ নেই। মরণ ঘুম দিয়েছে যেন। কাশেম বাঁ থেকে কিছুটা ডানে ঘোরে। হঠাৎ তার চোখ গিয়ে বিঁধে মেয়ের বুকের ওপর। বুকখানা অনেকটাই খোলা ছিল। তা দেখে কাশেমের গা দু’বার ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। তিনি তার মেয়ের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। ঘুম ভাঙার কোন লক্ষণ নেই। ধীরে ধীরে বাঁ হাতটি তিনি চাঁদনীর ডান পাশের বুকের ওপর রাখেন। পঞ্চাশোর্ধ কাশেমের ভঙ্গুর শরীরটায় হঠাৎ করেই যেন আগুন ধরে যায়। রুগ্ন চোখ দুটি দিয়ে কামের হলকা বেরোয়। বড় বড় নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। তার আর সহ্য হচ্ছিল না। সজোরে তিনি চাপ মারেন ওর বুকের ওপর। চাঁদনী ‘উহ্’ করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘুম ভেঙে যায়। তার চোখ দুটি লাল টকটকে। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে দেখে সে হতবাক হয়ে যায়। দ্রুত হাতে সজোরে ধাক্কা মেরে বলে, ‘এ কি করছ, তুমি...!’ কাশেমের ঘোর ভাঙে। চাঁদনী উঠে বসে পড়ে। তারপর আবার বলে, ‘কি করতেছ, তুমি... !’ কাশেম কোনো কথা বলতে পারে না। লজ্জায় তার মাথা নত হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পরই চাঁদনী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ছয় রাত তখন ৩টা। কোথাও কোনো মানুষজন নেই। শহরের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চাঁদনী সোজা হেঁটে যায় পলিদের চালাঘরে। দরজার কাছে গিয়ে সে ফিসফিসিয়ে ডাক দেয়, ‘পলি, এই পলি।’ কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। সে ভাঙা বেড়া দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে কে কোথায় ঘুমিয়েছে তা বুঝতে চেষ্টা করে। মায়ের পাশেই পলি শুয়ে আছে। চাঁদনী এবার বেড়ার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পলির মাথায় ধাক্কা দেয়। পলি ভয় পেয়ে ‘কে কে’ বলে জেগে ওঠে। চাঁদনী চাপাকণ্ঠে বলে, ‘আরে মুই, মুই চাঁদনী’। ‘এত রাতে তুই!’ ‘উঠে আয়, কথা আছে?’ পলি উঠে আসে। তারপর চাঁদনীর সামনে এসে হাইতুলে ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে নিজ মুখের সম্মুখে তুড়ি মারতে মারতে বলে, ‘এত রাতে কি জন্যে?’ ‘একটা বড় সমস্যায় পড়ে গেছি!’ ‘কি হইছে?’ ‘বাবার মাথায় ভূত চাপছে।’ ‘মানে!’- পলির চোখ যেন কপালে ওঠে। চাঁদনী পলির হাত খপ করে ধরে বলে, ‘এবার একটু বাঁচা বোন, তুই।’ ‘আরে ধ্যাত, কি হইছে; খুইল্যা কইবি তো!’ চাঁদনী দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘বাবার সাধ জাগছে।’ পলি মুখটা কিছুটা বিকৃতি করে বলে, ‘অ...তয় মুই কি করব?’ ‘তোর যে একটু শান্ত করতে হবে।’ পলি অবহেলাসূচক ভঙ্গিতে বলে, ‘ওই বুড়ার কাছে, মুই! মানুষ আর পাইলি না।’ ‘তোরে, পাঁচ-পাঁচ শ’ টাকা দেবো।’ ‘না, পারুম না। বড় ঘুম পাইছে।’- এই বলে সে ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। চাঁদনী তার হাত টেনে ধরে বলে, ‘তোর বিপদের দিনে মুই আয়-ইনকামের পথ দেখাইছিলাম। তুই তখন কথা দিছিলি, আমার বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াবি।’ পলি আর এড়িয়ে যেতে পারে না। বলে, ‘ওতে হবে না।’ ‘কি বলিস তুই, পাঁচ-পাঁচ শ’ টাকা!’ ‘ওই বুড়ার সাথে শুইলে যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু তোর কথা তো আর ফেলতেও পারছি না। তবে আরো বাড়াতে হবে।’ ‘কত চাস, তুই!’ ‘দুই হাজার, পারবি দিতে?’- এই বলে পলি চাঁদনীর চোখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। দু’দু’হাজার টাকার কথা শুনে ও অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ক্ষণিকবাদে পলি হেসে বলে, ‘যা, টাকা দিতে হবে না।’ ‘তাহলে তুই কি নিবি!’ পলি চাঁদনীর হাতের দিকে তাকিয়ে আংটিটি দেখিয়ে বলে, ‘ওইটা’। চাঁদনী এক ঝটকায় আংটিটি খুলে ওর হাতে তুলে দেয়। পলি কিছুক্ষণ আংটিটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। তারপর অনামিকায় ঢুকাতে ঢুকাতে বলে, ‘চল, তোদের ঘরে চল।’ চাঁদনী পলিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে। তখনও কাশেম বসে বসে কাশছিল। তা দেখে পলি ভ্রুকুঁচকে বলে, ‘ওই ব্যাটা, বুড়া বয়সে ভীম রতি! আইজ তোমার জন্মের মতো খায়েশ মিটাবো, দেইখো।’ পলির কথা শুনে কাশেম কিছুটা দম নিয়ে খাটাশের মতো হাসে। তার পান চিবানো দাঁতগুলো ওর বড় বিশ্রী লাগে। তবুও কিছু করার নেই। পুরুষের খায়েশ মিটানোই যে ওদের কাজ। চাঁদনী পলিকে বলে, ‘তুই থাক, আমি বাইরে যাচ্ছি।’ পলি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দেয়। চাঁদনী ঘর থেকে বের হয়ে রেললাইনের ওপর দাঁড়ায়। পৃথিবীটা আজ তার বড় অসহ্য লাগছে। মাটি ভেদ করে পাতালে চলে যাওয়ার সাধ জাগে তার। এত দুঃখ-কষ্ট আর সইতে পারে না সে। নারী জনম যতটা না সুখের, তার চেয়ে দ্বিগুণ দুঃখের। সৃষ্টিকর্তা নারীদের মধ্যে এই দ্বিগুণ দুঃখ বহন করার শক্তি যদি না দিতো তাহলে প্রতিটি নারীকেই আত্মহত্যা করতে হতো। কিন্তু সে যদি আত্মহত্যা করে, তাহলে তার রোগাক্রান্ত বাপটার কী হবে! শত হলেও তো উনি তার জন্মদাতা পিতা। আর পিতার সেবা করাই সন্তানের কর্তব্য। এখন তার মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। মা বেঁচে থাকলে তাকে আজ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। চাঁদটা পশ্চিম দিকে বেশ খানিকটা হেলে পড়েছে। ঠান্ডা বাতাসটা তার যন্ত্রণাকাতর শরীরটাকে কিছুটা হলেও শীতল করে দিচ্ছে। রাতে ট্রেন আসা-যাওয়া করে কম। তবে যেটা আসে, খুব দ্রুত গতিতে। হুইসাল দেয়ারও প্রয়োজন মনে করে না। হঠাৎ চাঁদনীর কান খাড়া হয়ে যায়। তাদের ঘরের ভেতর থেকে ‘উহ্, উহ্’ ধ্বনি ভেসে আসে। চাঁদনীর দেহটা কিছুক্ষণের জন্য পাথর হয়ে রয়। মায়ের চেহারাটা তার সামনে পুনরায় ভেসে ওঠে। সাত কাকডাকা ভোর। শহরের মানুষ তখনো ঘুমাচ্ছন্ন। তবে বাসু মৃদু স্বরে ভোর আরতি করতে করতে ক্রেচে ভর দিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছিল। আর সম্মুখের উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, ভোর আরতি করে কী হবে! ঈশ্বর তো ওই উঁচু বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা; মাটির দিকে তাকানোর তার সময় নেই। নীচের মানুষগুলো যেন তার চিরশত্রু। কিন্তু এই হতভাগাদের সঙ্গে লড়াই করে তিনি কি-ই বা শান্তি পান, তা তার জানতে ইচ্ছা করে। তবে যেদিন নিচের মানুষগুলো তাকে অস্বীকার করবে তখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে দাঁড়াবে। এ কথা ভেবে বাসু মৃদু হাসে। ভাবনাগুলো তাকে কিছুটা হলেও শক্তি ও শান্তি দেয়। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়ায়। সম্মুখে দেখতে পায় একটা মেয়ের লাশ রেললাইনের পাশে পড়ে আছে! বাসু হতভম্ব হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কোমর ভেঙে হাড়গুলো বেরিয়ে এসেছে, মাথাটা থেতলে গেছে। জমাট বাঁধা রক্ত তার মুখম-লে থকথক করছে। জামা-প্যান্টেও ছোপ ছোপ কালচে রক্তের দাগ পড়েছে। বাসু কি করবে, কিছুই বুঝতে পারে না। পাশেই কাশেমের ঘর। বাসু হাঁক পাড়ে, ‘কাশেম চাচা! ও কাশেম চাচা!’ তার ডাক শুনে পলির ঘুম ভাঙে। সে কাশেমকে ধাক্কা দিয়ে তুলে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তোমাকে বাসু ডাকছে।’ কাশেম লুঙ্গিটা ভালো করে কোমরে আটকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাসু আঙুল দিয়ে তাকে লাশটা দেখায়। কাশেম অবাক বিস্ময়ে লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ দুটো নিমিষেই বড় হয়ে যায়। গায়ের লোম শিউরে ওঠে। আর মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়ে। পেছন থেকে পলি চিৎকার করে ওঠে, ‘চাঁদনী! ওই চাঁদনী...!’
×