অনেকদিন আগে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাংলার কৃষক’ শিরোনামে গুরুগম্ভীর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। নিবন্ধটিতে মাধুর্যমন্ডিত বঙ্কিমী ভাষায় মূলত বাংলার কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার চিত্রই তুলে ধরা হয়েছিল। অতীব পরিতাপের বিষয় এই যে, বাংলার কৃষকের দুঃখের অমানিশা অদ্যাবধি কাটেনি। বরং সঙ্কট ও সমস্যা আরও গভীর ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে। গত ১৭ বৈশাখ প্রকাশিত ‘গোলা ভরা ধান’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমরা মন্তব্য করেছিলাম যে, দেশে এবার আমনের পর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে, যা গত দশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সে অবস্থায় কৃষকের কেবল গোলা নয়, বরং বাড়ির আঙ্গিনাসহ যত্রতত্র রাখা হচ্ছে রাশি রাশি ভারা ভারা স্তূপীকৃত ধান। সত্যি বলতে কি, এত উদ্বৃত্ত ফলন সংরক্ষণ নিয়ে রীতিমতো স্থানসংকুলানের সমস্যা দেখা দিয়েছে। কেননা, ধানের চাতাল তথা গুদামগুলোও ধান-চালে উদ্বৃত্ত ও ভর্তি। ফলে কৃষককুলের হয়েছে দিশাহারা অবস্থা। অন্যদিকে হাটবাজারে ধান-চালের দাম নেই বললেই চলে। বর্তমানে গ্রাম-গঞ্জে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার শ’ থেকে পাঁচ শ’ টাকায়। অথচ একজন ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৮৫০ টাকা, তাও প্রায়ই পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ আছে। কেননা এরও বেশি আয়-উপার্জনের আশায় দিনমজুররা প্রায়ই পাড়ি জমিয়ে থাকেন ঢাকা ও অন্যান্য শহরে। বীজধান, সার কীটনাশক, সেচ বাবদ বিদ্যুত-ডিজেল ইত্যাদির দাম বেড়েছে ইতোমধ্যে। সরকারী প্রণোদনা সত্ত্বেও বাস্তবতা এই যে, সার্বিকভাবে উৎপাদন বাড়ায় বর্তমানে কৃষককে প্রতিমণ ধানে লোকসান গুনতে হচ্ছে গড়ে দেড় শ’ থেকে দু’ শ’ টাকা। ধানের দাম না পেয়ে ক্ষোভে-দুঃখে পাকা ধানক্ষেতে নিজ হাত আগুন লাগিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। ফসলের ন্যায্যদাম না পাওয়ায় বহু সংখ্যক কৃষকের আত্মহত্যার কখা প্রায়ই প্রকাশিত হয়ে থাকে ভারতের গণমাধ্যমে। অনুরূপ অবস্থা আমাদের দেশেও ঘটুক, আমরা তা চাই না কোন অবস্থাতেই। সরকার অবশ্য সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন বলেই প্রতীয়মান হয়। খাদ্যমন্ত্রী ইতোমধ্যে ১০-১৫ লাখ টন চাল বিদেশে রফতানির চিন্তা ভাবনা চলছে বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি আপাতত ভারত থেকে চাল আমদানি বন্ধ করারও দাবি উঠেছে। কৃষককে ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য অন্তত দু’মাস ধান ঘরের গোলায় ধরে রাখারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, গরিব কৃষক ধান ঘরে রাখবে কিভাবে? তার তো ধান বেঁচেই সংসার চালাতে হয়; নগদ মূল্যে কিনতে হয় নিত্যপণ্য। সরকার তথা খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকেও স্বীকার করা হয় যে, তারা সরাসরি মাঠপর্যায়ের কৃষকদের থেকে ধান-চাল কিনতে পারে না। এর সুবিধা নিয়ে থাকে ধান-চাল ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। ফলে সরাসরি ধান-চালের ন্যায্য মূল্য কৃষকের হাতে তুলে দেয়ার বিষয়টি একটি দূরতিক্রম্য বাধা বটে। এই সমস্যার সমাধানের সূত্র খুঁজে বের করতে হবে সরকারকেই। এর পাশাপাশি বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর পাশাপাশি বাড়াতে হবে সরকারী গুদামের মজুদ। মনে রাখতে হবে যে, কৃষক না বাঁচলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ।
বাস্তবতা হলো, দেশে গত কয়েক বছরে ধান-পাট, আলু-ফলমূল, শাক-সবজি, তরিতরকারি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, চা, চামড়া ইত্যাদির উৎপাদন বাড়লেও ত্রুটিপূর্ণ মার্কেটিংয়ের কারণে কৃষক ও উৎপাদক শ্রেণী প্রায়ই বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে। এটি সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও আমরা একটি সমন্বিত ও আধুনিক কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে একদিকে উৎপাদিত ফসল ও পণ্যদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষক, অন্যদিকে সেসব পণ্য উচ্চমূল্যে কিনতে হয় ভোক্তা তথা ক্রেতাসাধারণকে। দেশে ধান-চাল-পাটসহ কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি আধুনিক ও সমন্বিত মার্কেটিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী ও অপরিহার্য। তা না হলে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে কৃষকসমাজ।
শীর্ষ সংবাদ: