
ছবি: জনকণ্ঠ
দীর্ঘ বছর সংসার করার পর হঠাৎ একদিন এক নারী সিদ্ধান্ত নিলেন ডিভোর্সের। তার ভাষায়—
"এই সম্পর্ক আর চলছে না, আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই।"
আজকের আধুনিক সমাজে এমন সিদ্ধান্ত অবাক করার মতো নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এটা কি শুধুই আত্ম-উন্নয়ন বা আত্মসচেতনতার ফল, নাকি এর আড়ালে আছে এক ভয়ংকর ছায়া?
লাভ বোম্বিং: মায়ার মোড়কে মানসিক শিকার
লাভ বোম্বিং হল এক ধরণের সুপরিকল্পিত মানসিক নিয়ন্ত্রণের কৌশল—
যেখানে এক অপরিচিত বা আধা-পরিচিত পুরুষ হঠাৎই এক বিবাহিত নারীর জীবনে প্রবেশ করে, অতিমাত্রায় ভালোবাসা, সহানুভূতি ও প্রশংসায় তাকে ভাসিয়ে দেয়।
“তুমি এত সুন্দর, তুমিই আমার সব।”
“তুমি সারাদিন একা থাকো কেন?”
“তোমার স্বামী কি সত্যিই তোমাকে বোঝে?”
এইসব কথা প্রথমে প্রশান্তির মতো শোনালেও, ধীরে ধীরে এগুলো হয়ে ওঠে মানসিক ইনসেপশনের অস্ত্র।
টার্গেট কারা হন?
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন—৩৫-৪৫ বছর বয়সী মধ্যবয়সী বিবাহিত নারী, যাদের দাম্পত্যে একঘেয়েমি বা ক্লান্তি কাজ করে, যাদের আত্মবিশ্বাসে ভাটা পড়ে গেছে, যাদের অনেকদিন শোনা হয়নি কারো কাছ থেকে 'বিশেষ' বোধ করানোর কথা।
এই সময়েই কেউ একজন যখন “সব বুঝে ফেলা প্রেমিক” হয়ে আসে, তখন নারীটি আবেগে ডুবে যান এবং নতুন একটি কল্পনার জগতে প্রবেশ করেন—যেখানে তিনি আবার ‘প্রেমিকা’, ‘আকর্ষণীয়’ এবং ‘প্রশংসনীয়’।
ফাঁদ যেভাবে তৈরি হয়
১. আবেগিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি
২. সহানুভূতির মুখোশ পরে “বাঁচার কথা” শোনানো
৩. স্বামীর সঙ্গে তুলনা করে অসন্তোষ তৈরি
৪. “স্বাধীনতা”র নামে সংসারবিমুখ করে তোলা
৫. ডিভোর্সের সিদ্ধান্তকে নারীর নিজের বলে মনে করিয়ে দেওয়া
প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি উপহার একেকটা ছুরি:
লাভ বোমবাররা আপনাকে বোঝাবে—
“তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত তোমার নিজের”, কিন্তু পর্দার আড়ালে সেই সিদ্ধান্ত তৈরির মঞ্চ তারা-ই সাজিয়ে রেখেছে।
লক্ষ্য কী তাদের?
-
স্বামী-সন্তানদের বিরুদ্ধে নারীর ক্ষোভ বাড়ানো
-
তাকে মানসিকভাবে পুরোপুরি নির্ভরশীল করে তোলা
-
সংসার ভাঙিয়ে একলা ও দুর্বল করে তোলা
-
অবৈধ ও গোপন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা
-
এবং শেষে—একটা ‘বিবাহিত নারী জয়’-এর বিকৃত আত্মতৃপ্তি
এটা প্রেম নয়—এটা এক যৌনলিপ্সু মানসিক শিকারব্যবস্থা, যেখানে নারীর আবেগ, ভালোবাসা ও আত্মপরিচয়কে অস্ত্র বানিয়ে তাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হয়।
সমাজ ও পরিবারে প্রভাব:
এই কৌশল শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, পরিবার ও সমাজকেও নষ্ট করছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সন্দেহ, বিচ্ছেদ, সন্তানের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। অনেকে নিজের ভুল বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, “এই ধরনের কৌশল গভীরভাবে মানুষের আত্মসম্মান ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত করে। সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে এটি আরও দ্রুত ছড়াচ্ছে।”
আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ ফাঁদে পড়েছেন কিনা বোঝার উপায়:
-
হঠাৎ করে কোনো অপরিচিত পুরুষ বারবার ইনবক্সে বিশেষ যত্নশীল আচরণ করছে?
-
নিজের স্বামীকে দিন দিন অসহ্য লাগছে, যদিও বড় কোনো সমস্যা নেই?
-
মনে হচ্ছে, সংসার ছেড়ে "নিজের মতো" বাঁচলেই মুক্তি?
-
নতুন এক সম্পর্ক আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—আপনি “আরো ভালো” প্রাপ্য ছিলেন?
এগুলো যদি সত্য হয়—তবে দয়া করে থামুন, ভাবুন।
লাভ বোম্বিংয়ের পরিণতি:
-
আত্মপরিচয়ের ভাঙন
-
সামাজিক ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা
-
ডিপ্রেশন ও ব্ল্যাকমেইলিং
-
শেষে ‘ফ্যান্টাসি প্রেমিক’-এরও গায়েব হয়ে যাওয়া
নিজেকে রক্ষা করবেন যেভাবে:
-
আবেগ নয়, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করুন
-
হঠাৎ পাওয়া "বিশেষ" প্রশংসা বা যত্ন নিয়ে সন্দেহ করুন
-
নিজের দাম্পত্য সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির মন্তব্যে প্রভাবিত না হন
-
স্বামীর সঙ্গে খোলাখুলি যোগাযোগ বাড়ান
-
প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সহায়তা নিন
শেষ কথা:
আপনার অনুভূতি বাস্তব, কিন্তু সেগুলো কারো পরিকল্পনার ফাঁদ কি-না, সেটা বুঝে চলা আরও বাস্তববাদী। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করাই এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের প্রতি সামাজিক ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাড়তে থাকা 'লাভ বোম্বিং'য়ের কৌশলী ও আকর্ষণীয় ফাঁদ নিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।
আবির