ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিজ ঘরে পরবাসী

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ৫ অক্টোবর ২০১৮

নিজ ঘরে পরবাসী

এখানে দিনের আলোতেও মানুষ আসতে ভয় পায়। চারদিকে ঝোঁপঝাড়। কয়েক যুগের আমগাছ ডালপালা মেলে আছে আকাশে। কথায় আছে, বুড়ো গাছে থাকে ভূতের বাড়ি। শুধু আমগাছ নয়; এখানে দেশীয় বেশিরভাগ ফল গাছই আছে। মূলত এটা একটা বাগানবাড়ি। বাগানবাড়িতে গাছের পসরা সাজিয়েছেন পাশের গ্রামের সন্তোষ বাবু। পৈত্রিক সূত্রে এ বাগানবাড়ির মালিক তিনি। বাগানবাড়ির মাঝেই একটা ঝুপড়ি ঘর। অন্তত এক শ’ হাত দূরে পুকুর। এছাড়া সবকিছু অগোছালো। দেড় একর পরিত্যক্ত বাগানবাড়িটি ধীরে ধীরে বাসযোগ্য করে একটা পরিপাটি বাড়ি করার ইচ্ছে। যেন প্রজন্মের কয়েক সিঁড়ি থাকতে পারে। সন্তোষ বাবু এখানে মাঝে মাঝেই রাত্রি যাপন করেন। প্রশান্তি খোঁজেন। দিনের আলোয় মেঘনা নদীতে ইলিশ শিকার করেন। ভরা মৌসুমে পূর্ণিমা নিশিতে রুপালি ইলিশে রুপালি আলো ছড়ায়। মেঘনা আর ইলিশেই চলে জীবন জীবিকা। দুই ছেলেও নদীতে মাছ ধরে। একমাত্র মেয়েকে ভারতের আগরতলায় নিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। বাগানবাড়ি থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে মেঘনা নদী। যা আগে ছিল পাঁচ ক্রোশ দূরে। এখানের মানুষের সঙ্গে ভাঙনে আত্মীয়তা হয়েছে বেশ। প্রতিবছরই ভাঙে। ভাঙনে ভিটি হারিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে যোগ দিয়েছেন অনেকে। এভাবে অনেক হিন্দু পরিবারও বসতভিটা হারিয়ে চলে গেছেন অন্য কোথাও। এখন ধর্মপুর গ্রামে হিন্দু বলতে শুধু সন্তোষের পরিবার থাকে। তার বংশ বা গোত্রের কেউ এখানে থাকেন না। অবশ্য তারা কোথায় থাকেন সন্তোষ বাবু জানেও না। এলাকায় জনশ্রুতি আছে আগরতলায় সন্তোষেরও বাড়ি আছে। যদিও মাঝে মাঝেই মেয়েকে দেখতে ভারতে যান সন্তোষ। গ্রামের মানুষের ধারণা পূর্বপুরুষের মতো সন্তোষও একদিন ভারতে পাড়ি দেবেন। এলাকার বিত্তশালী তথা প্রভাবশালী ইয়াছিন শিকদার সন্তোষের আপন মানুষের মতো খুব আদরযতœ আর খোঁজখবর নেন। মনসুর, সফিক, রহমত উল্লাহসহ অনেকেই সন্তোষের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রাখে। ভারত যাবার সময় যেন বাগানবাড়িটা তাদের কাছে বিক্রি করে। এ আশায় মেকি সম্পর্ক জিইয়ে রাখে বছরের পর বছর। কিন্তু সন্তোষ বাবু একবারের জন্যও দেশ ছাড়ার কথা মুখে আনেন না। মাতৃভূমিতেই শেষ ঘুম দিতে চান সন্তোষ। মানুষের মুখে দেশ ছাড়ার কথা শুনলে মনের ভেতর মোচড় দেয়। খুব কষ্ট হয় কিন্তু প্রকাশ পায় না। এলাকা ছেড়ে যাওয়া পূর্বপুরুষদের কথা মনে করতে চান না সন্তোষ। যদিও বিষয়টি নিশ্চিত নন তিনি। মাঝে মাঝেই মনে ভেতর জেদ হয় মেয়েকে ভিন দেশে বিয়ে দিয়েছেন ভেবে। না হয় মানুষ এভাবে দেশ ছাড়ার কথা মনের ধারে কাছেও আনতেন না। আনলে কঠোর প্রতিবাদ করতেন। শুধু মেয়ের জন্য মুখের উপর প্রতিবাদ করতে পারেন না সন্তোষ বাবু। অথচ মেয়েটার জন্য মাঝে মধ্যে ভারতে গেলেও দেখা করেই চলে আসেন। একরাত থেকেই চলে আসেন। নদীর টানে। ইলিশ আর বাগানবাড়ির মায়ায়। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলো ভাবে সন্তোষ একদিন ভারতে চলেই যাবে। এসব নিয়ে সন্তোষের মন খারাপ হয়। কিন্তু মেঘনা নদীতে গিয়ে জাল ফেললে মন ভাল হয়ে যায়। রুপালি ইলিশের রূপ দেখে আনন্দে ভরে উঠে মন। জালে আটকে পরা বড় বড় ইলিশের লাফালাফিতে নিজের অজান্তে শরীরও লাফায় ছন্দে সঙ্গে মন। সন্তোষ বাবু মনে মনে ভাবে, যে দেশে শুধু ইলিশ মাছেই কপালে ভাত জোটায়। সে দেশ কে ছাড়ে? এ দেশ ক্যামনে ছাড়ি আমি? ক্যান তারা আমারে তাড়াইতে চায়। ক্যান তারা আমারে বিশ^াস করাবার চায় না। আমি আমার বাগানবাড়িটা খুব ভালবাসি। আমি এখানে দম নিতে চাই, ছাড়তে চাই। জীবনের শেষ মুহূর্ত অবদি। সন্তোষ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যত বিপদ আসুক আমি দেশ ছাড়ুম না, বাগানবাড়ি ছাড়ুম না। বড় ছেলে পান্তোষকে ডেকে বলে, শুন বাবা, ভুলেও দেশ ছাড়নের কথা মুখে নিবি না। যেই দেশের নদী মানুষের মুখে খাওন দেয়। তাগো কোন চিন্তা আছে বল? আমাদের মতো পরম ভাগ্য কয়জনরে দিছে ভগবান। নদীই আমাগো ভগবান। আমরা ভগবানরে ছাইরা ক্যামনে অন্যখানে যামু? -হ বাবা। জীবন গেলেও আমরা কোনদিন দেশ ছাড়ুম না। জলে ভাসা নৌকায় দেশ না ছাড়ার সিদ্ধান্ত ওই সমাজপতিদের কানে পৌঁছায় না। হয়ত পৌঁছুবে না কখনও। পরে পৌঁছুলেও তারা কোন কালেও বিশ^াস করবে না। কারণ তারা তো দেশপ্রেম বোঝে না। নদীপ্রেম, জলপ্রেম, মৎস্যপ্রেম বোঝে না। ওরা বোঝে স্বার্থ। বোঝে সম্পদ। অর্থ। যদি বুঝত তবে সন্তোষকে কখনই আলাদা চোখে দেখত না। সন্তোষের বুকের জমিনে বোনা স্বপ্ন তাদের চোখে দৃশ্যমান হলেও নিশ্চয় অবিশ^াস ঠেকবে। অবশ্য মানুষ এমনই। কাউকে অবিশ^াস করলে বিশ^াসের ঘরে আর জায়গা দেয় না। এভাবে দিন যায়। বছর। যুগ। এর মাঝেই উপস্থিত হয় উনিশ শ’ একাত্তর। চারদিকে ধ্বংসলীলা। বাড়ি ছাড়ল, ঘর ছাড়ল, দেশান্তর হলো বহু মানুষ। নির্মম নির্যাতনে পৃথিবী ছেড়েছে লাখ লাখ সতেজ প্রাণ। ইয়াছিন শিকদার পাকিস্তানীদের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেকে রক্ষা করে। লুটপাট করে। সম্পদ গড়ে। হত্যা করে মানুষ। মনে মনে সন্তোষকে খুঁজে শিকদার। যদিও যুদ্ধের সময় গ্রাম ছেড়ে অচীন কোথাও পাড়ি জমায় সন্তোষ। গ-োগোল থেমে গেলে ফিরবে এই আশায়। কিন্তু নয় মাস পর স্বাধীন দেশে ঘরে ফিরল অনেকেই। শুধু ফিরেনি সন্তোষ ও তার পরিবার। সন্তোষের আত্মীয়-স্বজন নেই। তাই অপেক্ষারত কেউ নেই। তাতে কী? একটা শ্রেণী অপেক্ষায় থাকে সন্তোষের আসা না আসার দিকে। দীর্ঘদিন সন্তোষ তার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে আর এলাকায় দেখা যায় না। বাড়ির ঘরে মাকড়সায় ভবনের পর ভবন তুলেছে। ঘরের একটা কক্ষে এখনও সেই মাছ ধরার জাল থুব হয়ে পড়ে আছে। অভিমানে। হয়ত খুঁজে ফিরে সন্তোষের ভালবাসার হাত। ভক্তি আর শ্রদ্ধার হাত। সে হাত ফিরে না। ঘরের আলমারির দরজা খোলা। আওলানো অন্য সব জিনিসপত্র। গত দুই দশক কোন যতœ না করায় অপ্রয়োজনীয় গাছ দখল করেছে বাগানবাড়ি আর নিজ বাড়ির শ্যাওলা বিছানো উঠোন। এখন বাড়িটি ভিন্ন গ্রামের মানুষেরাও দখলের চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রভাবশালী ইয়াছিন শিকদার, মনসুর, সফিক আর রহমত উল্লাদের কারণে কেউ এ সাহস করতে পারছে না। দখলে যেতে চায় এদের সবাই। তাই বাড়িটি সবাই দেখে শুনে রাখে। আর মনে॥ মনে সবাই সন্তোষকে খুঁজে। পায় না। আসে না সন্তোষ। কবে আসবে কেউ জানে না। কখনও আসবে কিনা তা অনিশ্চিত। একদিন হঠাৎ করে ইয়াছিন শিকদার এলাকায় রটাতে শুরু করেন সন্তোষ তার কাছে বাগানবাড়িটি বিক্রি করে গেছেন। হঠাৎ করে এমন কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে কেউ কেউ বিশ^াস করে। কেউ করে না। সাধারণ মানুষ ভাবে ইয়াছিন শিকদারের সঙ্গে সন্তোষের ভাল সম্পর্ক ছিল বিক্রি করলেও করতে পারে। কিন্তু এ কথা মনসুর, সফিক আর রহমত উল্লারা বিশ^াস করে না। ইয়াছিন শিকদার এমন কথা এলাকা রটিয়ে সুযোগ বুঝে জালদলিল বানিয়ে নেয়। এতবড় বাগানবাড়ির লোভ অন্যরা কোনভাবে সামলাতে পারে না। ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে একাধিক দলিল সৃজন করে কেউ কেউ। ততদিনে সন্তোষের আসল বাড়ি মেঘনা তলিয়ে গেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ বলে অন্তত একটা ঝামেলা চুকাল। এ বাড়ি নিয়ে অন্তত খুনোখুনি হবে না। যদিও সন্তোষের বাগানবাড়িটি নিয়ে বিভৎস হত্যাকা- হয়েছিল কয়েক দফায়। সংঘর্ষের দিন ধর্র্মপুর গ্রামের চারদিকে ছিল যেমনি উত্তেজনা তেমনি খাঁ-খাঁ নীরবতা। গ্রামের দৃশ্যপট রমিজ ও করিম হত্যার পরে ছিল এক আগে ছিল আরেক। মারামারিতে পঙ্গু হয়েছে বেশ কয়েকজন। এনিয়ে এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষ সন্তোষকে গালমন্দ দেয়। অভিশাপ দেয়। মানুষ বলে, সন্তোষ বাবু যাবার আগে একটা বড় ঝামেলা পাকিয়ে গেছেন। শুধু ঝামেলা বললে ভুল হবে। তিন গ্রামের মানুষের মাঝে ঝগড়া বাঁধিয়ে গেছেন। এ নিয়ে কয়েকদিন পরপর তিন গ্রামের মানুষে মানুষে ঝগড়া বাঁধে। যখনি ঝগড়া বাঁধে তখনি ইচ্ছে মতো গালমন্দ করেন সবাই। ইদানীং ডিসি অফিস বিরোধপূর্ণ বাগানবাড়িটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। তাও সম্ভব হয়ে উঠে না। কারণ একাধিক জালদলিলের ওপর মামলা চলছে। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাগানবাড়ি প্রশাসনের আওতায় থাকবে। পুরো দেড় একর বাগানবাড়ির চারপাশ কাঁটাতার দিয়ে বেড়া দেয়া। মূল গেটে তালা। প্রশাসনের তরফ থেকে দেয়া একজন চৌকিদার পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত ততদিন ওই বাড়ির দাবি কেউ করতে পারবে না। এমন সিদ্ধান্তে হতাশ হয় ভূমিদস্যুরা। সবাই নতুন ফন্দি আঁটতে শুরু করেন। একদিন হঠাৎ করে এক দাড়িওলা লোক এসে বাগানবাড়ির চারপাশে ঘুরতে থাকেন। দেখতে পাগল পাগল। এদিক ওদিক তাকায়। লোকটি চৌকিদারকে ডেকে বলে ও দাদা, আমার সখের বাড়িতে বেড়া দিল কারা? আমি ভেতরে যেতে চাই। চৌকিদার লোকটির চারদিকে কয়েকবার প্রদক্ষিণ শেষে বলে, আপনে কেডা? এই বাড়ি নিয়া কত মারামারি, কত খুনোখুনি। আরেকবার বইল না মিয়া। নাইলে খুন হইবা। পুরাণ পাগলের ভাত নাই, নতুন পাগলের আমদানি। যাও যাও...। এই বাড়ি নিয়া আর কোন খুন হোক এডা কেউ চায় না। -আরে দাদা। আমারে চিনবার পারেন নাই? মুক্তিযুদ্ধে জোয়ান দুই পুলারে মেলিটারিরা মাইরা ফালাইছে। চোহের সামনে বউয়ের ইজ্জত মারছে। আমি ফ্যালফ্যাল কইরা চাওন ছাড়া কিছু করবার পারি নাই। চোখের ভেতরে কতক্ষণ বাদে বাদে ভাসান দিয়ে ওঠে মিলিটারিগো অত্যাচার। যুদ্ধের পর হাঁটতে হাঁটতে পথ ভুইলা গেছি। হাঁটি একদিকে যাই আরেকদিকে। এমন কত পথ হাঁটছি সখের বাগানবাড়ির খোঁজে। এখন আর হাঁটতে পারি না। আমার বাড়িতে আমারে ঢুকবার দেন। আমার ছনের ঘরে একটু শান্তিতে ঘুমাইবার চাই। কাঁটাতার টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে চায় লোকটি। পারে না। চৌকিদার বাধা দেয়। জোরে ধাক্কা দিতে অন্তত তিন হাত দূরে গিয়ে পড়ে বৃদ্ধ লোকটি। দ্রুত ইয়াছিন শিকদারকে খবর দেয় চৌকিদার। সরকারীভাবে চৌকিদারকে নিয়োগ দেয়া হলেও মাসে মাসে উপরি কিছু মাইনে দেয় শিকদার। এ কারণে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ প্রথমে শিকদার সাহেবকে খবর পৌঁছায় চৌকিদার। পরদিন বাগানবাড়ির পাশে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির লাশ পড়ে থাকতে দেখে মানুষ। পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে লাশ ময়নাতদন্ত শুরু করে।
×