ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ বিষবৃক্ষের বিষ প্রেম

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ৫ অক্টোবর ২০১৮

বই ॥ বিষবৃক্ষের বিষ প্রেম

মুসা সাদিকের ‘বিষবৃক্ষের বিষ প্রেম’ গ্রন্থটি প্রকাশ পায় ২০১৮ সালে ভাষার মাসে। তাম্রলিপি প্রকাশনার উদ্যোগে বইটি পাঠক সমাজের কাছে আসে। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে ধ্রুব এষ। লেখক মুসা সাদিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব যিনি ’৭৫ পরবর্তী দুঃশাসনকে কোনভাবেই মানতে পারেন না। অনিবার্যভাবে তাঁর মেধাও মননে সুতীক্ষ্ম আঁচড় বসায় স্বাধীনতাবিরোধী আর স্বৈরাচারী একাধিপত্য। সঙ্গত কারণে তাঁর শৈল্পিক দ্যোতনায় অনুরণিত হতে থাকে ’৭৫ থেকে ’৯০-এর অনাকাক্সিক্ষত শাসন ব্যবস্থা তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত সমকালীন অঙ্গনের ব্যভিচার, অত্যাচার আর শোষণ-বঞ্চনার করুণ আখ্যান। ফলে গ্রন্থের রূপকার বইটি উৎসর্গ করেছেন সেই দুঃসময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিবেদিত থেকে নিজেদের প্রাণটা পর্যন্ত দিতে কুণ্ঠিত হননি সেই সব শহীদের উদ্দেশে। সেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়া মুসা সাদিক মূলত রণাঙ্গন সংবাদদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। সেই ঋদ্ধ মননবোধ আজও তাকে শাণিত করে, উদ্দীপ্ত চেতনায় শৈল্পিক সত্তা তাড়িত হয়। একজন নান্দনিক সৃজন ব্যক্তিত্ব সমাজ-সংস্কারেরও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক। প্রচলিত ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের নিত্য ঘটনাপ্রবাহ শৈল্পিক সুষমার অনুরণিত হয়ে যে সৃষ্টি সম্ভার পাঠকের সামনে হাজির তা যেমন বাস্তবোচিত একইভাবে সমাজের সফল প্রতিবেদনও। আর সেই পটভূমিতে তৈরি হওয়া আখ্যান ‘বিষবৃক্ষের বিষ প্রেম’ শুধু বঞ্চনার করুণ অভিব্যক্তিই নয় বরং অসহায় এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল নারী সমাজেরও এক অসহনীয় পরিণতি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের মা ও মেয়ের যে সর্বনাশা চিত্র অঙ্কিত হয় তা শুধু গল্পই নয় দুঃসহ জীবনের টানাপোড়েনে এক গ্লানিকর পরিস্থিতির বেদনাদায়ক পর্যায়ক্রমিক ধারাও। গল্পের নায়িকা মৌরির জন্মের আগেই বাবা শহীদ হন বর্বর পাকিস্তানীদের হাতে ’৭১-এর অস্থির সময়ের সেপ্টেম্বর মাসে। এই শহীদ পরিবারের দুই সদস্যের জীবন পরবর্তীতে কোনভাবেই সুস্থির আর নিরাপদ ছিল না। মেধাবী ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক অসঙ্গতির কারণে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি মৌরির। মার প্রতিদিনের জীবন ছিল বিধ্বস্ত। তার সঙ্গে মৌরির ভবিষ্যতও ছিল অনিশ্চিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। লেখক মূলত এখানে অর্ধাংশ নারী জাতির বিপন্ন অবস্থা, সমাজ দ্বারা নিষ্পেশিত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ সূক্ষ্ম নির্মাণশৈলীতে রূপ দিতে গিয়ে প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী থেকে রাজাধিরাজ পর্যন্ত সবাইকে এই ধরনের ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির উদঘাটক হিসেবে চিহ্নিত করতে পিছপা হননি। বিশেষ করে উঠতি বয়সের নারীরা কিভাবে অর্থবিত্তের মোহে পড়ে মূল্যবান সম্ভ্রমকেও হারাতে হয় সেই মাত্রার এক বিদগ্ধ প্রতিবেদন লেখকের শৈল্পিক দ্যোতনায় আঁচড় কাটে। পারিবারিক জীবনের অসচ্ছলতা, আর্থিক টানাপোড়েন, দৈনন্দিন জীবনের ন্যূনতম চাহিদাপূরণ তার সঙ্গে অনাগত জীবনের সম্ভাবনার দ্বার খোলা সব মিলিয়ে এসব বিপন্ন, বিপর্যস্ত নারী সমাজে ওঁৎ পেতে থাকা হরেক রকম ফাঁদে নিজেদের জড়িয়ে নেয়। শেষ অবধি সর্বনাশা প্রলয় এসে সবকিছুকে তছনছ করে দিতেও সময় নেয় না। সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা বৃহৎ প্রেক্ষাপটে যে বিষবাষ্প ছড়ায় তাতে সমাজ এবং আধিপত্যকারী সবাই বিষবৃক্ষে রূপ নিয়ে ভুক্তভোগীদের জীবন ছারখার করে দেয়। এমন ধরনের বিষকাঁটা একেবারে সমাজের গভীর থেকে উপড়ে ফেলতে হবে। যাতে সামান্য শেকড়ও অবশিষ্ট না থাকে পুনরায় সমাজকে দূষিত করার লক্ষ্যে। বিষবৃক্ষ মরণ কামড় দেয়ার আগে চারপাশকে সজাগ-সতর্ক অবস্থায় সাবধান করে সমাজকে শুদ্ধতার আবহে ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানে সমাজ সচেতন লেখকের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার যে বার্তা ধ্বনিত হয় সে পথ ধরে এগুলে আলোকিত আর নির্মল জগত তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে। মূলত মেয়েরা এই সমস্ত দুর্বিপাকের শিকার হয়, অর্থ সম্পদের আকাক্সক্ষায়ই শুধু নয় নিজেকে সমাজের বিশেষ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ থেকেও। কিন্তু এই মোহাচ্ছন্ন আবেশ থেকে বের হয়ে আসাও তেমন কঠিন কিছু নয়। অসুস্থ সমাজের ভেতরেও সুস্থতার হাতছানি থাকে। নিশ্চিত আর নিরাপদ জীবনও দুর্লভ নয়। একেবারে হাতের কাছেই। সহজ আর স্বাভাবিক পথে জীবনের গন্তব্য স্থির করা এবং নিজেকে একটি বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং ঠা-া মাথায় স্থির করা সব থেকে জরুরি। মৌরিও শেষ পর্যন্ত সেই নিশ্চিত পথকে বেছে নিতে সমর্থ হয়। বইটি অবশ্যই পাঠক সমাজে আদৃত হবে। এই করুণ আখ্যানটির বহুল প্রচার কামনা করছি। নাজনীন বেগম
×