ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শংকর লাল দাশ

ফুটবলের বিশ্ববাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১ জুলাই ২০১৮

ফুটবলের বিশ্ববাণিজ্য

১৪ জুন থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বের সার্বজনীন উৎসব ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল রাশিয়া-২০১৮। যা চলবে ১৫ জুলাই অব্দি। এক মাসের এ মহাযজ্ঞে অংশ নিচ্ছে ৩২ টি দেশ। রাশিয়ার ১১টি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে ৬৪ টি খেলা। তবে এটি শুধু খেলা নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষের মহাবন্ধনের এক মহাউৎসবও বটে। তাইতো একে বলা হয় দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। অর্থ-বাণিজ্যের দিক থেকেও বিশ্বকাপ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ববাণিজ্য। মাঠের খেলা এবং খেলার বাইরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাণিজ্যের খেলাও। বিশ্বজুড়ে এটাই খেলার ব্যবসা, বিপণনের মুক্ত ময়দান। হোক তা পণ্য কিংবা অপণ্যে। বিশ্বকাপে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৩২টি দেশ হলেও এর দর্শক পুরো পৃথিবী জুড়ে। অন্তত চার শ’ কোটি মানুষ পর্দায় খেলা দেখছে। তাই, এ বিপুল সংখ্যক দর্শক টার্গেট করে চলে নানামুখী বাণিজ্য। ফিফার র‌্যাংকিং অনুযায়ী আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৭। বিশ্বকাপে অংশ নেয়া আমাদের জন্য সুদূরপরাহত। অথচ আমাদের তৈরি জার্সি গায়ে জড়িয়ে মাঠে নামছে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার মতো অনেক দল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থকরাও বাংলাদেশে তৈরি জার্সি ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে আমরাও জড়িয়ে পড়েছি বিশ্বকাপ ফুটবলে। এভাবে অনেক দেশই বিশ্বকাপের অর্থ-বণিজ্যে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে কি পরিমাণ অর্থ লেনদেন হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা প্রকৃত অর্থেই কঠিন কাজ। মোটা দাগে প্রত্যক্ষভাবে দেখা বিশ্বকাপের বিশ্ববাণিজ্যের কিছু পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা গেলে হয়তো এর গভীরতা কিছুটা হলেও আন্দাজ করে নেয়া যেতে পারে। যেমন আয়োজক দেশ রাশিয়া এবার বিশ্বকাপে মাত্র কয়েকটি খাতে বিনিয়োগ করেছে ১৯০ কোটি ডলার। যদিও ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ব্রাজিল বিশ্বকাপের তুলনায় এ বিনিয়োগ খুবই কম। ব্রাজিল বিনিয়োগ করেছিল দেড় হাজার কোটি ডলার। রাশিয়ার বিনিয়োগ করা অর্থের বেশির ভাগ ব্যয় হবে ১১টি শহরে ম্যাচ আয়োজনে। যার পরিমাণ ৬২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। পুরস্কার মূল্য হিসেবে ব্যয় হবে ৪০ কোটি ডলার। টিভি প্রডাকশনে ব্যয় হবে ২৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাকিটা খরচ হবে কিংবা হয়েছে যোগাযোগ ও পর্যটন খাতের উন্নয়নসহ অন্যান্য কয়েকটি খাতে। এর বিনিময়ে রাশিয়া আশা করছে কম করে হলেও বিশ্বকাপ উপলক্ষে ৫০ লাখ পর্যটকের আগমন হবে। এদের কাছ থেকেই বিনিয়োগের বড় একটি অংশ উঠে আসবে। বিশ্বকাপ পর্যটন বাণিজ্যের অন্যতম অংশ। ব্রাজিল ২০১৪ এর বিশ্বকাপ আয়োজন থেকে কেবলমাত্র পর্যটন খাতে এক হাজার এক শ’ কোটি ডলার আয় করে। যা ২০১০ এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের চেয়ে বিশগুণ বেশি। ব্রাজিল টিভি নেটওয়ার্ক থেকে আয় করে ৬০০ মিলিয়ন ডলার। রাশিয়া পর্যটন ও টিভি নেটওয়ার্ক দুটি খাত থেকেই আরও বেশি আয়ের আশা করছে। বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে চারদিকে এখন বিপণনের তুমুল ঝড়। বিভিন্ন গ্লোবাল ব্র্যান্ড ফুটবলপ্রেমীদের মন জয়ের চেষ্টায় নিচ্ছে নানা কৌশল। গ্লোবাল ব্র্যান্ডের ঝানু ব্যবসায়ীদের কেউই চান না মোক্ষম এ সুযোগ হাতছাড়া করতে। এটি শুধু বিশ্বকাপ জয়ের খেলা নয়, গ্রাহকের নজর কাড়তে বিপণনকারীদেরও অঘোষিত লড়াই। এ্যাডিডাস, কোকাকোলা, ভিসা কন্টিনেন্টাল ও ম্যাকডোনাল্ডস ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে সাড়ে ৫০০ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেছে ফিফার অফিশিয়াল পার্টনারশিপে। এবার নিশ্চিত এর পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এ মহাউৎসব প্রকৃতপক্ষেই ফুটবলের মাধ্যমে ব্র্যান্ড পরিচিতি ঘটানোর এক বিশাল মঞ্চ। তাই বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলো তাদের বিপণন কৌশল নিয়ে গবেষণা শুরু করে অনেক আগে থেকে। ৪০০ কোটি টিভি দর্শক আর সে সঙ্গে ডিজিটাল ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রচার ও প্রসারের জন্য এ আসর যথার্থ অর্থে এক সুবর্ণ সুযোগ। শুধু কি খেলা। অবাধ মুক্ত বাণিজ্যের এ যুগে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলগুলোও হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক পণ্য। তাইতো প্রতিটি দলকে নিক্তি দিয়ে মাপা হয় অর্থনীতির নিরিখে। যেমন ব্রাজিল জাতীয় দল এ মুহূর্তে সবচেয়ে দামী টিম। ব্রাজিল জাতীয় দলের বর্তমান মূল্য ৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চার বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপে বিশ্বের সবচেয়ে দামী টিম ছিল স্পেন। যার মূল্য ছিল ৮৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এ বছর স্পেনের অবস্থান চতুর্থ। যার মূল্য ৭৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। চার বছর আগে ব্রাজিল টিমের মূল্যমান ছিল ৬৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। মূল্যমানের দিক থেকে এবার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। যার মূল্য ৭৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। চার বছর আগে জার্মান দলের মূল্য ছিল ৭৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। ধনী টিমের তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছে ফ্রান্স। চার বছর আগে ফ্রান্সের মূল্য ছিল ৫৫ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এবার এর দাম বেড়ে হয়েছে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ধনী টিমের তালিকায় আর্জেন্টিনার অবস্থান পঞ্চমে। ২০১৪ সালে এর অর্থনৈতিক মূল্য ছিল ৫৩ কোটি ৯ লাখ ডলার। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ কোটি ডলার। বেলজিয়াম ২০১৪ সালে ৪৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার থেকে এবার ৬২ কোটি ডলার পৌঁছে ধনী টিমের তালিকার ষষ্ঠ স্থান নিয়েছে। ইংল্যান্ড ২০১৪ সালে ৪৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার নিয়ে ধনী টিমের তালিকার সপ্তমে ছিল। এ বছর মূল্য কমে ৪১ কোটি ৭০ লাখ ডলার হয়েছে। এরপরও তালিকার একই স্থানে রয়েছে। ধনী টিম ও পুরস্কারের অর্থ মূল্যের পাশাপাশি দলের কোচদের খাতেও অর্থ বিনিয়োগের পরিমাণ লাফিয়ে বেড়েছে। একেকজন কোচ অবিশ্বাস্য অঙ্কের অর্থ পাচ্ছেন। কোচদের শীর্ষে আছেন জার্মানির জোয়াকিম লো। যার পারিশ্রামিক ৪৪ লাখ ডলার। এরপরে যথাক্রমে ব্রাজিলের তিতে ৪২ লাখ ডলার। ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশ ৪২ লাখ ডলার। রাশিয়ার স্তানিস্লাভ চের্চেসব ২৯ লাখ ডলার। পর্তুগালের ফের্নান্দো সান্তোস ২৬ লাখ ডলার। ইরানের কার্লোস কুইরোজ ২২ লাখ ডলার। ইংল্যান্ডের গ্যারেট সাউথগেট ২২ লাখ ডলার। আর্জেন্টিনার হোর্খে সাম্পাওলি ২১ লাখ ডলার। উরুগুয়ের অস্কার তাবারেজ ২০ লাখ ডলার। মিসরের এক্তর কুপার ১৮ লাখ ডলার। বিশ্বকাপে অংশ নেয়া খেলোয়াড়দের অধিকাংশই বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার কারণে ক্লাবগুলোকে তাই ফিফাকে অর্থ দিতে হয়। এর পরিমাণটাও নিয়াহত কম নয়। যেমন এবার বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার জন্য ফিফাকে রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবকে সর্বোচ্চ ৩৯ লাখ ডলার দিতে হবে। অন্যান্য ক্লাবগুলোর মধ্যে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি ৩৮ লাখ ডলার, চেলসি ৩৫ লাখ ডলার, বার্সেলোনা ৩২ লাখ ডলার, প্যারিস সাঁ জা ৩২ লাখ ডলার, টটেনহ্যাম ৩১ লাখ ডলার, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ২৭ লাখ ডলার, মোনাকো ২৭ লাখ ডলার, বায়ার্ন মিউনিখ ২৫ লাখ ডলার এবং আর্সেলান ২৩ লাখ ডলার ফিফার কাছ থেকে পাবে। বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার জন্য একেকটি দেশের ফুটবল ফেডারেশনকেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। বিশেষ করে দলের অনুশীলন খাতে। এটাকে এক ধরনের বিনিয়োগ বলা যেতে পারে। আর্জেন্টিনা দলের প্রস্তুতি খরচে চোখ বোলালে অন্যান্য দলের অবস্থা কমবেশি বোঝা যাবে। গত বছর এদগার্দো বাউজাকে সরিয়ে হোর্খে সাম্পাওলিকে আর্জেন্টিনার কোচ করা হয়। সাম্পাওলির সঙ্গে তখন ৩৫ লাখ ডলারের চুক্তি করে ফেডারেশন। শুধু তার জন্য নয়, টানা খরচ বহন করতে হচ্ছে সাম্পাওলির সাপোর্ট স্টাফদের জন্যও। সব মিলিয়ে গত দু’বছরে আর্জেন্টিনা ৮৬ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে ফুটবলের জন্য। তার মধ্যে আছে বুয়েন্স আয়ার্সে অত্যাধুনিক এজেইজা কমপ্লেক্স তৈরি করা। বার্সেলোনা আসার আগে এখানে চলে মেসিদের শিবির। এর জন্য ২৩ কোটি পেসো খরচ হয়েছিল। আর্জেন্টিনার ফেডারেশনের কোষাগার যেখানে ক্ষয়িষ্ণু, সেখানে এ অর্থ বিশাল চাপ তৈরি করতে বাধ্য। দেশের আর্থিক অবস্থাও সে রকম ভাল নয়। বার্সেলোনায় মেসিরা ছিলেন বিলাসবহুল প্রিন্সেস সোফিয়া হোটেলে এবং প্রাকটিস করেছেন বার্সেলোনার কমপ্লেক্সে। মস্কোর উপকণ্ঠে ব্রনিৎসির যে শিবিরে আর্জেন্টিনা টিম রয়েছে, তার অনেক কিছুই তৈরি করা হয়েছে সাম্পাওলি এবং সাপোর্ট স্টাফরা যে ভাবে চেয়েছেন সেভাবে। নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্বকাপ শিবিরে থাকার কিছুটা খরচ ফিফা বহন করে। কিন্তু টিমগুলো অনেক সময়ে বাড়তি খরচ করে কিছু বানিয়ে নেয় বিশেষ সুবিধার জন্য। এ শিবিরের জন্য আর্জেন্টিনাকে ২০ লাখ ডলার খরচ করতে হচ্ছে। বিমানযাত্রার ক্ষেত্রেও বিশাল খরচ করে ফেলেছে মেসির দেশ। আমেরিকান রকব্যান্ড রোলিং স্টোনের প্রাইভেট জেট ভাড়া করেছে তারা। এতে খরচ হয়েছে ৯ লাখ ডলার। শুধু টিম নয়। আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমি মানুষদের পিছনেও প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছে। দেশের অনেক ব্যাংক বিশ্বকাপে রাশিয়া যাওয়ার জন্য সমর্থকদের ঋণ দিয়েছে। সাত বছরের মেয়াদে তার ইন্টারেস্ট রেট অনেক সময়েই ৩০-৪০ শতাংশ। এর থেকে বোঝা যায় বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দেশগুলো অকাতরে কিভাবে অর্থ খরচ করেছে। অংশ নেয়া দেশগুলোর পাশাপাশি রয়েছে ফিফার আয়-ব্যয়। যা পৃথিবীর বহু দেশের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি। ফিফা বিশ্বকাপ মানে অর্থের ঝলকানি। দৃশ্য-অদৃশ্য অসংখ্য খাত-উপখাতে বানের পানির মতো অর্থ উপচে পড়ে। টিভি দর্শকদের ড্রয়িংরুমের পানাহারেও যে অর্থ ব্যয় হয়, তাও তো বিশ্বকাপেরই অংশ। তাইতো বিশ্বকাপ মানেই বিশ্ববাণিজ্য।
×