ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

রাজনীতিকদের অসুস্থতা এবং অসুস্থতার রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২০ জুন ২০১৮

রাজনীতিকদের অসুস্থতা এবং অসুস্থতার রাজনীতি

কারাগারে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবরে দেশের মানুষ অবশ্যই শঙ্কাবোধ করবে। জেলের ভিতর তার ভাল-মন্দ কিছু একটা হলে সে জন্যে সরকারও দায়ভাগি হবেন। বেগম জিয়া কোন সাধারণ কারাবন্দী নন। তিনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেত্রী এবং তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি যদি এক এগারোর সরকারের আমলে সাবজেলে রাজনৈতিক বন্দী হতেন (শেখ হাসিনাও ছিলেন) তাহলে আমার প্রথম দাবি হতো তার অসুস্থতা গুরুতর হোক আর না হোক তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া, তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। রাজনৈতিক বন্দীকে সুস্থ অবস্থাতেও কারাগারে না রেখে অভিজাত বাসভবনে রাখার বহু নজির ব্রিটিশ ভারতেও আছে। মহাত্মা গান্ধী মুক্ত অবস্থায় প্রায়শ থাকতেন বিড়লা ভবনে। আর ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করলে অধিকাংশ সময়ে রাখা হতো আগা খাঁর প্রাসাদে। এই ধরনের নজির বর্তমান বাংলায় এক এগারোর সরকারও স্থাপন করেছেন। তারা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও বিএনপি নেত্রী দুজনকেই গ্রেফতার করেছেন। কিন্তু সাধারণ জেলে না রেখে জাতীয় সংসদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের বাসভবনকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে আটক রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। বর্তমানে দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপি নেত্রী রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে জেলে যাননি। তিনি দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক দ-িত অপরাধী হিসেবে জেলে গেছেন। এক্ষেত্রে তাকে সাধারণ জেলে না পাঠিয়ে আগের মতো কোন প্রাসাদোপম বাড়িতে নজরবন্দী রাখার সুযোগ নেই। ভারতে মোরারজী দেশাইয়ের জনতা সরকার নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে আদালত দ- দেয়। তাকে মহাত্মা গান্ধীর মতো রাজনৈতিক বন্দীর সম্মান দিয়ে কোন প্রাসাদে রাখার বদলে তিহরি জেলের মতো অত্যন্ত খারাপ জেলে হাতকড়া পরা অবস্থায় পাঠানো হয়। জেলে অবশ্য তাকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তিনি তা নেননি। তার পাসপোর্টও জনতা সরকার আটক করেছিল। বাংলাদেশে প্রায় অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন পতিত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু বিএনপি নেত্রীর ব্যক্তিগত রোষ থেকে বাঁচতে পারেননি। আওয়ামী লীগ নেত্রী এরশাদ হঠাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে হটালেও তার প্রতি কোন ব্যক্তিগত রাগ শেখ হাসিনার ছিল না। স্বৈরাচারী এরশাদের প্রতি এই রাগ শেখ হাসিনারই থাকার কথা ছিল। চট্টগ্রামের জনসভায় শেখ হাসিনার প্রতি এরশাদের এক পুলিশই সরাসরি গুলি করে তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। এই পুলিশ অফিসারকে শাস্তি না দিয়ে রাষ্ট্রপতি এরশাদ তাকে চাকরিতে প্রমোশন দিয়েছিলেন। ক্ষমতাহারা হওয়ার পর দশ বছর যিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হলে আওয়ামী লীগের সম্ভবত ইচ্ছা ছিল তাকে আদালতের বিচারে দন্ডিত হওয়ার আগে জেলে না পাঠিয়ে তার নিজের বাড়িতেই নজরবন্দী করে রাখা। কিছুদিন তাই করা হয়েছিল। কিন্তু একথা এখন সকলেরই জানা যে, বেগম জিয়ার প্রচন্ড রোষ ও দাবির মুখে জেনারেল এরশাদকে ঢাকা জেলে পাঠাতে হয়। অবশ্য তার জেল কক্ষে এয়ার কন্ডিশন, টেলিভিশন ইত্যাদিসহ সর্বপ্রকার সুখ-সুবিধা দেয়া হয়। তখন হয়তো বেগম জিয়া ভাবেননি তাকেও একদিন দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে এই কারাগারে যেতে হবে এবং একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে দেয়া সুখ-সুবিধাগুলো তাকে কারা যন্ত্রণা থেকে বাঁচাবে। এরশাদ ও খালেদা জিয়া এই দুজনের আগে আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকও দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে ঢাকা জেলে ছিলেন। কিন্তু তাকে এসব সুখ-সুবিধা দেয়া হয়নি। কারাগারে বেগম জিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেনা শিবিরে একজন সেনা-কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে দীর্ঘকাল বসবাসের সময় তার যে লাইফ স্টাইল ছিল এবং ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বাস করাকালেও যে লাইফ স্টাইল তিনি বর্জন করেননি, তাতে তার দলের ঘনিষ্ঠ কোন কোন চিকিৎসক নাকি তাকে সাবধান হতে বলেছিলেন। তিনি হননি। তাকে হাঁটু রিপ্লেসমেন্টের জন্য সৌদি আরবে যেতে হয়েছিল। তার হাঁটু ভাল হয়নি। তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন এবং জনসভার মঞ্চেও নিচু হয়ে বসতে না পেরে উঁচু আসনে বসেন। আকস্মিকভাবে স্বামীর নির্মম হত্যাকান্ডে, একপুত্রের বিদেশে পলাতক অবস্থায় বছরের পর বছর অবস্থান, আরেক পুত্রের দুর্নীতির দন্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে মৃত্যু, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ, ক্ষমতাহারা হওয়ার পর দলে কোন্দল ও ভাঙ্গন, দলের দোসর জামায়াতীদের প্রাণদন্ড ঠেকাতে না পারা, আন্দোলনের নামে রাজপথে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া, তার এবং তার ছেলেদের নামে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অসংখ্য মামলা বাইরের দিক থেকে না হলেও মনের দিক থেকে তাকে নিশ্চয়ই নিঃস্ব করে ফেলেছে। এবার গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তা তার হাঁটাচলা লক্ষ্য করলেই বোঝা যেতো। এখন দীর্ঘ পাঁচ বছরের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে এবং দলের ভাঙ্গা দশা দেখে তিনি যদি জেলের ভেতরে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও ভেঙ্গে পড়ে থাকেন তাহলে বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই। জেলের ভেতরে বা বাইরে হাসপাতালে তার উপযুক্ত চিকিৎসা হওয়া দরকার। এটা হবে সরকারের দিক থেকে মানবিক ও দায়িত্বশীল আচরণ। তবে বিএনপির দলীয় নেতারা ও দলীয় চিকিৎসকরা তাদের নেত্রীর অসুস্থতা সম্পর্কে অসত্য কথা না বললেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা যে অতিরঞ্জিত করছেন তা সহজেই বোঝা যায়। বেগম জিয়া পাঁচ সাত মিনিটের জন্য জেলের ভেতরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন (বিএনপির চিকিৎসকেরা দাবি করেছেন মাইল্ড স্ট্রোক) তা কারা কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেননি। সঙ্গে সঙ্গে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিতে চায় সরকার। এই হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত। কিন্তু বিএনপি নেত্রী এবং তার দল তাতে রাজি নন। তারা তাদের পছন্দের বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা চান। এখানেই প্রশ্ন, খালেদা জিয়ার অবিলম্বে চিকিৎসা দরকার। তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞান হননি এবং তার মাইল্ড স্ট্রোক হয়নি বলে অন্য ডাক্তাররা বলছেন। এই অবস্থায় কারাবিধি মেনে সরকার বিএনপি নেত্রীকে কারাগারের বাইরে চিকিৎসা দিতে চাইলে তাতে দলটির এত আপত্তি কেন? দলনেত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে থাকলে তার অবিলম্বে সুচিকিৎসা প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনকে অবজ্ঞা করে পছন্দের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু করার উদ্দেশ্যটা কি? আইজি প্রিজন সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী সর্বোচ্চ সরকারী প্রতিষ্ঠান। যদি সেখানে বেগম জিয়ার চিকিৎসা বিষয়ে কোন সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকে, তাহলে বেসরকারী হাসপাতালে নেয়ার প্রশ্ন আসে।’ সরকার অথবা কারা কর্তৃপক্ষের এই স্পষ্ট বক্তব্যের পর বুঝতে বাকি থাকে না যে, ‘গুরুতর অসুস্থ’ নেত্রীর আশু চিকিৎসা বিএনপি নেতাদের আসল লক্ষ্য নয়; আসল লক্ষ্য পছন্দের হাসপাতালে তাকে নেয়া নিয়ে একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে পানি ঘোলা করা। বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিশেষ মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তারা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। তারপরও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর জেলে ফেরত পাঠানো হয়। তারপর এই অভিযোগ তোলা কি সঙ্গত যে, তার চিকিৎসার ব্যাপারে অবহেলা করা হচ্ছে? আসল কথা, বেগম জিয়া কোন রাজনৈতিক বন্দী নন। তিনি দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক দ-িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী। স্বভাবতই তার মুক্তির দাবিতে দলীয় আন্দোলনে দেশের মানুষ সাড়া দেয়নি। বিএনপিও কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে দেশী সুশীল সমাজ ও বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে ধর্ণা। তাতেও কোন কাজ হয়নি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা ঢাকা সফরের সময় সাফ বলে দিয়েছেন, আদালতের রায় সম্পর্কে তারা কোন কথা বলতে চান না এবং সে এখতিয়ার তাদের নেই। বেগম জিয়াকে জেল মুক্ত করার ব্যাপারে দেশে বিদেশে সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন শুরু হয়েছে তাকে গুরুতর অসুস্থ সাজিয়ে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা এবং তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হলেও পছন্দের হাসপাতালে নেয়ার নামে একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা। বেগম জিয়া যে অসুস্থ, শারীরিক ও মানসিকভাবে তাতে সন্দেহ নেই। তার চিকিৎসা দরকার। সরকার এই ব্যাপারে কর্তব্যে অবহেলা করছেন না। যদি বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের চিকিৎসায় তার স্বাস্থ্যের উন্নতি না ঘটে, তাহলে তাকে তার পছন্দের বেসরকারী হাসপাতালে নেয়া যেতে পারে। কারা কর্তৃপক্ষও সে কথা বলেছেন। পছন্দের হাসপাতালে যদি তার রোগ উপশম না হয় তাহলে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বিদেশের হাসপাতালেও পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু বিএনপি’র পাঁতি নেতাদের হৈচৈ দেখে মনে হয় তাদের নেত্রীর চিকিৎসা আসল লক্ষ্য নয়, আসল লক্ষ্য আগেই বলেছি নির্বাচনের আগে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করা। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলি, বেগম জিয়ার প্রতি কোন প্রকার কটাক্ষ না করে (কারণ তিনি যে অসুস্থ তা আমি বিশ্বাস করি) বলছি, আজকাল একশ্রেণীর নেতা কারণে বা অকারণে জেলবন্দী হলেই হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতাকে অনেকে নাম দিয়েছেন ‘রাজনৈতিক অসুস্থতা’। আবার একশ্রেণীর ডাক্তারও বেরিয়েছেন, যারা দলীয় স্বার্থে সঙ্গে সঙ্গে সার্টিফিকেট দেন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতা সত্যি সত্যিই গুরুতর অসুস্থ। এই সার্টিফিকেটকে ভিত্তি করে ‘গুরুতর অসুস্থ নেতা’ বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান। বেগম জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান জেলে ‘গুরুতর অসুস্থ’ হয়ে পড়েছেন ‘জাতীয়তাবাদী’ ডাক্তারদের এই সার্টিফিকেটের জোরে এক এগারোর সরকারের আমলে জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে চলে আসেন এবং আজ প্রায় দশ বছর হয় তিনি দেশে ফেরেননি, এখনও নাকি তার চিকিৎসা চলছে। অথচ লন্ডনে তিনি নিয়মিত রাজনৈতিক সভা করেন। সুট কোট টাই পরে বাপের মতো চোখে চশমা লাগিয়ে সুস্থ মানুষের চাইতেও সুস্থভাবে বক্তৃতা করেন। অথচ রাস্তা ঘাটে দেশের লোক দেখলেই খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেন। ঢাকায় আমার সাংবাদিক জীবনের একটি রহস্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলি, যে রহস্য থেকে আমি এখনও মুক্ত হইনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল পরের কথা। তখন বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতায়। মওলানা ভাসানী হঠাৎ ঢাকার মতিঝিলে ন্যাপের (ভাসানী) তখনকার অফিসে অবস্থান নেন এবং কয়েকটি দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য চরম বিব্রতকর অবস্থা। মওলানা ভাসানীকে তিনি পরমশ্রদ্ধা করতেন এবং এক সময় তার নেতৃত্বে রাজনীতি করেছেন। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ন্যাপ অফিসে যাবেন। মওলানার সঙ্গে তার দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করবেন এবং তাকে নিজ হাতে সরবত খাইয়ে অনশন ভাঙ্গাবেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন তখনকার চীনপন্থী এবং ভারতবিরোধী নেতারা যেমন জাদু মিয়া, কাজী জাফর প্রমুখ পেছন থেকে উস্কিয়ে মওলানা সাহেবকে দিয়ে এই কাজটা করিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ন্যাপ অফিসে যান। কিন্তু তার পথরোধ করেন কাজী জাফর ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। পুলিশ চাইছিল লাঠি পেটা করে এই অবরোধ ভাঙ্গতে। বঙ্গবন্ধু নিষেধ করেন এবং গণভবনে ফিরে আসেন। এর দু’দিন পর পুলিশ ন্যাপ অফিসে গিয়ে মওলানা ভাসানীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে এবং তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। এই সময় আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে বিস্মিত হই। অনশনরত মওলানা সাহেবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তখন তিনি ভাসানী ন্যাপের সমর্থক। অন্যদিকে মওলানা সাহেবের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন প্রয়াত ডা. নূরুল ইসলামও। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। এই দুই ডাক্তার নিয়মিত মওলানা ভাসানীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর যে বুলেটিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো তা ছিল পরস্পর বিরোধী। ডা. নূরুল ইসলামের বুলেটিনে বলা হতো, ‘মওলানা সাহেবের অনশনের চতুর্থ বা পঞ্চম দিবসেও তার শরীরের অবস্থা ভাল। শরীরের ওজন কমেনি, স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেনি। ‘ডা. বদরুদ্দোজার বুলিটিনে বলা হতো, ‘মওলানা সাহেবের শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতিশীল। তার শরীরের ওজন হ্রাস পাচ্ছে।’ এই দু’টি বুলিটিনই তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো এবং আমি তা পাঠ করে ভাবতাম, দুই চিকিৎসকই বিলাত ফেরত নামকরা ডাক্তার। তাদের কার কথায় বিশ্বাস রাখি? এই ব্যাপারে দু’জনের কাছে জিজ্ঞাসা করলে কী জবাব পাব তা আমি জানতাম, পেশার ক্ষেত্রে দু’জনেই ছিলেন পরস্পরের প্রচ- বিরোধী। ঢাকায় থাকাকালে আমার এই অভিজ্ঞতার কথাটা লিখলাম কারও প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য নয়। বর্তমানের ‘জাতীয়তাবাদী’ চিকিৎসক ও ‘জাতীয়তাবাদী’ আইনজীবীদের কান্ডকীর্তি দেখে অতীতের এই অভিজ্ঞতার কথাটি স্মরণে উদিত হলো, তাই লিখলাম। যদি কারও মনে আঘাত লাগে সে জন্যে আগেই মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির আমি সমর্থক নই, তাই বলে তার শারীরিক অমঙ্গল কামনা করব, এতোটা নিচু মনের মানুষ আমি নই। প্রার্থনা করি, তিনি অচিরেই সম্পূর্ণ সুস্থ হন, তার চিকিৎসার আরও সুব্যবস্থা হোক। বিএনপি’র পাঁতি নেতা ও ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের এই অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি চর্চা যেন ব্যর্থ হয়। নেত্রীকে ‘গুরুতর অসুস্থ’ সাজিয়ে তার মুক্তি না হলে নির্বাচন বর্জন অথবা বানচালের চক্রান্ত যেন সফল না হয়। [লন্ডন, ১৯ জুন, মঙ্গলবার,২০১৮]
×