ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সত্যজিৎ রায়, ডি জে কিমার এবং আমানুল হক

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৪ এপ্রিল ২০১৮

সত্যজিৎ রায়, ডি জে কিমার এবং আমানুল হক

বেঁচে থাকলে এই মে’র দুই তারিখে বয়স হতো সাতানব্বই। সত্যজিৎ রায়Ñ। ভিত্তিরিও ডি সিকার ‘দি বাইসাইকেল থিভস’-এ আলোড়িত হয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে ঝড় তুলেছিলেন। জীবনের গভীর সত্যকে সাদামাটা অথচ অসাধারণ নৈপুণ্যে যেভাবে সেলুলয়েড বন্দী করেছেন ডি সিকা তা-ই ‘পথের পাঁচালী’ নিমার্ণের সিদ্ধান্তে প্রতিজ্ঞা করেছিল সত্যজিৎকে। সূত্র ছিল সম্ভবত আম আঁটির ভেঁপু, পথের পাঁচালীর সদ্য লেখা কিশোর সংস্করণ। এর অলঙ্করণের দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁর ওপর। কিশোর সংস্করণ তো নয়ই, মূল বই-ই তখনও পড়েননি তিনি। ওই অলঙ্করণের সূত্রে পড়া, মুগ্ধ হওয়া এবং চলচ্চিত্রের আবছা কাঠামো মনে গেঁথে নেয়া। তারও আগে পরিচয় হয়ে গেছে বিশ্ব বিখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে। শান্তিনিকেতনে ফাইন আর্টস চর্চার পাট চুকিয়ে সত্যজিৎ তখন কলকাতায় ডি জে কিমার নামে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ নিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশের মতো বিখ্যাত কবি- সাহিত্যিকদের প্রতিকৃতি দিয়ে বিজ্ঞাপনের সিরিজ করছেন। সে সব প্রতিকৃতি সে সময়ে বাঙালী পাঠকের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল। সিগনেট প্রেসের বইয়ের জন্য এঁকেছেন জর্জ বার্নাড শ, টিএস এলিয়টের প্রতিকৃতি। কার্ল মার্কস, আকিরা কুরোসাওয়ার মতো ভিন্ন মেরুর ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতিও বাদ যায়নি। এমনই এক সময় কলকাতায় জাঁ রেনোয়া আসেন তার ‘দি রিভার’ ছবির শূটিংয়ের জন্য। সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে সত্যজিৎ যান শূটিং দেখতে। এই দুর্লভ সুযোগে ছেদ পড়ে অফিস থেকে হঠাৎই ছয় মাসের জন্য বিলেত যাওয়ার নির্দেশে। স্ত্রীকে সঙ্গী করে বিলেতের জাহাজ ধরেন উনিশ শ’ পঞ্চাশে। ওই যাত্রা বিশ্ব চলচ্চিত্রের দুয়ার খোলে সত্যজিতের সামনে। বাইসাইকেল থিভসের সঙ্গে পরিচয়ও তখনই। রেনোয়ার শূটিং দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ঘুচল আরও বড় প্রাপ্তিতে। বিলেত যাওয়ার পথে জাহাজেই আম আঁটির ভেঁপুর অলঙ্করণ করেন। এদিকে কলকাতায় রেনোয়ার ‘দি রিভার’-এ শিল্প নির্দেশকের কাজ করছেন বন্ধু বংশী চন্দ্র গুপ্ত। আর সিনেমাটোগ্রাফির অপরিসীম ক্ষিধে নিয়ে চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্র শূটিংয়ের ‘অবজারভার’ হওয়ার অনুমতি পান রেনোয়া থেকে। সত্যজিৎ সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন এসব তাদের জানা তথ্য। সত্যজিৎ-বংশী-সুব্রতÑ এই ত্রয়ীর হাতে জন্ম চলচ্চিত্র ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ‘অপু ট্রিলজি’। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় রুশ কথাসাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির জীবন নিয়ে তৈরি ঈযরষফযড়ড়ফ গধীরস এড়ৎশর ট্রিলজির পাশেই অপু ট্রিলজির স্থান। ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র দর্শকের হৃদয় থেকে এ দুই ট্রিলজির আবেদন কোনদিন হারাবার নয়। ডি সিকা যেমন জানেননি তার বাইসাইকেল থিভস ভবিষ্যতের এক চলচ্চিত্র দিকপালের উন্মেষ ঘটাবে, রেনোয়াও বোঝেননি ‘দি রিভার’ সেই উন্মেষকে শানিয়ে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করবে। প্রথম ছবি পথের পাঁচালী নির্মাণ করলেন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বংশী চন্দ্র গুপ্ত ও সুব্রত মিত্রর দি রিভারের অভিজ্ঞতা নিয়েই। অন্য কারণের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’ অমর হয়ে আছে প্রাকৃতিক আলো ব্যবহারের অভিনবত্বের জন্য। সত্যজিৎ যাকে বলেছেন ঝযধফড়ষিবংং ফরভভঁংবফ ষরমযঃ. ক্যামেরায় আলো-ছায়ার খেলার এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি ও সুব্রত মিত্র মিলে। এ কথা সবাই জানেন যে, নিজের চলচ্চিত্রের সংলাপ থেকে শুরু করে সেট, সাউন্ড, মিউজিক, লাইটিং, কস্টিউম ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি সবকিছুর ডিজাইন সত্যজিৎ নিজে করতেন। প্রতিটি বিষয় চুলচেরা বিশ্লেষণে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনা ছিল তার সহজাত। শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল বলেই হয়ত তার চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত হয় এক পরিপূর্ণ শুদ্ধ শিল্পকর্ম। সত্যজিৎ রায়ের জীবনের কিছু অসাধারণ মুহূর্ত আলোর ফ্রেমে বেঁধেছেন আরেক সৃজনশীল শিল্পী আমানুল হক, সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। এক অন্য সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আমানুল তাঁর ‘প্রসঙ্গ সত্যজিৎ ছবি ও কথা’ বইয়ে। সত্যজিৎ ভক্তদের কাছে এ এক বিরাট পাওয়া। সত্যজিৎকে আমানুল যেমন তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতায় পরিমাপ করতে পেরেছিলেন সত্যজিৎও তাঁর সহজাত শিল্পীসত্তা দিয়ে আমানুলের চৈতন্যের গভীরের শিল্পীর খোঁজ পেয়েছিলেন। বইয়ের বিভিন্ন লেখায়, চিঠিতে তার অজস্র প্রমাণ রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ রফিকের গুলিবিদ্ধ মাথার ঘিলু বেরিয়ে আসার দৃশ্য ধারণ করার অপরাধে শাসকগোষ্ঠীর নানা নিপীড়নের মুখে বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়েন। চলে যান কলকাতায় এবং সেখানে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আলাপ তাকে এক অন্য দৃষ্টি দেয়। সে কথা বলেছেন তিনি তার এ বইয়েÑ ‘তখনকার চাকরিচ্যুত আধা-বেকার জীবনে সাধ্যমতো গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলতাম আর হাতে কিছু টাকা-পয়সার সংস্থান হলে কলকাতায় চলে যেতাম। ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকাগোষ্ঠীর শনিবারের আড্ডায় সম্পাদক অনিক সিংহ, পূর্ণেন্দু পত্রী, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গুণীজনের সাহচর্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের প্রস্তুতি পর্বে দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি এবং আমার তোলা কিছু ছবি নিয়ে একদিন বিলেতী বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি জে কিমারে উপস্থিত হলাম। কিমারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা ছবিগুলো খুব আগ্রহের সঙ্গে দেখলেন, এক পর্যায়ে খুব লম্বা অচেনা এক ব্যক্তি তাঁর ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেই যথেষ্ট মনোযোগসহকারে আমার ছবিগুলো দেখলেন। পরে জেনেছিলাম তিনিই সত্যজিৎ রায়।... ১৯৬০-এর কোন এক রবিবার কলকাতার ‘ভারতী’ সিনেমা হলে সকালের বিশেষ প্রদর্শনীতে ডি সিকার ঊাবৎুফধু রং ধ ঐড়ষরফধু ছবির শো শেষে হল থেকে বেরুবার মুখে আমার পাশেই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, একই পোশাকে পাশাপাশি তিনজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলামÑ বংশী চন্দ্র গুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সত্যজিৎ রায় আমার চোখের সামনেই দ-ায়মান! ওই একই পোশাকে আমি এক বামন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি।’ পথের পাঁচালী ও পোস্ট মাস্টারের লোকেশন বিখ্যাত বোড়াল গ্রামের স্মৃতিচারণ করে আরেক জায়গায় বলছেন, ’৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘পোস্ট মাস্টার’ নির্মাণকালে সেই বোড়াল গ্রামে গিয়ে আমি তীর্থ দর্শনের অনুভূতি লাভ করেছি। আজ এত বছর পর যখন পেছন ফিরে তাকাই, মনে হয় আমার জীবন ধন্য হয়েছে। আমি বোড়ালে গিয়ে সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ একটি প্রতিকৃতি তুলতে পেরেছি।... দুপুরে শূটিংয়ের অবকাশে পোস্ট অফিসের বারান্দায় মাটিতে বসে শিস দিয়ে গানের সুর তুলছেন সত্যজিৎ বৃষ্টির ঝর ঝর ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। গ্রামের এই ‘পোস্ট অফিস’ আসলে একটি চালা ঘরের পরিবর্তিত রূপ। চঙঝঞ ঙঋঋওঈঊ লেখা সাইন বোর্ড, আর একটি খবঃঃবৎ ইড়ী ছাড়া বাইরে থেকে বুঝবার মতো আর কোন কিছুই নেই। ছনের চালা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টির ধারা। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দৃশ্যমান প্রলম্বিত জলধারা ক্যামেরার ছবিতে এই দৃশ্য কি তুলে ধরা যায় সহজে?’ যায় কি যায় না তা নিয়ে আলোকচিত্র বিশেষজ্ঞদের তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু আমরা যারা দেখছি এবং পড়ছি তাদের হৃদয় ছুঁয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ। ভীষণ আপন হয়ে রতন আর দুর্গা যেন চুপচাপ পাশে এসে বসে। বোড়াল গ্রামে পোস্ট অফিসের দাওয়ায় হাতে ভর দিয়ে কাত হয়ে শোয়া সত্যজিতের যে মুড আমানুল ক্যামেরাবন্দী করেছেন তা অতুলনীয়।
×