ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রহমান

রোমাঞ্চিত ‘প্লে-মেকার’ রকিব

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৮ মার্চ ২০১৮

রোমাঞ্চিত ‘প্লে-মেকার’ রকিব

৯০ দশকে প্রারম্ভে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে আগমন ঘটে দীপ্তিময তরুণ রকিব হোসেনের। ঢাকার মাঠে তখন কায়সার, ওয়াসিম, মুন্না, মহসিন, সাব্বির, রুমিরারা ভীষণ জনপ্রিয়া। কিশোর রকিব নিজ প্রতিভার গুণে দ্রুতই জায়গা করে নিলেন প্রথম বিভাগের দল পিডব্লিউডি ক্লাবে। ক্লাবের কোচ তখন শ্রীলঙ্কার পাকির আলী। আবাহনীতে দীর্ঘদিন ধরে খেলা যে মানুষটির কাছে বাংলাদেশের সবকিছুই চেনা। মূলত তাঁর পছন্দ আর আগ্রহের কারণেই রকিবকে দলভুক্ত করল পিডব্লিউডির কর্মকর্তারা। ব্যাস রকিবকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হলো না। ভাল পারফর্মেন্সের কারণে বড় সব ক্লাবের কাছেই তিনি আগ্রহ হয়ে থাকলেন। রকিবও কোন ক্লাবের ঘরের ছেলে হয়ে থাকলেন না। মন যখন যে ক্লাবে সায় দিল সেই ক্লাবের হয়েই খেলতে থাকলেন। আবাহনী, মোহামেডান. মুক্তিযোদ্ধা- কোনটাই বাদ গেল না। খুব সম্ভবত রকিবই একমাত্র ফুটবলার যে কিনা ফুটবলের তুমুল জনপ্রিয়তার সময়ে দেশের সেরা চারটি ফুটবল টিম- আবাহনী ক্রীড়া চক্র, মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে খেলেছেন গৌরবের সঙ্গে। উইং, ফরোয়ার্ড, মিডফিল্ডার-এই তিন পজিশনেই রকিব ছিলেন তুখোড়, কুশলী এক ফুটবলার। ‘প্লেমেকার’ হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন ঢের। বল পায়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের পরাস্ত করে দ্রুত বিপদ সীমানায় ঢুকতে পারতেন। ওয়াসিম, সাব্বির, রুমিদের পরে তার অনবদ্য ড্রিবলিং ছিল চোখে পড়ার মতো। ফলে খুব কম বয়সে জাতীয় দলেও খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ৯২ থেকে ৯৯ জাতীয় দলের হয়ে খেলেন বীরত্মের সঙ্গেই। ২০০৪ সালে সর্বশেষ রকিবের ঠিকানা ছিল দেশ সেরা আবাহনী ক্রীড়াচক্র ক্লাবে। ওই বছরে অক্টোবরের দিকে ভুটানে একটি ক্লাব কাপে অংশ নেন। কিন্তু দেশে ফিরে এসে টেলিভিশনে দেয়া একটি সাক্ষাতকারকে কেন্দ্র করে অফিসিয়ালদের সঙ্গে তার এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়। খানিকটা স্বাধীনচেতা রকিব ভীষণ অভিমানী হয়ে উঠেন। এরপর পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফুটবল আর খেলবেন না, দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। ভিসা পেয়ে যান কানাডার। যোগ্যতা এবং সক্ষমতা থাকার পরও গুডবাই জানান ফুটবলকে। অনেকটা নিরবেই কানাডার মন্ট্রিলে অভিবাসী হন। পরে ঠিকানা বদল করে স্থায়ী হন কানাডার ক্যালগেরিতে। ওখানেই থাকেন স্ত্রী জিহান সাজেদ আর দু-সন্তান জিনান হোসেন ও রায়েফ হোসেনকে নিয়ে। ক’দিন আগে রকিব দেশে এসেছিলেন। মাসখানেকের বেশি সময় ছিলেন। ফুটবলে পা দিতে ভুল করেননি। কক্সবাজারে গিয়েছিলেন বিচ ফুটবল খেলতে। মাসুদ রানা, নাকিবসহ অনেক পুরনো বন্ধুদের পেয়েছিলেন। ২৬ মার্চ ফের আবার উড়ে গেলেন কানাডায়। আবার কবে আসবেন তিনি জানেন না। দেশে এসে রকিব ঘুরে বেরিয়েছেন সর্বত্র। সতীর্থ ফুটবলার, শুভাকাক্সিক্ষ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছেন, গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। কানাডা যাওয়ার প্রাক্কালে ফুটবল নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। রকিবের অভিমান এখনও যেন কাটেনি। কারণ ফুটবলকে বিদায় জানানো হয়নি তাঁর আনুষ্ঠানিকভাবে। তাই একটা ক্ষত তাঁকে বিদ্ধ করে। কিন্তু এরচেয়েও বেশি তাঁর হ্নদয়ে রক্তক্ষরণ হয় ফুটবলের দুরবস্থা দেখে। নিজেই হিসেব মেলাতে পারেন না, ফুটবল কোথায় ছিল আর এখন কোথায়? ৯৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা জেন্টেলমেন্ট এ্যাগ্রিমেন্ট ছিন্ন করে নতুন দল গড়লে সে দলে রকিবও ছিলেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে প্রথম ম্যাচের কথা স্মরণে এনে বললেন, ‘আবাহনী আর মোহামেডানের দর্শকরা সেদিন এক হয়ে আমাদের উপর চড়াও হলো। ইট, পানির বোতল ছোড়া হলো আমাদের ওপর। স্টেডিয়াম থেকে আমরা বেরই হতে পারছিলাম না। যদিও বা বের হলাম এক হোটেলে লুকিয়ে রাখা হলো। এটিই ছিল ফুটবল ক্রেজ। কিন্তু এখন কিছুই নেই। সব শূন্য। ফুটবলের চারপাশে হাহকার। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে অথচ মাঠে দর্শক নেই, ফুটবলে প্রাণ নেই।’ রকিব মনে করেন ফুটবলের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন হয়েছে। আগে থেকে পরিকল্পনা নিয়ে গুছিয়ে চললে এমন হতো না। প্লানিং-এ অনেক ভুল আছে। সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে। এশিয়ান লেভেলে নিজেদের মান উচ্চতায় নিতে না পারার ফলে ফুটবলের সৌন্দর্যের জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। দিনে দিনে তাই দর্শকরা এখন ফুটবলকে ভুলে গেছে। ঢাকায় রকিবের প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবলের শুরুটা ছিল এমএসপিসিসি ক্লাবের হয়ে। তখন লালমাটিয়াতে বড় বোন ফেরদৌসী আহমেদের বাসায় থাকতেন। ৮৬ সালে এমএসপিসিসি ক্লাবের হয়ে পাইওনিয়র লীগে খেলেন। এক বছর খেলার পর ৮৭-৮৮ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগের দল সিটি ক্লাবে যোগ দেন। এ সময়ই নিজের ফুটবল প্রতিভা তিনি বেশ ভালভাবেই তুলে ধরেন। পরের বছরেই তাই সুযোগ মেলে প্রথম বিভাগের দল পিডব্লিউডি ক্লাবে। পিডব্লিউডির হয়ে দু মৌসুম খেলেন। এই ক্লাবে সতীর্থ হিসেবে পান গোলাম গাউস, রেজা, শাহ আলম, জামরুলসহ বেশ কয়েক ভাল ফুটবলারকে। প্রথম বিভাগে এসে প্রথম মৌসুমে তিন গোল করে পরের মৌসুমে তা দ্বিগুণে উন্নীত করেন। ৯৩ সালে পিডব্লিউডি ছেড়ে রকিব চলে আসেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে। কোচ সেলিমের তত্ত্বাবধানে এক মৌসুম খেলেন। সে সময় ব্রাদার্স তারুণ্যদীপ্তে অনন্য এক দল। রুপু, রকিব, মানিক, আতা, মিজান, মুন-এর সমন্বয়ে দলটি অন্যরকম ঝড় তুলেছে। ৯৪-৯৫ মৌসুমে জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্ট ভেঙে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দল গড়লে রকিব ব্রাদার্স ছেড়ে সেই লড়াই-এ অবতীর্ণ হন। মুক্তিযোদ্ধাতে টানা দু মৌসুম খেলার পর যোগ দেন দেশের অন্যতম সেরা দল আবাহনী ক্লাবে। কিন্তু আবাহনী ছেড়ে আবার মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে ফিরে যান। এক মৌসুম কাটিয়ে এবার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। দু মৌসুম খেলে আবার মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে যোগ দেন। ২০০৩-২০০৪ মৌসুমে ফের আবাহনীতে আসেন। আবাহনীর কোচ তখন অমলেশ সেন। দলের গুরুদায়িত্বও পান রকিব। কিন্তু ক্লাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হলে ফুটবলকেই বিদায় জানান। ফুটবল এখনও রকিবের রক্তে। দেশে এলে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। খেলার মাঠের বড় ভাই, বন্ধু এবং ছোট ভাইদের খুঁজে বেড়ান। পুরনো দিনের গল্পে মেতে উঠেন। সাবেক ফুটবলার চুন্নু, আসলাম, জনিকে স্মরণ করেন কৃতজ্ঞচিত্তে। রকিব বলেন, ‘জীবনে যে অর্জন এবং মানুষের যে ভালবাসা পেয়েছি তা তো ফুটবল থেকেই। এখনও সেই ভালবাসা অটুট আছে। এখনও মানুষ খুঁজে নেয় ফুটবলার রকিবকে। জীবনে এর চেয়ে আর বড় পাওয়া কী হতে পারে।’ খেলার মাঠের প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলেন, ‘আমি অনেকদিক দিয়েই সৌভাগ্যবান। দেশের সব বড় দলে খেলেছি। বড় প্লেয়ারদের সঙ্গে খেলেছি। উঁচুমাপের সব কোচ, খেলোয়াড়ের সান্নিধ্যে পেয়েছি। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ওল্ডরিখ সোয়াব, ম্যান ইয়াং ক্যাং, অটোফিস্টার, সামির শাকির উনাদের কোচিং পেয়েছি।’ তবে রকিব তাঁর দেখা কোচ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ‘ওল্ডরিখ সোয়াবই ছিলেন সবচেয়ে বড় মাপের কোচ। মানুষটাও অসাধারণ ছিলেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হওয়ার কারণে তিনি ভাল কিছু দিয়ে যেতে পারেননি।’ ফুটবল জীবনের অনেক ঘটনা এখনও রকিবকে বড় স্মৃতিকাতর করে তুলে। এখনও ভুলতে পারেন না ৯৩ সালে সাফ ফুটবলের সেই ভয়াবহ ব্যর্থতার কথা। বলেন, ‘এদেশের ফুটবলের ব্যর্থতার শুরুটা যেন ওখান থেকেই হলো। প্রথম ম্যাচ মালদ্বীপের সঙ্গে। এর আগে কত প্রস্তুতি আমাদের। কিন্তু ম্যাচটা আমরা বের করতে পারলাম না। ওই ম্যাচে আমাদের যেখানে জেতার কথা বড় ব্যবধানে সেখানে আমরা ড্র করলাম। ওপেন নেট মিস করলাম আমরা। কায়সার হামিদ ভাই পেনাল্টি পর্যন্ত মিস করলেন। শেষ পর্যন্ত অবনতচিত্তে বের হতে হলো স্টেডিয়াম থেকে। পরের ম্যাচে নেপালের কাছেও হেরে গেলাম। দেশের মাটিতে এমন ফলাফলে সুইস কোচ ওল্ডরিখ সোয়াব ভীষণরকম সমালোচিত হলেন। ফুটবল জীবনের এটি একটি কালো অধ্যায়ই বলব। কোনদিন হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারব না।’ রকিবের একসময় ভাবনা ছিল ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতি করবেন। আবাহনীতে থাকতেই আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদকও হয়েছিলেন। কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রাজনীতি থেকেও ইস্তফা দিতে হয়। রকিব মনে করেন যেখানেই থাকেন না কেন জীবনের সবটুকু সুমধুর স্মৃতি তাঁর ফুটবল ঘিরেই। যে ফুটবল তাঁকে দেশব্যাপী পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেই ঋণকে বেঁধে রেখেছেন নিখাদ ভালবাসায়। দেশ থেকে দূর বহুদূর থাকলেও ফুটবলের জন্য শুভকামনা তাঁর হৃদয় থেকে।
×