ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দিল্লীতে বিএনপি -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দিল্লীতে বিএনপি -স্বদেশ রায়

২০১৪ সালে দিল্লীতে এক রাজনীতিবিদের অফিসে বসে। কোন রাজনৈতিক আলাপ নয়, এমনি নানান গল্প করছি– হঠাৎ তিনি বললেন, তার একজন পরিচিত লোকের মাধ্যমে কয়েকদিন ধরে প্রস্তাব আসছে- বিএনপির পক্ষ থেকে কয়েকজন দেখা করতে চান। বলেই তিনি আমার মুখের দিকে একটু তাকালেন। তাঁর তাকানোর ভেতর একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বললাম, আপনি ভদ্রলোক, আপনার বাড়িতে অতিথি এসেছে। কোন্ অর্বাচীন বলবে যে অতিথিকে বসতে দিও না। তাছাড়া আপনারা ক্ষমতায় এলে ওরা ওদের অফিসে মিষ্টি বিতরণ করেছে। আপনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন না এটা কী হয়। হাসলেন তিনি, মাথাও চুলকালেন এবং একটু ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন, কাল ভোরে আমাকে দিল্লীর বাইরে যেতে হবে। হেসে বলি, তাতে অসুবিধা কি। আপনার অতিথিরা তো আর অর্থ সঙ্কটে নেই যে তাঁরা আপনার জন্যে দিল্লীতে অপেক্ষা করতে পারবে না। তাছাড়া তাঁরা তো নিশ্চয়ই আরও কয়েকদিন আগে এসেছে। ভদ্রলোক হেসে বললেন, দেখুন আপনাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা খুব কষ্ট। এই কথা বলে ভদ্রলোক ব্রিটিশ কলোনির রাজভাষা ত্যাগ করে তাঁদের স্বাধীন দেশের রাজভাষায় একটি জোকস বললেন, বিনয়ের সঙ্গে বললাম, দেখুন কয়েকটি হিন্দী কবিতা মুখস্থ আছে। কিন্তু এক লাইন হিন্দী বলতেও পারি না, বুঝিও না। তিনি হাসলেন। তার ঠিক দুই দিন পরে, দিল্লীর অভিজাত এলাকার একটি ক্লাবে। কয়েক অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। এমন সময় এসে যোগ দিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন এমন একজন বড় আইনজীবী। তাঁর সঙ্গে কথা জমে ওঠার পরে তিনি মানবাধিকার প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এমনকি এক পর্যায়ে বললেন, আমি বাংলাদেশে তাঁর এই মানবাধিকার সংগঠনকে কোন সাহায্য করতে পারি কিনা? বিনয়ের সঙ্গে বলি, বাংলাদেশে এগুলো করা খুব সম্মানের কিছু নয়। এগুলো বাংলাদেশে এক ধরনের ব্যবসা। কিছু লোক আছে তারা আয় রোজগার ও একটি সামাজিক পরিচিতির জন্য এগুলো করে। কারণ তাঁরা কেউই তাদের নিজ নিজ পেশায় খুব ভাল করতে পারেননি। ভদ্রলোক তখন বললেন, কিন্তু আপনাদের ওখানে তো মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে অহরহ? তাকে প্রশ্ন করলাম, এগুলো কি পত্রিকার খবর? তিনি বললেন, না। আপনাদের বিরোধী দল, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির ওপর খুবই অত্যাচার হচ্ছে। আপনাদের কয়েক বুদ্ধিজীবীর কাছে জানলাম। বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক প্রফেসরের নাম বললেন। ওই প্রফেসরদের তখন চিনতাম না। আমি ওই সময়ে ড. আনোয়ার হোসেনকে ফোন করি, কারণ তিনি যেহেতু শিক্ষক সমিতির নেতা অতএব সব শিক্ষককে তিনি চিনবেন। ড. আনোয়ার হোসেন আমাকে বললেন, তিনি তাদের চেনেন, তারা জামায়াত ও বিএনপির একটিভ কর্মী আর কি? যা হোক, ভদ্রলোক আমাদের বাংলায় বাৎচিত কিছুই বুঝতে পারলেন না। আমিও বিষয়টি বুঝে গেলাম। বুঝতে পারলাম বিএনপি নানা মহলে চেষ্টা করছে। বিএনপি যে দিল্লীতে খুব বেশি উপস্থিত তা আরও বুঝতে পারি কয়েক রাজনীতি ও ডিফেন্স এ্যানালিস্টের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা বন্ধু। তাঁরা সোজা কথাই বলেন। বললেন, বিএনপির লোকজন তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করছে বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দিল্লী যেন সহায়তা করে। কারণ, আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপি অনেক বেশি কিছু দিতে পারবে ভারতকে। আমি হেসে প্রশ্ন করি, কেন বর্তমান সরকার কি কিছু দিয়েছে নাকি দিল্লীকে? আমি তো একজন পলিটিক্যাল এ্যানালিস্ট হিসেবে বুঝি, যে কোন দুটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক থাকা উচিত, যেভাবে অর্থনীতি এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করা উচিত- তাই করছে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার। তাছাড়া কোন সরকারের কি তার দেশের কোন কিছু অন্যকে দেয়ার ক্ষমতা আছে? একজন দুস্থ লোককে কিছু দিতে গেলেও সরকারকে তা হিসাবের খাতায় পদ্ধতি অনুযায়ী হিসাব রাখতে হয়। তখন তাঁরা বলেন, দেখ তোমাদের ওখানের কয়েক সম্পাদক কিন্তু এসে বলেন, বিএনপির প্রতি দিল্লীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত। তাহলে দিল্লীর লাভ হবে। বিএনপি অনেক বেশি দিতে পারবে দিল্লীকে। বিনয়ের সঙ্গে বলি, আমি এখনও সম্পাদকের চাকরি পায়নি। খুঁজছি। মাঝখানে মিয়ানমারেও একটি দৈনিকে কথা হচ্ছিল, আমি রাজি ছিলাম। কিন্তু স্ত্রীর পেশা, ছেলের পড়াশোনা চিন্তা করে আবার পিছিয়ে আসি। এই হচ্ছে আমার সম্পাদক হওয়ার পথে হাঁটা। তাই নিশ্চয়ই আমার থেকে ওই সম্পাদকরা অনেক ভাল বুঝবেন। তবে বাস্তবতা হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ থাকে। তখন তার নিজস্ব পলিসি থাকে। একটা স্বাধীন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অন্য প্রতিবেশীর যে সম্পর্ক হয়, শেখ হাসিনা সেটাই গড়ে তোলেন। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে বাস্তবে বাংলাদেশ একটি মিনি পাকিস্তান হয়। তাই একটি মিনি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক হতে পারে তখন ভারতের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপি চালিত মিনি পাকিস্তানের সেই সম্পর্কই হয়। এখানে দেয়ার নেয়ার বিষয়টি ঠিক আমি বুঝি না। এর পরে কয়েকবার দিল্লী গিয়েছি মূলত চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসার পাশাপাশি ছেলে আমাকে ও চিত্রাকে নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরেছে। ঘুরতে হয় মূলত ওর পছন্দ মতো। তবে দিল্লীর গরম ওর জন্য অসহনীয় তাই দ্রুতই দেশে ফিরতে হয়। অন্যদিকে দেশে থাকলে এই নিউজ খোঁজার কাজেই থাকতে হয়। নিউজের কাজে বিদেশে গেলেও একই। এ কারণে পারিবারিক ট্যুরগুলোতে ওই ঝামেলা এড়িয়ে থাকি। তার পরেও কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যে দেখা হয়নি তা নয়। তাদের মাধ্যমে জানতে পারি, বিএনপি লোকজন আসা যাওয়া করছে। এর পরে গত সাত তারিখ দিল্লী গিয়ে কাপড় না বদলেই এক রাজনীতিবিদের অফিসে যাই। নানান কথা হচ্ছিল- শুরু হওয়া সফর, বিমানবন্দরে মোদির নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া চলে যাওয়া। এসব বিষয় নিয়ে। এর ভেতর তিনি বললেন, কয়েকদিন আগেই সাবেক আমলা বিএনপির অমুক নেতা তাঁর কাছে এসেছিলেন এবং অনেকটা সোজাসুজিই তার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন, দিল্লী অন্তত এবারের জন্য তাঁদের যেন ক্ষমতায় বসায়। তখন আমি বলি, একটি ভাল তথ্য দিলেন তো আপনি। এই আপনাদের এখানে আসার আগেই আমাদের একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হয়েছে, সেখানে বিএনপি জিতেছে। তাহলে নিশ্চয়ই আপনারই তাদের জিতিয়েছেন? তিনি বলেন, তা কীভাবে সম্ভব? বলি, বিএনপির ওই নেতার আপনার কাছে আবেদন বা নিবেদন শুনে মনে হচ্ছে, আপনারাই বাংলাদেশে নির্বাচনে ভোটার পাঠিয়ে দেন। কারণ, রাজনৈতিক কর্মী ও পরবর্তীতে সাংবাদিক হিসেবে সরাসরি নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত ১৯৭৮ সালের বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে। আমাদের দেশের মিলিটারি সরকারের কারচুপি দেখেছি। জনগণের প্রতিরোধ দেখেছি। সিভিল মিলিটারি কারচুপি দেখেছি। আবার ভাল নির্বাচনও দেখেছি। কিন্তু কোথাও ভারতীয় ভোটার দেখিনি। ভোট যারা দিতে আসে তারা সবাই বাংলাদেশী। বলে তাকে একটি ঘটনা শোনাই, বলি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকার উপকণ্ঠের একটি কেন্দ্রে গিয়েছি সকাল ১১টার দিকে। দরিদ্র কয়েকজন বয়স্ক মহিলা ভোট দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাদের জিজ্ঞেস করি, ভোট দিলেন কাকে-বলবেন? সোজা উত্তর, শেখ হাসিনার নৌকায় দিয়েছি। কেন তাকে ভোট দিলেন। তারা আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিএনপিকে ভোট দিয়ে না খেয়ে মরব নাকি? ভারতীয় ওই রাজনীতিবিদ অনেকটা বিস্ময়ের সঙ্গে আমার দিকে তাকালেন। তখন তাকে রিকোয়েস্ট করি, আমার কথার শেষটুকু শুনতে। বলেই বলি, ওদের ওই কথা শুনে আমার ড্রাইভার লাফ দিয়ে ওঠে। কারণ, ও ছিল পাঁড় আওয়ামী লীগার। ও বলে, স্যার শেখ হাসিনা এবার সব সিট পাবে। মানুষ যখন ভোট দিয়ে মুখে মুখে বলতে শুরু করেছে তখন আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। শেখ হাসিনার সঙ্গে তখন দিল্লীও ছিল না আমেরিকাও ছিল না। ভদ্রমহিলা জেল খেটে বের হয়ে নির্বাচনে গেছেন। তাই সাংবাদিক হিসেবে আমার জানা মতে জনগণই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়। যেমন আপনাদের মোদি সাহেবকে বসিয়েছেন। যাহোক, এরপরে গল্প অন্যদিকে চলে যায়। আমারও আরেক স্থানে যাওয়ার তাড়া ছিল। তাই বেরিয়ে পড়ি। এই ধরনের তথ্য মোটামুটি আকারে ইঙ্গিতে দিল্লী থাকা অবস্থায় অনেক স্থানেই পাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত হলাম কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখিÑ এক সাংবাদিক বন্ধু গভীর রাতের আড্ডায় জিজ্ঞেস করলেন, স্বদেশ, বল তো, এ মুহূর্তে তোমাদের বিএনপির পক্ষের কত লোক দিল্লীতে আছে। হেসে বলি, দিল্লীর ইকোনমি চাঙ্গা হচ্ছে। [email protected]
×