ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এস এম মুকুল

প্রাণিজ পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১২ মার্চ ২০১৭

প্রাণিজ পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ

প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশের আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দিন দিন বেড়ে চলছে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান। বাংলাদেশের মোট খাদ্য সরবরাহের ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ মাংস ও ডিম আসে পোল্ট্রি খাত থেকে। মোট প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই যোগান দেয় এই শিল্পটি। আশার দিকটি হলোÑ মানুষের মাঝে এখন স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। মানুষ এখন লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাংস খায়। আধুনিক বিশ্বে এখন পোল্ট্রি সহজলভ্য ও সুলভ আমিষের যোগানদাতা হিসেবে সকল ধর্ম-বয়স ও পেশার মানুষের কাছে অগ্রগণ্য। সঙ্গত কারণেই পুষ্টি সমৃদ্ধিতে পোল্ট্রির গুরুত্ব বাড়ছে আমাদের দেশেও। দেশীয় পুঁজি এবং দেশীয় উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমাদের পোল্ট্রি শিল্প আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণীজ পুষ্টিতে নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার ছোটবড় খামারে ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদন বাড়াতে প্রতিনিয়ত একদিনের বাচ্চা সরবরাহ করছেন দেশের উদ্যোক্তারা। মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একসময় অবৈধ পথে ভারত থেকে আসত মুরগির বাচ্চা। আশার খবর- দেশের খামারগুলোয় প্রতি সপ্তাহে একদিনের লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির বাচ্চার চাহিদা ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১০ লাখ, যার পুরোটাই এখন দেশে উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৪ সালে দেশে মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন ছিল ৯০ লাখ। ২০১৬ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখে। আন্তর্জাতিক বাজারে যাচ্ছে পোল্ট্রি প্রসেসড ফুড পোল্ট্রির মাংস বহুমাত্রিক ব্যবহার করে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে চিকেন নাগেট, চিকেন বল, সসেজ, ড্রামস্টিক, বার্গার, চিকেন সামুচা, মিটবলসহ বিভিন্ন ধরনের মজাদার প্যাকেটজাত খাবার। কিছুকাল আগেও প্রক্রিয়াজাত এসব খাবার বিদেশ থেকে আমদানি হতো। এসব খাবার নতুন প্রজন্মের রুচি ও চাহিদার সঙ্গে মানানসই এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। খাত সংশ্লিষ্টদের আশাবাদ বাংলাদেশের পোল্ট্রি প্রসেসড পণ্য ২০২০ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করলে বছরে অন্তত ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হবে। উৎপাদন বেড়েছে ডিম, মাংস ও পোল্ট্রি ফিডের দেশের খামারগুলোয় ২০১৪ সালে দৈনিক ১ হাজার ৫১০ টন মুরগির মাংস উৎপাদন হতো, ২০১৬ সালে তা বেড়ে ১ হাজার ৮৫১ টনে দাঁড়িয়েছে। ২০৩০ সালে মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন ৩ হাজার ৩০০ টনে উন্নীত হবে এমন আশাবাদ খাত সংশ্লিষ্টদের। মাংসের পাশাপাশি বেড়েছে ডিম উৎপাদন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি পিস। ২০১৬ সালে ২ কোটি ৩০ লাখ পিসে উন্নীত হয়। ২০১৪ সালে দেশে পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৫ লাখ মেট্রিক টন থেকে ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীতকরণ। বর্তমানে বাংলাদেশে ছোটবড় প্রায় ২০০টি হ্যাচারি ও সাতটি জিপি (গ্র্যান্ড প্যারেন্ট) ফার্ম রয়েছে। বড় জিপি ফার্মের মধ্যে অন্যতম হলো প্যারাগন, আফতাব, নারিশ, কাজী, সিপি, এমএম আগা ও রাশিক পোল্ট্রি এ্যান্ড হ্যাচারি। এগিয়ে চলার আশার আলো পোল্ট্রি শিল্পে নতুন তরুণ উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন ছোট-বড় খামার। তরুণদের উদ্ভাবনী মানসিকতা, মেধা, শ্রম ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এ শিল্পে বিনিয়োগের চাকা ঘুরছে দ্রুত। ২০৩০ সালে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে প্রায় ১ কোটি মানুষ। ২০২১ সালে ডিমের মাথাপিছু ভোগ ৫১ থেকে বেড়ে ৮৫তে উন্নীত হবে এবং মুরগির মাংসের মাথাপিছু ভোগ ৪ দশমিক ২ থেকে বেড়ে ৭ দশমিক ৫ কেজিতে উন্নীত হবে। বর্তমান সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জনপ্রতি বার্ষিক ডিম খাওয়ার গড় পরিমাণ ১০৪টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডিম এবং দৈনিক প্রায় ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। আর এ লক্ষ্য অর্জন করতে প্রয়োজন প্রায় ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। গবেষণা তথ্যে বলা হয়েছে, ২০২১ সাল নাগাদ পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ ৬০ হাজার কোটি টাকা হলে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ। এই সেক্টরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পোল্ট্রি লিটার থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রয়োজন সরকারের প্রণোদনা কৃষিক্ষেত্রের মতো পোল্ট্রি শিল্পের ছোট ছোট খামারিকে জন্য ৫ শতাংশ সুদে আলাদা ঋণ প্রদান করা, পোল্ট্রি বীমা চালু করা, প্রশিক্ষণের জন্য আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ অফিসগুলো কাজে লাগানো, বাজেটে ভুট্টাসহ পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), সয়াবিনের ওপর থেকে ১০ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক এবং ডিডিজিএস এর ওপর থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টদের দাবিগুলো বাস্তবতা যাচাই করে বিবেচনা করা দরকার। পক্ষান্তরে এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের উচিত হবে- সবচেয়ে নিরাপদ ও পুষ্টিমাণ সমৃদ্ধ পোল্ট্রির ডিম ও মাংস যত সুলভে দেশের বাজার সৃষ্টি করা যায় এ শিল্পের বিকাশ ততই ত্বরান্বিত হবে। সাশ্রয়ী দামে জনগণ ডিম আর মাংস পেলে সবাই তা ভোগ করতে পারবে। আর তখনই পুষ্টির ঘাটতি কমবে আমরা পাব স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম। ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফালোভী হলে তার ফল ভাল হবে না। চায়নাদের মতো মানসিকতা নিয়ে আমাদের ব্যবসায়ী মহলকে কাজ করতে হবে- কম লাভে বিক্রির জন্য পণ্যকে সহজ্যলভ্য করা আর বেশি বিক্রির মাধ্যমে অধিক লাভবান হওয়া।
×