ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ॥ আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা কী

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৩ মার্চ ২০১৭

গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ॥ আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা কী

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুত মন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুতের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান এই মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাজারে অনেক কথা হচ্ছে। কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা, কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ তো হরতালই ডেকেছেন। দৃশ্যত মনে হচ্ছে সবাই গ্যাসের বর্তমান মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। পোশাক শিল্পের মালিক, বস্ত্র শিল্পের মালিক থেকে শুরু করে রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই বস্তুত ‘আর্তনাদ’ই করছেন মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে অবশ্য ‘কনজিউমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ক্যাব) আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। জুন মাসে কার্যকর হওয়ার কথা যে মূল্য বৃদ্ধি তা আদালত স্থগিত করেছে। শেষপর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধির ‘কপালে’ কী আছে তা এখন বলা মুশকিল। তবে এ কথা সবাই একবাক্যেই বলছেন, ‘মূল্য বৃদ্ধি’ ‘মূল্যস্ফীতিকে’ উস্কে দেবে, যা হবে অসহনীয়। এ ধরনের আশঙ্কার কথা, আতঙ্কের কথা সর্বত্রই শোনা যাচ্ছে। আমার কাছে এসব কথা নিতান্তই মামুলি বলেই মনে হয়। কারণ? কারণ হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকেই মূল্যস্ফীতি, মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে একই ধরনের কথা শুনে আসছি। কিন্তু কঠোর বাস্তবতা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম, সেবার দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। জমির দাম, সোনার দাম, ফ্ল্যাটের দাম, বাড়ির দাম বাড়ছে আর বাড়ছে। বাড়ছে শাক-সবজির দাম, চাল-ডালের দাম, জামা-কাপড়ের দাম, জুতা-মোজার দাম। উল্টো প্রশ্ন কোন্টার মূল্য বাড়ছে না। মানুষের জীবনের মূল্যই বোধহয় বাড়ছে নাÑ দেখেশুনে এটাই মনে হয়। সহপাঠী যেভাবে সহপাঠীকে হত্যা করে, প্রেমিক যেভাবে প্রেমিকাকে হত্যা করে, প্রতিদিন দুর্ঘটনায় যেভাবে মানুষের প্রাণ যায় তাতে বলাই যায়, মানুষের জীবনের দামই বাড়ছে না। এছাড়া সব জিনিসপত্র, দ্রব্যসামগ্রী, সেবার দামই বাড়ছে। পাকিস্তান আমলের (১৯৪৭-১৯৭১) কথা বাদই দিলাম। বলা যাক, স্বাধীনতাউত্তর কালের কথা। সেটা ১৯৭৪-৭৫ সালের ঘটনা। আমি তখন দৈনিক সংবাদের ‘অর্থনীতির পাতার’ সম্পাদক। এক পাতা সপ্তাহে একদিন একমাত্র সংবাদেই। এক সপ্তাহে ষোলো টাকা সের (তখন কেজি হয়নি) কাঁচা মরিচের দাম দেখে সংবাদের শিরোনাম করি : ‘কাঁচা মরিচের বাজারে আগুন।’ তখন দৈনিক সংবাদে নিয়মিত লেখেন বিখ্যাত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী যিনি, ‘দরবারে জহুর’ নামে তখন খ্যাত। আমাকে ‘সংবাদে’ ফোন করে বললেন : ‘মরিচের বাজারে যে আগুন লাগালেন, কুড়ি টাকা, পঁচিশ টাকা সের হলে তখন শিরোনাম কী করবেন? এই কথা এখনও মনে করি। আজকে, কাঁচা মরিচের কেজি কত? এক শ’, দুই শ’ টাকা কেজি দরেও কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় হরহামেশাই। শুধু কাঁচা মরিচ কেন, শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস, দুধ-ডিমের অবস্থা কী? গ্যাস, বিদ্যুত, কেরোসিন, ডিজেলের দাম ১৯৭২ সালে কত ছিল, আজকে কত? বাসের ভাড়া কত? খবরের কাগজের দাম কত? যদি প্রশ্ন করি, কোন্টার দাম গত ৪৫-৪৬ বছরে কমেছে? উত্তর, কমার প্রশ্নই ওঠে না, বাড়ছে, বাড়বে। আবার পাশাপাশি সংগ্রাম চলছে, চলবে। হরতাল চলছে, চলবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো ‘গণবিরোধী’ কাজ অতীতের সকল সরকারই করেছে, আগামী দিনেও করবে। করছে প্রতিবেশী দেশে, বিভিন্ন দেশে। এই দ্রব্যমূল্য নিয়ে দেশে দেশে সহিংস আন্দোলন হয়। কিছুদিন আগে হয়েছে ব্রাজিলে। গ্রীসের মানুষ লড়ছে বহুদিন ধরে। বস্তুত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাতনার পৃথিবীর সব দেশের মানুষই ভুক্তভোগী। জাপান উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এশিয়ার দেশ হিসেবে তার নিজস্ব মডেলে উন্নয়ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, ইউরোপকে দেখিয়ে দিয়েছে উন্নয়ন কাকে বলেÑ কত প্রকার ও কী কী? সেই জাপানের মানুষ এখন বাড়িতে বিদ্যুতের বাতি জ্বালায় না। বিদ্যুত বিলের টাকা নেই। গাড়ি আছে, গাড়ি চালায় না। বাসে ওঠে। গ্যাসোলিনের টাকা নেই। জাপানী ছেলেমেয়েরা বিয়েশাদি করে না। সংসার চালাতে পারবে না। বাড়িতে বুড়ো বাবা-মা যাদের দেখাশোনা করতে হয়। বহু খরচ। বুড়োরা চুরি করে জেলে যাওয়ার জন্য। সেখানে চিকিৎসা পাওয়া যায়, ভাত পাওয়া যায়। পৃথিবীর বহু দেশে এসব ঘটছে। কাগজ খুললেই এসব খবর পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ‘উন্নয়নের’ খবর, মূল্যস্ফীতির খবর, বেকারত্বের খবর, প্রকৃত মজুরি হ্রাসের খবর, শিশুর দুধের অভাবের খবর, এক শতাংশের হাতে বিশ্বের ৯৯ শতাংশের সম্পদের খবর। দেখা যাচ্ছে উন্নয়নের সহযোগী হয়ে যাচ্ছে মূল্য বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি। উন্নয়নের সহযোগী হয়ে যাচ্ছে বৈষম্য, দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, অপুষ্টি ইত্যাদি। বিশ্বের নেতারা বলছেন এক কথা, ঘটছে বিপরীত। অবাধ ধনবাদী বিকাশ, বাজার অর্থনীতি মানুষকে দুধ-ভাত দেবে বলা হয়েছিল। পৃথিবীর সব দেশ এখন এর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। ধনবাদী দেশের পিতৃভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এখন অবাধ বাণিজ্য, ধনবাদী বিকাশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আসলে ‘উন্নয়ন’ কৌশলীরা কয়েকটা জিনিসের মূল ধরতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতিকে তারা আঘাত করতে পারেন না। অব্যবস্থাপনা, চুরি-দুর্নীতি, অদক্ষতা ইত্যাদি আমাদের দেশগুলোতে উন্নয়নকামীরা দূর করতে পারছেন না। এর বোঝা গিয়ে চাপছে সাধারণ মানুষের ওপরে। উন্নয়নকামীদের দরকার রাজস্ব। তারা এই রাজস্ব আদায়ে নির্দয় হতে পারেন না। ধনীদের ওপর কর ধার্য করতে তারা পারেন না। উল্টো তাদের দিতে হয় রেয়াত। এর বোঝাও পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। অধিকন্তু আরেকটি জিনিস ‘উন্নয়ন দার্শনিক’ দিতে পারছেন না। আর সেটা হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির দাওয়াই। চাকরির সংস্থানের ব্যবস্থা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে আমি আতঙ্কিত নই। আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। যদি ঠিক পরিমাণ মতো আমার আয় বাড়ে। বিপদটা এখানেই। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বিদ্যুতমন্ত্রী বাজার অর্থনীতির লোক। তিনি বলছেন, বাসাবাড়িতে সস্তায় গ্যাস দেয়া হবে না। বাজার মূল্যে গ্যাস ব্যবহার করতে হবে। বাজার মূল্যে গাড়ির মালিকদের গ্যাস কিনতে হবে। সেই গ্যাস হবে ‘এলপিজি’। এটা বিক্রি করবেন ব্যবসায়ীরা, এখনকার মতো সরকার আর বিক্রি করবে না। তার মানে বাজারই ঠিক করবে সব। এতে আপত্তির দিক কিছু নেই যদিও সারা বিশ্বে এই ‘দর্শন’ এখন প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন। কিন্তু আমার আপত্তি অন্যত্র। সব কিছুর দাম বাড়াল, রাজস্ব বৃদ্ধি করুন। তবে বিকল্প আছে কীনা তা দেখে নিন। সর্বোপরি মানুষের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করুন। বেতন-ভাতা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি করুন। দেখা যায় পোশাক শিল্পের মালিকরা ট্যাক্স দেন না, ট্যাক্স রিটার্নও জমা দেন না। উপরন্তু তারা ‘বন্ড’ সুবিধায় আনা কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়ে শত শত কোটি কোটি টাকা মেরে দিচ্ছেন তাহলে কথা আছে মাননীয় বিদ্যুতমন্ত্রী। আপনার দায়িত্ব শুধু মূল্য বৃদ্ধি করা নয়। ক’দিন পর পর জাতির সামনে হাজির হবেন, আর বলবেন ‘আইলাম’, এক খান খবর কইতেÑ আর খবরটি কী, খবরটি হচ্ছে মূল্য বৃদ্ধির। এটা হবে না। বোঝা চাপান, উন্নয়নের জন্য এটা দরকার মেনে নিলাম। কিন্তু উন্নয়নের টাকার জন্য আপনি ধনীদের ওপর কর ধার্য করবেন না কেন? সব টাকা গরিবের কাছ থেকে নেবেন কেন? ভ্যাট দেয় না ব্যবসায়ীরা যাদের নাম তালিকাভুক্ত তাদের কুড়ি শতাংশও ভ্যাট দেয় না। শীর্ষ কর দাতাদের মধ্যে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নাম নেই। শিল্পের গ্যাস লাইন চোরাগোপ্তা। ভ্যাটের টাকা দেবে না, কর দেবে না, ‘বন্ডের’ কাপড় বিক্রি করে দেবে- আর সাধারণ মানুষ বার বার বর্ধিত হারে বিদ্যুতের মূল্য, গ্যাসের মূল্য দেবেÑ এটা কেমন কথা? সবচেয়ে বড় কথা, যেহেতু ‘মূল্যস্ফীতি’ ঠেকানোর কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেই তাই প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। ধরুন, একজন ড্রাইভার, অফিসের ম্যানেজার, পিয়ন, ছোট ছোট দোকানের কর্মচারীর কথা। এরা চাকরিজীবী। এরা রিক্সাওয়ালা নয় যে, যাত্রীর কাছ থেকে তার বাড়তি খরচের টাকা আদায় করে নেবে। গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এবং আনুষঙ্গিক সব মূল্য বৃদ্ধির ফলে অবিলম্বে বাসা ভাড়া বাড়বে। এতে কোন সন্দেহ নেই। এই শ্রেণীর লোকদের আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা কী? তাদের মাসিক বেতন কী তাদের মালিকরা বাড়াবে? সম্ভাবনা ক্ষীণ। সরকার তা পারে। সরকার তো দুই বছর আগে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে যার বোঝা মানুষের ঘাড়ে চেপেছে। কিন্তু লাখ লাখ বেসরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কী হবে? এখানেই প্রশ্ন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বাড়বে। কখনও সরকার বাড়াবে কখনও ব্যবসায়ীরা বাড়াবে। কিন্তু আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা কী? না কি জাপানীদের মতোই সংসার চলবে। বাড়িতে চুলা জ্বলবে না, বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলবে না। গাড়ি গ্যারেজে রেখে হেঁটে যাবে মানুষ অফিসে? অবিবাহিত তরুণ সমাজ যা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×