ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ নুরুজ্জামান তালুকদার

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-২০১৬ ভেতর থেকে দেখা

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-২০১৬ ভেতর থেকে দেখা

২২ ডিসেম্বর, ২০১৬ বৃহস্পতিবার-নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের কার্য ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন হতে পারে। কারণ, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনের পরের দিনসমূহে বিশেষ করে ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার অনেকগুলো আমি সংগ্রহ করেছিলাম, সবগুলোতেই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। ভাল লাগার মতো অনেক প্রশংসা বাণী আছে যাতে আগামীতে আরও বেশি আগ্রহভরে কাজ করবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা সন্দেহ নেই। কঠিন পরিশ্রম করে কাজ করলে প্রশংসা পেতে কার না ইচ্ছা করে? আর আমার জন্য এতটুকু প্রশংসা অনেক বড়। কারণ, নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ এই নির্বাচন পরিচালনার জন্য আমাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ভেতর থেকে যেভাবে দেখেছি সেভাবেই লিখছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের দিন এবং আগের রাতে টানাহেঁচড়া করে অবৈধভাবে ভোট দেয়ার প্রবণতা বেশ কিছুদিন থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে তা সামান্য, কিছু কিছু এলাকায় এবং কিছু কিছু প্রার্থীর দ্বারা হয়েছে। এগুলো আগেই অনুমান করা যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বল্পতা, কেন্দ্রের স্থায়ী নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে নিরাপত্তা রক্ষার কৌশল ও সমন্বয় না থাকা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাগণ নিরাপত্তা কৌশল না জানায় ভাল ভোটগ্রহণ কখনওবা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এর কোনটিই হতে দেয়া হয়নি। ভোটকেন্দ্রে একটিমাত্র প্রবেশ ও বাহির পথ স্থাপন, পর্যাপ্ত চেকিং, ভোটের আগের দিন সন্ধ্যার পর ভোট কেন্দ্রের বাইরের কাউকে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা, কেন্দ্রে নিয়োজিত বাহিনী আগের রাতে আংশিক-পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করবেন, যেন ভোটের দিন পূর্বের রাত জাগার ক্লান্তি ভর না করে, ভোটের দিন কোন কক্ষে কেউ ব্যালট পেপারে অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা তা প্রতিরোধ করবেন এবং জোরে চিৎকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং প্রয়োজনে দুষ্কৃতকারীদের পেছনে ধাওয়া করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চেনাতে সহায়তা করবেন ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছিল। মোট কথা সাহস এবং সমন্বয়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের যেভাবে অনুপ্রাণিত করে চেয়েছিলাম সেভাবেই কাজ হয়েছে। যে কোন নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীগণকে আস্থায় রাখা রিটার্নিং অফিসারের অবশ্য কর্তব্য। কাজে এবং কথায় ২০১ প্রার্থীকে আমার আস্থায় রাখার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছি এবং তা পেরেছি। প্রার্থীগণকে বলেছিলাম বেআইনী কাজ করলে যে কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না এবং আমিও রেহাই পাব না। মিছিল করা আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী। শুধু প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেই কয়েকটি মিছিল থামাতে এবং নিঃশব্দ করতে পেরেছিলাম। এই নির্বাচনে আমি সরব থাকার চেষ্টা করেছি। কারণ অনেক অমূলক, ভিত্তিহীন অভিযোগের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়েছে যেগুলো কি-না ভাল নির্বাচনকেও সন্দেহযুক্ত করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ভোটারগণকে বিভ্রান্ত করে। যেমন- আচরণ বিধিমালা ভেঙ্গে দোয়া চাওয়া, টাকা দিয়ে ভোট কেনা এবং সবার অজান্তে লুঙ্গি-শাড়ি দিয়ে ভোট কেনা। আমার কাছে যখনই কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন বা জানতে চেয়েছেন তৎক্ষণাৎ আমি বলেছি, আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় এসবে কোন কাজ হবে না। ব্যালট পেপারে গোপনে সিল দিয়ে ব্যালট বাক্সে ফেললেই কেবল ভোট দেয়া বোঝায়। এমনকি দেশের ১৬ কোটি মানুষও যদি কোন প্রার্থীর জন্য দোয়া করেন কিন্তু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ভোট না দেন, তবে আসল কাজের কাজটি হবে না। (ভোট কেনা) ব্যালট পেপার থাকে রিটার্নিং অফিসারের কাছে এবং ভোটের দিন প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে, পক্ষান্তরে ভোটার ভোট দেবেন গোপন পদ্ধতিতে। কাজেই ভোট কেনা বা বেচার ভিত্তিহীন অভিযোগ দীর্ঘদিন বাতাসে ভাসছে এবং তা বাতাসেই মিলিয়ে যাবে আশা করি। (সবার অজান্তে) কিছু কিছু মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ পেয়েছিলাম যে লুঙ্গি-শাড়ি বিতরণ হচ্ছে। যেহেতু ঘটনা সবার অজান্তে কাজেই অভিযোগকারী বিষয়টি জানলেন কিভাবে। ভিত্তিহীন আপত্তির পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে খুব একটা লাভ হয় না। টাকা বা ক্ষমতা থাকলেই একজন ভোটারের ভোটাধিকার (সর্বোচ্চ নাগরিক অধিকার) কেনা উচিত নয় এবং এরূপ চেষ্টা করা জঘন্য অপরাধ, তা প্রার্থীদের সম্মেলনে অনেকবার বলেছি, হয়ত আমার কথা দু’একজন মেনেছেন- এটিই মূলত কাজের কাজ। আমাদের দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ফল নির্ধারণ পদ্ধতি একই; সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ফার্স্ট পাস্ট দি পোস্ট বা সংক্ষেপে এফপিটিপি। একজন প্রার্থী পেলেন ১ লাখ ভোট আরেকজন ১ লাখ ১টি। পরের জনই জিতবেন। প্রার্থীদের সাহসী হতে বলেছিলাম। সাহসী প্রার্থীগণই কেবল এফপিটিপিতে অংশ নিতে পারেন। প্রার্থীরা শুনেছেন, পরাজয় মেনে নেয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এজন্য নির্বাচন পরবর্তী ঝুটঝামেলা নেই বললেই চলে। বিজয়ী প্রার্থীরা মিষ্টি নিয়ে পরাজিত প্রার্থীদের বাড়িতে গেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন, মহানগরীর উন্নয়ন কাজে সহায়তা চেয়েছেন, অন্যদের কাছ থেকে সহায়তার অঙ্গীকার পেয়েছেন এবং তা সবই প্রকাশ্যে। আশা করি, অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে, নারায়ণগঞ্জ মহানগরবাসীর মুখে হাসি ফুটবে। সম্মানিত ভোটারগণকে সাহসী হতে বলেছিলাম, ভোটের দিন উৎসবের দিন হিসেবে উদযাপনের জন্য আহ্বান করেছিলাম। এ কাজে কয়েক হাজার লিফলেট মুদ্রণ করে যতখানি সম্ভব ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। মহিলা ভোটারগণকে ভোটের দিন সাংসারিক কাজের তালিকা খুবই কম রাখতে বলেছিলাম। বলেছিলাম ভয় নেই, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখার জন্য যা যা করা দরকার তাই করব। প্রয়োজনে ছোট ছোট দলবেঁধে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য। ভোটারগণকে যে আহ্বান করেছিলাম তার সবই কাজে লেগেছে। শুধু প্রার্থীদের নয়, ভোটারগণকেও আস্থায় রাখতে পেরেছি। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকায় অতিবৃদ্ধ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও ভোট দিয়েছেন। পত্রিকার ছবিগুলো দেখে আনন্দে কেঁদেছি। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সব সময়ই কামনা করি। পরিশেষে বলব, নির্বাচন অনেকটা যুদ্ধের মতো। কেউ একা জেতে না এবং কেউ একা হারেও না। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিক ছিলেন, প্রবল ইচ্ছা ছিল বড় কাজের অংশীদার হবার। পরে পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও লেখা হয়েছে ‘সদিচ্ছার জয় হয়েছে’। যে কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমরা নির্বাচন কর্মকর্তারা প্রস্তুত আছি। আপনারা সবাই সদিচ্ছা দেখাবেন তো? লেখক : উপসচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং রিটার্নিং অফিসার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন-২০১৬
×