ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের কাঠামো ॥ একটি সামান্য ভাবনা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের কাঠামো ॥ একটি সামান্য ভাবনা -স্বদেশ রায়

বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যা ষোলো কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ষোলো কোটি মানুষকে একটি একক দেশে পরিচালনা করা সহজ নয়, উচিতও নয়। কিন্তু বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর চরিত্র (খুব সামান্য কিছু উপজাতি বাদে) এতই একক, এ দেশকে জনগোষ্ঠীর হারে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করাও উচিত হবে না। সে হিসেবে বিকল্প পথ হিসেবে প্রথমে ভাবা যেতে পারে, দেশের জেলা কাঠামোগুলো আরও অনেক বেশি শক্তিশালী করা, সেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধি, জেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো, জেলা বাজেট ও জেলাকেন্দ্রিক এক ধরনের নির্বাচিত একটি বিশেষ কার্যকরী পরিষদ গঠন করা যায় কিনা- যারা আইন প্রণয়নে পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ থেকে শুরু করে নির্বাহী বিভাগের কাছেও সুপারিশ করতে পারবে। তাহলে জেলাগুলো বিকল্প প্রদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে অথচ দেশের ইউনিটারি ক্যারেক্টারের সঙ্গে কোন সংঘাতপূর্ণ হবে না। সংঘাত হবে না আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী প্রণীত সংবিধানের সঙ্গেও। দেশকে মধ্য আয়ের দেশের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে দেশ প্রকৃত অর্থে মধ্য আয়ের দেশ হবে আবার সঙ্গে সঙ্গে লোক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ কোটি। তাই দেশ পরিচালনা পদ্ধতিতে এ পরিবর্তনের বিষয়টি এখনই চিন্তা-ভাবনার ভেতর আনা প্রয়োজন। এখন থেকে বিষয়টি চিন্তা-ভাবনার ভেতর নিলে অনেক চিন্তা বেরিয়ে আসবে, যার ফলে সবগুলো থেকে ভাল অংশটুকু নিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে আগামী দশ বছরের ভেতর একটি অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এখন একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অতি সহজ সূত্র অনুযায়ী, দেশ পরিচালনা করে রাষ্ট্রের সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক দল। তাই যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনা করবে ওই রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই সুসংগঠিত হতে হবে এবং তাকে সময়োপযোগী হতে হবে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় রাজনৈতিক দল আছে। আবার আগামী দশ বছরের ভেতর এর থেকে অনেক রাজনৈতিক দল হারিয়ে যাবে, অনেকগুলো রাষ্ট্র ক্ষমতার দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নামার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, অন্যদিকে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হবে। দেশ এখন এ ধরনের পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে। এ ধরনের পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে সাধারণত যে কোন দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের কাঠামোর ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটায়। যে দলটি বা দলগুলো পরিবর্তন ঘটাতে পারে সেটি বা তারা টিকে থাকে, অন্যদিকে যারা পরিবর্তন ঘটাতে পারে না তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার দৌড় থেকে ছিটকে পড়ে। বাংলাদেশে আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতার দৌড়ে টিকে থাকতে হলে বর্তমানের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই তাদের কাঠামো সময়োপযোগী করতে হবে। দলগুলোকেই আগে ভবিষ্যত রাষ্ট্র কাঠামোর উপযোগী করে নিজেদের কাঠামো সাজাতে হবে। সে ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে আগেই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের জেলা কাঠামোর বিন্যাস পরিবর্তন করতে হবে। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কাঠামো যেহেতু শক্তিশালী জেলা কাঠামো বিন্যাসের ওপর করা প্রয়োজন, সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোতে জেলা কাঠামোর জন্য আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমানের জেলা কাঠামোর পরিবর্তে অনেকখানি স্বাধীন জেলা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা অন্য অন্য দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর রাজ্য কাঠামো বা প্রভিন্স কাঠামোর আদলে হতে হবে। সে জন্য কেন্দ্রেও সাংগঠনিক সম্পাদকের বাইরে গিয়ে জেলা সম্পাদকের পদ সৃষ্টি করতে হবে এবং তার দায়বদ্ধতা ও স্বাধীনতার সীমারেখা তৈরি করতে হবে। জেলা সম্পাদক সব সময়ই নিজ নিজ জেলার লোক হতে হবে। জেলা কাঠামোর বিন্যাস যখনই পরিবর্তন হবে তখনই তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার নিচের প্রতিটি প্রশাসনিকও নির্বাচিত কাঠামোর পরিবর্তন হবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অন্যান্য দেশের জনসংখ্যাভিত্তিক রাজ্য বা প্রাদেশিক কাঠামোর সঙ্গে লোক সংখ্যার অনুপাত মেলাতে গেলে বাংলাদেশের জেলা কাঠামোর সঙ্গে মিলবে না। বরং অন্যান্য দেশের প্রদেশের তুলনায় বাংলাদেশে জেলার অনুপাত অনেক বেশি হয়ে যাবে। অন্যান্য দেশে প্রদেশ বা রাজ্য একটি রাজ্য বা প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করছে- যা পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে আংশিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল ছাড়া বাদবাকি ক্ষেত্রে তারা স্বাধীন। অন্যদিকে জেলা কাঠামো বিন্যাস পরিবর্তন করে জেলাকে যেখানে ক্ষমতাশালী করা হবে, সেখানে জেলা কেবল স্থানীয় সরকারের বিষয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, বাদবাকি সকল ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট ও নির্বাহীর কাছে সুপারিশ করবে। সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকছে না। এ কারণে এই ইউনিটগুলো প্রদেশের তুলনায় যত ছোট হয় ততই জনগণ, সরকার ও রাজনৈতিক দল লাভবান হবে। প্রতিক্ষেত্রে স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা সম্ভব হবে। রাজনৈতিক দলের কাঠামো বিন্যাসের সব সময়ই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। কখনও একটি রাজনৈতিক দলের কাঠামো গড়ে তোলা হয়, পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, কখনও বা রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য, কখনও সামরিক বা যে কোন আগ্রাসন থেকে গণতন্ত্র মুক্ত করার জন্য। উল্লিখিত লক্ষ্যগুলো সাধারণত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে স্থিতিশীল দেশের জন্য ভিন্ন হয়। যেমন থেচারের দীর্ঘ শাসনের শেষ দিকে ব্রিটেনের শিক্ষা, অর্থনীতিসহ বেশকিছু পরিবর্তনের জন্য সে দেশের লেবার পার্টি নিউ লেবার নাম নিয়ে তাদের সাংগঠনিক লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো এখন আর কোনক্রমে আন্দোলন-সংগ্রাম বা বিরোধী আন্দোলন ঠেকানোর জন্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নেই। বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য এখন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত একটি দেশ হওয়া। কোন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে হলে তাকে অবশ্যই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত হতে হয়। এই তিনকে এক স্রোতে বা একই তালে এগিয়ে নিতে না পারলে কখনই স্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসে না। বাংলাদেশ এখনও এই তিনকে একই স্রোতে বা সমান পদক্ষেপে প্রবাহিত করতে পারেনি। এই না পারার অনেক কারণ আছে কিন্তু এর ভেতর অন্যতম একটি কারণ রাষ্ট্র পরিচালনাকারী বা রাষ্ট্র পরিচালনার দৌড়ে আছে এমন কোন দলেরই মূল লক্ষ্য কিন্তু রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর এই তিন স্তম্ভকে এক স্রোতে বা সমান পদক্ষেপে এগিয়ে নেয়া নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এই তিনকে একত্রে নিয়ে এগুনোর কথা ভাবতে হবে। সমাজকে এ নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ দিতে হবে। সমাজের চিন্তা-ভাবনার সমন্বয় রাজনৈতিক দলগুলোকে আত্মীকরণ করতে হবে। যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জেলা কাঠামোতে জেলা বাজেটের ভেতর দিয়ে আঞ্চলিক চিন্তা ও প্রয়োজনীয়তা আসবে, তেমনি জেলা কাঠামোতে এমন একটা গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যারা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের বিষয়টি বুঝতে পারবেন ও সেভাবে বিশ্লেষণ করবেন। এখানে ওই সব ব্যক্তিকে অবশ্য তাদের পরামর্শ নিতে হবে যারা পরিবর্তনশীল সমাজ, পরিবর্তনশীল অর্থনীতি ও পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি- সর্বোপরি কোন্টা সংস্কৃতি এ বিষয়টি বুঝতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে পুরনো রাজনীতিকরা হয়ত অনেক ক্ষেত্রে বাদ পড়বেন, কারণ তাঁরা তাঁদের মাইন্ড সেট আপ থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারছেন না। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে । ঠিক একই ভাবে কেন্দ্রকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সেভাবে কাঠামো ও কাঠামোর সহায়ক বডি তৈরি করতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রকে বা নির্বাহী বিভাগকে যদি রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণে সার্বিক নির্দেশনা না দিতে পারে, তাহলে ওই রাজনৈতিক দল কিন্তু বাস্তবে দল হিসেবে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পারে না বলেই রাষ্ট্র রাজনীতিক বা সিভিল সোসাইটির থেকে বিভিন্ন ধরনের ব্যুরোক্রেসির প্রাধান্য দিতে বাধ্য হয় বা স্বাভাবিকভাবে ওই প্রাধান্য এসে যায়। সমাজ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কম চিন্তা করার ফলে বাংলাদেশের সমাজের একটা উদ্ভট পরিবর্তন ঘটে গেছে। সমাজের কালচারের স্থানটি রিলিজিয়ন দখল করে নিয়েছে। চল্লিশের দশকে খানিকটা এমনটি ঘটেছিল যা থেকে এ দেশকে মুক্ত হতে প্রায় দুই দশক সময় লাগে। তার ওপরে তখন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো শক্তিশালী ও আধুনিক যুবনেতা ছিলেন। তাঁর সহকর্মীদের একটি অংশও বড়মাপের সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। বাংলাদেশে এখন যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছে তা খুবই ভয়াবহ, সমাজের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে কালচারের স্থানটি রিলিজিয়ন দখল করে নিয়েছে। এমনকি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জীবনেও একই ঘটনা ঘটেছে। তাদেরও জীবনাচরণের সংস্কৃতির স্থানটি ধর্ম দখল করে নিয়েছে। আজ যে বাঙালী সমাজের মতো একটি সংস্কৃতিনির্ভর সমাজে জঙ্গীবাদ প্রবেশ করেছে এরও মূল কারণ এখানে। অধিকাংশের জীবনের সংস্কৃতির স্থানটি ধর্ম দখল করে নেয়াতে এদের ভেতর থেকে কারও না কারও সন্তান বা কোন না কোন ব্যক্তি জঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজ জীবনে এই যে পরিবর্তন এসেছে এর থেকে যে খুব দ্রুত পরিত্রাণ পাওয়া যাবে তা ভাবা ঠিক নয়। চল্লিশের দশকে এতটা পরিবর্তন আসেনি। তার পরেও ওই পরিবর্তন থেকে পরিত্রাণ পেতে, সংস্কৃতিকে তার নিজ আসনে বসাতে দুই দশক লেগেছিল। আরও উল্লেখ্য, ওই সময়ে যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো শক্তিশালী যুবনেতা ছিলেন, তেমনি একটি আধুনিক স্বাতন্ত্র্য চিন্তার অধিকারী সিভিল সোসাইটি ছিল। এখন এই দুইয়ের কিছুই নেই। এ কারণে ক্ষুদ্রের উপায় হিসেবে পিপিলিকার মতো দল বেঁধে এর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আর এ কাজে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো। এ জন্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক লক্ষ্যে এখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ পরিবর্তন- এই দুইয়ের মিলনে করতে হবে। বাংলাদেশ প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে জঙ্গী দমন করছে, সারা পৃথিবীও একই কাজ করছে। কিন্তু এই সমরশক্তি দিয়ে বাস্তবে চিরস্থায়ীভাবে জঙ্গী দমন করা যাবে না। তারা অন্তত আরও পাঁচ থেকে সাত বছর এভাবেই পৃথিবীকে রক্তাক্ত করবে। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে এমন বিন্যাস ঘটাতে হবে, ওই বিন্যাসের ফলে যাতে একটি অংশ নিরন্তর সামাজিক পরিবর্তনে কাজ করে যেতে পারে। রাজনৈতিক দলের এই অংশটি তেমন করেই সাজাতে হবে যাতে যারা এখানে কাজ করবেন তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট মিলিয়ে কাজ করার সুযোগ, ক্ষমতা পায় এবং সে কাজ করার যোগ্যতাও রাখে। বাস্তবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের কাঠামো পরিবর্তনের সময় এসে গেছে, পরিবর্তিত সময়ের রাজনৈতিক দল গড়া ছাড়া রাজনীতির এখন আর কোন বিকল্প নেই। [email protected]
×