ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৯ আগস্ট ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত

পৃথিবীতে একটি শব্দই আছে যার উচ্চারণগত এবং ধ্বন্যাত্মক বা ধ্বনিমূলক ব্যঞ্জনা বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম। সে শব্দটি হচ্ছে ‘মা’। মাকে ইংরেজীতে বলে মাদার আবার ফারসীতেও বলে মাদার, উর্দুতে আম্মা, আরবীতে উম্মু, সংস্কৃতিতে মাতা, মাতৃ, হিন্দীতেও মাতা, মা, এমনিভাবে নানা ভাষায় একই ধ্বনি বৈশিষ্ট্যে মা উচ্চারিত হয়। মার মতো এমন আপনজন এই সুন্দর পৃথিবীতে আর হয় না। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতার ভাষায় বলা যায়; মা কথাটি ছোট্ট অতি/কিন্তু জেনো ভাই/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর/ত্রিভুবনে নাই...। প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাসসাম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম মায়ের সৃষ্টি জগতে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠ করেই শেষ করেননি বরং তিনি বলেছেন: আল্ জান্নাতু তাহ্তা আক্দামিল্ উম্মাহাত- মায়ের পায়ের তলায় জান্নাত। মায়ের স্নেহ মমতার কোন তুলনা হয় না। মা সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কতই না কষ্ট করেন। সন্তানকে কম-বেশি ২৮০ দিন গর্ভে ধারণ করেন, মায়ের গর্ভে থাকাকালে মায়ের শরীর থেকেই সে খাবার গ্রহণ করে এবং সে যখন আলো হাওয়ার এই পৃথিবীতে আসে সে সময় মাকে অসহ্য যন্ত্রণা সইতে হয়। যদিও অধুনা সিজার ব্যবস্থা চালু হয়েছে সে ক্ষেত্রেও মায়ের শরীরই কাটতে হয়। মাতৃগর্ভরূপী জাহাজে করে দুনিয়ার বন্দরে অবতরণ করেন মায়ের বুকের দুধ পান করেই শিশুর ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। মায়ের দুধের মতো পুষ্টিকর ও উপাদেয় খাদ্য শিশুর জন্য আর কিছু নেই। মায়ের দুধের প্রথম অবস্থার কিছুটা ঘি দুধ যাকে শাল দুধ বলে এটা আল্লাহ্র এক অসাধারণ নি’আমত, যার তুলনা হয় না। শিশুর মুখে প্রথম যে বুলি ফোটে সেটাও মা শব্দ। এমনকি মা ডাক তার এত প্রিয় ডাকে পরিণত হয় যে সে পিপাসার্ত হয়ে পানি চায় মাম্্ শব্দ উচ্চারণ করে। মায়ের এক ফোঁটা দুধের ঋণ শোধ করতে পারে না কোন সন্তান। তাই তো প্রিয়নবী সরকারে দোআলম মায়ের খিদমত করতে বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বলেছেন ওই একই কথা, আর তা হচ্ছে মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের জান্নাত। একবার এক তরুণ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে জিহাদে অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন করল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লাম তরুণকে জিজ্ঞেস করলেন : বাড়িতে তোমার মা আছেন কি? তরুণ বলল : জি! হ্যাঁ আমার মা আছেন। তখন তিনি বললেন : যাও, বাড়িতে গিয়ে তোমার মার খিদমত কর। নিশ্চয়ই তোমার মায়ের পায়ের তলাতেই তোমার জান্নাত। (আবু দাউদ, নাসায়ী, বায়হাকী)। কুরআন মজীদে মায়ের সন্তান গর্ভ ধারণ এবং দুগ্ধপান করানোর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে : তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করে দারুণ কষ্টের সঙ্গে, তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও স্তন্য ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস। (সূরা আহ্কাফ : আয়াত ১৫)। এই কথা বলে মা সন্তানের জন্য কি কষ্ট যে করে তার বিবরণ কিছুটা তুলে ধরেছেন স্বয়ং আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু। মায়ের নিঃস্বার্থ মমতার কোন তুলনা হয় না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লাম মাত্র ছয় বছর বয়সে মাকে হারান। তিনি মাত্র দুই বছরকাল মার কোল পেয়েছিলেন, বাকি চার বছর দুগ্ধমাতা হযরত হালিমা সাদিয়া রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহার কোলে ছিলেন। চার বছর বয়সে মা আমিনার কোলে ফিরে এলে মা আমিনার বুক আনন্দে ভরে যায়। তিনি হয়ত ভাবেন আমার এই পবিত্র পুত্রের আব্বাজান মুহতারম আবদুল্লাহ্ বেঁচে থাকলে কতই না আনন্দের হতো। এই পুত্র গর্ভে যখন তিনি স্বপ্নে দেখেন একটা নূর (জ্যোতি) তাঁর দেহ থেকে বের হয়ে দিক-দিগন্ত আলোয় আলোয় ভরে দিচ্ছে, সেই আলোয় সিরিয়া ও বসরার প্রাসাদগুলো তাঁর সামনে উদ্ভাসিত হচ্ছে। যেদিন এই ছেলে ভূমিষ্ঠ হয় সেদিন সারা ঘর আলোয় আলোয় ভরে যায়। এই ছেলে গর্ভে থাকাকালে তাঁকে জানানো হয় এর নাম রেখ আহ্মদ। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লাম নিজেই বলতেন যে, আমি আমার মায়ের স্বপ্নের তাবীর। দুগ্ধমাতা হালিমা সাদিয়ার কাছ থেকে ফিরে আসার পর যতদিন মা আমিনা বেঁচে ছিলেন ততদিন হযরত মুহম্মদ (সা) মায়ের নিকট মক্কা মুকাররমায় ছিলেন। ছয় বছর বয়সের ছেলেকে নিয়ে মদিনায় তাঁর স্বামী আবদুল্লাহ্র মাজার জিয়ারত এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে যান। কিন্তু আবওয়া নামক স্থানে তিনি ইন্তেকাল করলে সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। মায়ের মৃত্যু-শোক বুকে নিয়ে হযরত মুহম্মদ (সা) তাঁদের গৃহপরিচারিকা উম্মু আয়মানের সঙ্গে মক্কা মুকাররমায় ফিরে আসেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব পৌত্রের লালন পালনের ভার নেন। সে আর এক অধ্যায়। এর বহুদিন পর মদিনায় হিজরত করে এসে হযরত মুহম্মদ (সা) সাহাবীগণকে সঙ্গে নিয়ে মা আমিনার কবর জিয়ারত করেছিলেন। এই জিয়ারতকালে তিনি নিজে খুব কেঁদেছিলেন, তা দেখে সাহাবায়ে কেরামও কেঁদেছিলেন। এ সময় তিনি বলেছিলেন : তোমরা কবর জিয়ারত করবে, কবর জিয়ারতকালে মৃত্যুর কথা স্মরণে আসে। (মুসলিম শরীফ, নাসায়ী শরীফ)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লাম দুগ্ধমাতা হালিমা সাদিয়াকে আপন মায়ের মতোই শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন। হালিমার গৃহে শিশু মুহম্মদ (সা) যখন লালিত পালিত হচ্ছিলেন তখন হালিমা টের পেয়েছিলেন এ শিশু সাধারণ শিশু নন, এ ভবিষ্যতের মহামানব। হযরত মুহম্মদ (সা) ৪০ বছর বয়সে নবী হিসেবে প্রকাশিত হলে হালিমা সাদিয়া ৩৬ বছর আগে যা ভেবেছিলেন তা সত্যে পরিণত হলো। ইসলাম গ্রহণ করলেন তিনি ইসলামের আহ্বান শোনার সঙ্গে সঙ্গে। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লাম তাঁর খোঁজখবর রাখতেন। হালিমা সাদিয়াকে দেখলে তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন এবং ‘মা’ ‘মা’ বলে নিজের চাদর বিছিয়ে তাঁকে বসতে দিতেন। হযরত আবু তুফায়ল (রাদি.) বলেন, একবার হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লাম উটের গোশ্ত বিতরণ করছিলেন তখন আমি বালক ছিলাম। আমি সেই উটের গোশ্তের একটা ভাগ পেলাম। এমন সময় আমি দেখলাম যে, সেখানে একজন বৃদ্ধ মহিলা এলেন। ওই মহিলা রসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লামের কাছে গেলে তিনি নিজের গায়ের চাদর মহিলাটির বসার জন্য বিছিয়ে দিয়ে তাঁকে সেই চাদরের ওপর বসালেন। আমি লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম এই মহিলা কে? লোকজন বলে উঠলেন : ইনি হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লামের দুধ মা হযরত হালিমা সাদিয়া। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের শওয়াল মাসে হুনায়নের যুদ্ধকালে হযরত হালিমা সাদিয়া প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লামের কাছে এলে তিনি তাঁর এই দুধ মার সম্মানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নিজের জিস্ম মুবাররকের চাদরখানি বিছিয়ে দিলেন। হযরত হালিমা সাদিয়া রাদিআল্লাহু আন্হাকে সেই চাদরের ওপর বসালেন। মাতৃভক্তির অপরূপ দৃষ্টান্ত প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লাম স্থাপন করে গেছেন। একবার এক সাহাবী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কাছ থেকে খিদমত পাবার হক (অধিকার) কার বেশি? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস ওয়া সাল্লাম বললেন : তোমার মাতার, সাহাবী বললেন : তারপর? তিনি বললেন : তোমার মাতার, সাহাবী আবার জিজ্ঞাসা করলেন : তারপর? তিনি বললেন তোমার মাতার। সাহাবী আবার জিজ্ঞাসা করলেন : তারপর তিনি বললেন : তোমার পিতার। সাহাবী আবার জিজ্ঞাসা করলেন তিনি বললেন, তারপর পর্যায়ক্রমে তোমার আত্মীয়স্বজনের (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ শরীফ)। মাতা-পিতা উভয়েরই সন্তানের ওপর হক রয়েছে, তবে মাত্রার দিক বিবেচনায় মায়ের হকই বেশি। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে আমি (আল্লাহ্) তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্টসহ গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার শোকর কর এবং তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (সূরা লুকমান : আয়াত ১৪)। মা যে কত মমতাময়ী তা প্রতিটি মানব সন্তানই উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় পুত্র সন্তান বিয়ে করার পর মাকে অবহেলা করে, এটা যে কত বড় গোনাহ্ তা উপলব্ধি করতে পারে না। পিতা-মাতাকে অবহেলা করলে সেই অবহেলাকারী সন্তান দুনিয়াতেই তার সন্তানদের কাছ থেকে পাবে। আজ আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ আগস্ট চলে গেছেন। তিনি আমাদের গর্ভধারিণী মা যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন নয় লক্ষাধিক মুরিদানের পীর আম্মা। আলহাজ্জা জোহরা খাতুন রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হা ছিলেন আমার মা। আব্বার বিশাল জমিদারী ও বিরাট সংসারে দক্ষ নাবিক ছিলেন আমার মা। তিনি বিশাল জমিদারীর মালিকা। আমাদের অসুখ-বিসুখে তিনি সারা রাত জেগে থেকে মাথায় পানি দেয়া, হাতে-বুকে সরিষার তেল মাখানো প্রভৃতি পরিচর্যার মধ্য দিয়ে রাত কাটাতেন। পরীক্ষার সময় নফল রোজা রেখে দু’আ করতেন। তিনি খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙাতেন মধুর ইলহানে দু’আয়ে হাবীবী পাঠ করে আর তা হচ্ছে : কুম্ কুম্ ইয়া হাবীবী কামতানামু আজাবাল্ লিল্মুহিব্ বিকায়ফা ইয়ানমু-দীর্ঘ এই দু’আয় আমাদের ঘুম ভাঙত ফুরফুরে আমেজে। দু’আয়ে হাবীবীর অনেক মাহাত্ম্য যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : এই দু’আয়ে পাঠকের অন্তর সব সময় প্রফুল্ল থাকে। আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিতেন। আমি তো বলতে পারি, আমার জীবনের সাফল্যের বিরাট অংশজুড়ে আমার মায়ের অবদান রয়েছে। আমার আব্বার পাশেই আমার মা শুয়ে আছেন। মার কথা মনে পড়লে মনটা বিষণœœ হয়ে যায়। পিতা-মাতার জন্য আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে : ওয়া কুররব্বিরহাম্ হুমা কামা রাব্বাইয়ানী সগীরা- আর বলো হে আমার রব্ তাঁদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন। (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ২৪)। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×