ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৯ জুলাই ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

ঈদের ছুটির পর চলতি সপ্তাহেই ঢাকা তার পুরনো চেহারা ফিরে পেল। আড়মোড়া ভেঙ্গে আবার তার শুরু হলো রুদ্ধশ্বাস ছোটা। রাস্তায় বেরুলে আবার সেই অসহনীয় ভিড়, যানবাহনের আধিক্য এবং অবধারিতভাবে ট্রাফিক জ্যাম। তবে এখনকার ঢাকা কিছুটা অজানা শঙ্কাগ্রস্ত; কোথায় যেন তার ভেতরে কাজ করে চলেছে বিমর্ষতা ও বিষণœতা। এদিকে শ্রাবণ এসে পড়েছে পঞ্জিকায়। অবাক কা- পঞ্জিকা মেনে রাজধানীও বরণ করে নিল শ্রাবণকে। পহেলা শ্রাবণ থেকেই ঢাকা বর্ষণমুখর। কখনো রিমঝিম কখনোবা মুষলধারে। একই সঙ্গে এটাও মানতে হচ্ছে যে শ্রাবণের চড়া রোদেও নিত্য ভিজছে ঢাকা। ব্যতিক্রমী শনি বহু বছর পর শনিবার সরকারী চাকুরেদের জন্য হলো সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। শুধু কি সরকারী চাকুরে? না, তা নয়। বেসরকারী ব্যাংকসহ বহু অফিস খোলা ছিল এই শনিবার। শনিবার সরকারী অফিস খোলা রাখার শর্তে ঈদের আগে ৪ জুলাই ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। তাদের জন্য ঈদের ছুটি লম্বা হতে হতে দাঁড়িয়েছিল নয় দিনে, মাসের এক-তৃতীয়াংশই বলা চলে। ঈদের পর, অর্থাৎ তার আগের রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী অফিস খুললেও সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবারেও পুরোদমে চালু হয়নি ঢাকার বহু অফিস। কিন্তু শনিবার একদমই ছিল ব্যতিক্রম। সেদিন অফিসে অফিসে ছিল বিপুল উপস্থিতি। বলা চলে চেনা ছুটির দিনেই ছুটি টুটে অচেনা রূপ নিল ঢাকা। বেশ ঘটা করেই শনিবারের সচিবালয়ের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে অনলাইন পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায়। একজায়গা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিতে প্রলুব্ধ হচ্ছি। লেখা হয়েছেÑ‘১১ বছর পর শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খোলা সরকারী সব অফিস-আদালত। কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। অন্য দিনের মতোই কাজে ব্যস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সকাল থেকেই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কক্ষে ছিল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবদের আনাগোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে সাপ্তাহিক ছুটির দিন অফিস করার শর্তে এবার ঈদে টানা ৯ দিন ছুটি কাটান সরকারী চাকরিজীবীরা। ছুটির এই সিদ্ধান্তে কাজের গতি বেড়েছে বলেও জানান কেউ কেউ। তবে দর্শনার্থীদের সংখ্যা অন্য দিনের তুলনায় ছিল কম। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।’ বিস্মরণ ও বিস্ফারণ যে শঙ্কাটি প্রায় বিস্মরণেই তলিয়ে গেছে সেটি যদি আবার বিরাটভাবে সামনে চলে আসে তাহলে তাকে বিস্ফারণ বললে ভুল বলা হবে না বোধকরি। বলছিলাম ভূমিকম্পের কথা। গত বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ কেঁপে উঠেছিল নেপালের ভূমিকম্পের প্রভাবে। সারা বছর এ নিয়ে কথা বলতে বলতে যখন বিষয়টি আমরা প্রায় হালকা করে ফেলে নতুন বছরে পা রাখলাম। ফের নতুন বছরের শুরুতে আবারও কেঁপে উঠল বাংলাদেশ ভূমিকম্পে। দেশের সীমানার বাইরে সংঘটিত ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশের ভূকম্পন নিয়ে নানা কথা উচ্চারিত হওয়ার পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেন বড় বড় ভূমিকম্প যা হওয়ার তা হবে দেশের সীমান্তের বাইরে। তার কিছুটা আঁচ হয়ত পাওয়া যাবে দেশে। কিন্তু গত সপ্তাহে নেচার জিওসায়েন্স সাময়িকীর গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশবাসী, আরেকটু স্পষ্ট করে বললে ঢাকাবাসী নড়েচড়ে বসেছে। গায়ে গায়ে লাগা বহুতল ভবনে ভরপুর ঢাকার দশা কী হবে যদি সত্যি সত্যি একটা ভূমিকম্প হয়েই যায়- এমনটা ভাবতেও মস্তিষ্ক হ্যাঙ হয়ে যাবার যোগাড়। প্রায় ১২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে যেসব তথ্য পেয়েছেন তা জেনে শঙ্কিত না হয়ে পারছি না। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের কিছু অংশে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলটির বিস্তার প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এতে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশসহ ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে একটি সুবিশাল চ্যুতির (ফল্ট) অবস্থানের কারণে এই এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এ রকম দুর্যোগে ঢাকাসহ বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলার বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। সেখানে বালু ভরাট করে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করতেও দেখা যায়। ভূমিকম্প হলে এ রকম ভবন সহজেই ধসে পড়বে। এছাড়া অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় সেখানে ভূমিকম্প হলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতায় বিঘœ হতে পারে। এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা আগামীকালই হতে পারে, আবার ৫০০ বছর পরেও হতে পারে। প্রবল আশাবাদী কেউ বলতেই পারেন, হুম ৫০০ বছর, সে তো ঢের দেরি। আমাদের দুর্ভাবনার কোন কারণ নেই। তবে যারা আশা-নিরাশায় দোলাচলে বাঁচেন, কিংবা যারা সচেতন তাদের মনের ভেতর অতিসাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার পাশাপাশি সম্ভাব্য ভূমিকম্পের আশঙ্কাও যে নিঃশব্দে কাজ করে যাবে তাতে কোনো সংশয় নেই। বাড়তি গোনার গণপরিবহন ঢাকার অপ্রতুল গণপরিবহন নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। কর্তৃপক্ষও বেশ আছেন কানে তুলো দিয়ে। তাদের জন্য রয়েছে কর্মস্থলের কিংবা ব্যক্তিগত বিলাসী মোটরকার। তারা গণপরিবহনের যাত্রীদের বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণা বুঝতে অপারগÑ এটা বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে। কারণ বছরের পর বছর দশকের পর দশক কেটে গেলেও এই খাতে বিশেষ অগ্রগতি দেখা যায় না। অতিসম্প্রতি শুরু হয়েছে আবার নতুন বিড়ম্বনা। রাজধানীতে রাতারাতি লোকাল বাস হয়ে যাচ্ছে সিটিং। ফলে বাধ্য হয়ে যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। বাসে যারা ওঠেন তাদের অধিকাংশের কাছেই পাঁচ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করা কষ্টসাধ্য। সেখানে সিটিং নামক চিটিংয়ের কারণে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে গিয়ে তাদের ভোগান্তি চরমে উঠছে। অথচ পুরো ব্যাপারটিই বেআইনী। সিটিং সার্ভিসের অনুমোদনই দেয়নি বিআরটিএ। জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে সিটিং প্রতারণার বিশদ চিত্র উঠে এসেছে। রাতারাতি সিটিং সার্ভিস চালুর কারণ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক জানতে চাইলে বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাড়তি সুবিধা লাভের আশা ও কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে এমন হচ্ছে। নাগরিকের প্রতি কারও কোন দায়িত্ববোধ নেই। যার যা ইচ্ছা তাই করছে। ফলে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে যাচ্ছে বাড়তি অর্থ। কিন্তু শ্রমিকরা লাভবান হচ্ছে না। মালিকরাই লাভবান হচ্ছেন।’ এখানে দুটো বিষয় পরিষ্কার। এক, যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। দ্বিতীয়ত, মালিকপক্ষেরই মুনাফা বাড়ছে। তার মানে একজন মালিক হাজারো যাত্রীর বিড়ম্বনার কারণ। মালিকরা কি অন্য গ্রহের বাসিন্দা? অথবা বলা যায় দেশটাকে কি তারা মগের মুল্লুক ঠাউরেছেন! প্রতিকৃতির প্রভাব শিল্পী এসএম সুলতানের প্রতিকৃতি নিয়ে নাসির আলী মামুন যশোরে আয়োজন করেছিলেন এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। তরুণ বয়সে সে প্রদর্শনীটি দেখে শিল্পীর প্রতি আকৃষ্ট হই, তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে। আমার সৌভাগ্য যে পরে কিছুকাল শিল্পীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। ঈদের পরপরই চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি প্রদর্শনী হয়ে গেল যিনি সত্যিকারার্থেই ছিলেন যুগের হাওয়ার সঙ্গে খাপ না খাওয়া এক মহীরুহ। নির্লোভ নিরহঙ্কার জীবন কাটিয়ে গেছেন তিনি আমাদের এই স্বার্থপর ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক দেশে দার্শনিক হিসেবে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। হ্যাঁ, সরদার ফজলুল করীমের কথাই বলছি। তরুণ আলোকচিত্রী ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতির তোলা তাঁর প্রতিকৃতিগুলো একালের সন্তানদের কাছে বিস্ময় নিয়েই উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করছি। এ প্রদর্শনী দেখে থাকলে গুণী মানুষটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। আর গুণী মানুষ সম্পর্কে জানতে গেলে কিছুটা প্রভাবিত হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। মানুষ এভাবেই তার পূর্বসুরীর প্রতি সম্মান জানায় এবং তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা লাভ করে। হাতে লাঠি, কাঁধে ঝোলা নিয়ে একহারা গড়নের সদাপ্রশান্তিময় অবয়বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণকারী মানুষটি খুব বেশিদিন হয়নি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাও তো দেখতে দেখতে দু’বছর হয়ে গেল। তাঁর প্রতিকৃতি তবু কী জীবন্ত! বনলতা রিডিংস মিরপুরের পশ্চিম মনিপুরের একটি শিল্পম-িত বাড়ির নাম বনলতা। বাড়িতে বসবাস করেন লেখকজুটি। তাদের আয়োজনে বাড়িটিতে এর আগে বেশ ক’টি লেখক-আড্ডা হয়েছে। এবার সেই আড্ডাটিকেই আরেকটু অর্থময় করতে নেয়া হলো নতুন পরিকল্পনা। নতুন ভাবনা থেকে সূচনা হলো ‘বনলতা রিডিংসের’। একঝাঁক বিভিন্ন বয়সের লেখক নিজেদের রচনা থেকে পাঠ করবেন। সেই রচনা হতে পারে গল্প কিংবা কবিতা, কোন অনুবাদ অথবা উপন্যাসের অংশবিশেষ। একজন পড়া মানে বাদবাকি সবার শোনা। লেখকদের মধ্যে এভাবে সরাসরি সংযোগও তৈরি হবে। এটা ঠিক যে একজন লেখক তার সমকালের সব লেখকের লেখার সঙ্গেই পরিচিত থাকবেন, এমনটা প্রায় অসম্ভব। ব্যক্তিগত চেনাজানা থাকলেও এক লেখকের কাছে অপর লেখকের লেখা অপঠিত থেকে যেতে পারে। তাই এ ধরনের আয়োজন থেকে লেখকদের নিজেদের লেখা অপর সতীর্থ লেখকের কাছে সরাসরি তুলে ধরার অবকাশ তৈরি হয়। এটাই বরং তাৎপর্যপূর্ণ। এমনিতে ব্যস্ত ঢাকায় এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাতায়াত কিছুটা ঝক্কিরই বটে। নানা কারণেই লেখকদের আড্ডা কমে এসেছে ঢাকায়। তাই এমনতর আয়োজনে লেখকের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎ এবং পারস্পরিক মত বিনিময় কুশল বিনিময়ের সুন্দর একটি সুযোগ মেলে। বনলতা রিডিংসে যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের ভেতর লেখক নন এমন পাঠকও ছিলেন, ছিলেন গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পীও। পাঠপর্ব শেষে ছিল সঙ্গীত পরিবেশন। তারপর একসঙ্গে রাতের খাবার গ্রহণ। এমন একটি উপভোগ্য সান্ধ্য আয়োজনের জন্য ফারহানা-ফারসীম জুটি উপস্থিত সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছেন। এ ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠে অংশ নেন ফরিদ কবির, লুৎফুল হোসেন, কামরুল হাসান, পিয়াস মজিদ, সুলতানা শাহরিয়া পিউ, জাকিয়া নাজনীন প্রমুখ; ফিকশন রিডিংয়ে অংশ নেন রাশেদা নাসরীন, মাসউদুল হক, তানিম কবির, সায়কা শারমিন, ইসমাত খান প্রমুখ। আর গজল পরিবেশন করেন মঞ্জুরুল ইসলাম খান। ১৭ জুলাই ২০১৬ [email protected]
×