ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ডট বাংলা ডোমেইন চাই

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৪ এপ্রিল ২০১৬

একুশ শতক ॥ ডট বাংলা ডোমেইন চাই

আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এটি রক্ত দিয়ে কেনা। সংবিধান আমাকে বাংলার প্রয়োগের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। সরকার সংবিধানের রক্ষক হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রের সকল কাজে প্রয়োগ করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে রাষ্ট্র সেই কাজটি যথাযথভাবে করছে না। খুব সাম্প্রতিককালে ছোট একটি খবর আমার মতো কিছু লোককে আশঙ্কিত করেছে। বিশেষ করে আমরা যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার প্রকৃত সম্মান পেতে চাই তাদের জন্য খবরটি আরও একটি দুঃসংবাদ। যিনি বা যারা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ দেখতে চান তারা আরও একটি হতাশার খবর পাচ্ছেন। খবরটি অনেক পুরনো। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ইন্টারনেটের ডোমেইন নাম হিসেবে দুটি শব্দ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিল। এর একটি ডট বিডি, যা এখন আমরা ব্যবহার করতে পারি। আরও একটি ডোমেইন নাম আমাদের জন্য বরাদ্দ করা আছে, যেটিকে ডট বাংলা বলা হয়। ডট বিডি আমরা রোমান হরফে ব্যবহার করি। রোমান হরফে ডোমেইন নাম লিখে তার সঙ্গে আমি নিজের দেশের ডোমেইন নামের পরিচিতি হিসেবে ডট বিডি ব্যবহার করতে পারি। যেসব দেশের ভাষায় রোমান হরফ ব্যবহৃত হয় তাদের জন্য এটি কোন সঙ্কট নয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় আমি বাংলা ভাষায় বাংলা হরফে আমার ডোমেইন নাম ব্যবহার করতে পারি না। ডট বাংলা দিয়ে আমরা ইন্টারনেটের নামের জায়গায় আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলায় বাংলা হরফে ব্যবহার করতে পারব। জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা পাওয়ার চাইতেও এটি আমার ভাষার জন্য অনেক বেশি জরুরী। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ইন্টারনেটে একটি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে এই ডোমেইন। যেমন ডট ইউএস ডোমেইন নামের কোন ওয়েবসাইটে ঢুকলে বোঝা যায় সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ওয়েবসাইট। ডট বাংলা তেমনি ইউনিকোড দিয়ে স্বীকৃত বাংলাদেশী ডোমেইন। এই ডোমেইনটির ব্যাখ্যায় উইকিপিডিয়া বলছে, ডট বাংলা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি দ্বিতীয় ইন্টারনেট কান্ট্রি কোড টপ-লেভেল ডোমেইন (সিসিটিএলডি)। এই ডোমেইন বাংলা ভাষায় ওয়েব ঠিকানার জন্য বোঝানো হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ দুটি ডোমেইনের মালিক। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ডট বিডি ডোমেইন ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। ডট বাংলা ডোমেইনের বরাদ্দ সম্পর্কে যেসব তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে তাতে এটি জানা যায় যে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ ডট বাংলা ব্যবহারের আবেদন করে। সেই সময়ে ভারত সরকারও পশ্চিমবঙ্গের জন্য ডট বাংলা ডোমেইন নেম দাবি করে আবেদন করেছিল। বাংলাভাষী হিসেবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যও ডট বাংলা পেতে পারত। যাহোক, পশ্চিমবঙ্গের দাবি থাকার পরও বাংলাদেশকে ডট বাংলা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। ডট বাংলা ও ডট বিডি ডোমেইন নিয়ে দৈনিক সান পত্রিকার ১৯ জানুয়ারি সংখ্যার খবরটি প্রণিধানযোগ্য। খবরটি এরকম : The government will introduce a policy guideline to filter vulgar contents before formally launching dot bangla (bangla) domain. Bangladesh Telecommunication Compaû Limited (BTCL) has already prepared a draft of the guideline and sent it to the Posts and Telecommunications Division last week for its approval, an official informed. He said the BTCL has formulated the draft guideline following the relevant policies in India. We are concerned about vulgar contents once bangla domain is introduced for websites, the official said. He said the policy would help filter inappropriate content from bangla domains. টেলিকম বিভাগের এসব প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে ও প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাসে এটি ধারণা করা হয়েছিল যে, এবার কেবল ডট বাংলা ডোমেইন নয় আরও ভাল কিছু আসবে। এদিকে পত্রিকাটির খবর থেকে আরও জানা যায় যে, সরকারের পক্ষ থেকে ডট বাংলা ডোমেইন ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকেই ব্যবহারের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ সরকার ডট বাংলা ডোমেইনের অনুমোদন পায়। কিন্তু তারপর আর পথ এগোয়নি। অন্যদিকে ডট বিডির অবস্থাও যে ভাল নয় সেটি দৈনিক সান পত্রিকার খবরে প্রকাশিত হয়। Another official said they have so far registered over 25,000 .bd domains. He also said the number of dot bd domain would exceed 50,000 before introduction of the country code top level domain. The government had registered the dot bd domain in 2003, but only 9,000 web addresses were registered under the domain till 2012 for lack of publicity. The proposed policy would help increase registration of (bangla) domains as well as creating a nwe platform for Bangladesh in the digital gamut, officials said. খুব সঙ্গত কারণেই এটি প্রত্যাশা করা হয় যে, সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে এবং ডট বাংলা ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু ২০১৫ সালের জুন মাসে এসেও জানা যায় যে, সরকার ডট বাংলার হেফাজত করার জন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদান না করার ফলে তিন বছরে ডট বাংলার কোন অগ্রগতি হয়নি। জুন মাসে মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপক আলোড়ন তুললে মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কাজটি বিটিসিএলকে করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা তখনই জানতে পারি বিটিসিএল এজন্য সার্ভার স্থাপনসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইকানকে জানানো হয়। তারপর আট মাস অতিক্রম করলেও আমরা এখনও ডট বাংলা ব্যবহার করতে পারছি না। আমরা আরও স্মরণ করতে পারি যে, টেলিকম প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬-এর মাঝে ডট বাংলা চালু করার আশ্বাস দিয়েছিলেন (দৈনিক সমকাল ১৭ নবেম্বর ১৫)। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি চলে যাবার পর এখনও ডট বাংলার কোন খবর নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বিষয়টি কেবল একটি বোর্ড মিটিং-এর অপেক্ষায় রয়েছে। বিষয়টি নাকি কেবল আনুষ্ঠানিকতার। সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এসব সান্ত¡নার বাণী আর যাকেই তুষ্ট করুক আমার তো ভাল লাগেনি। আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি যে, আমি ইন্টারনেটে আমার নিজের ভাষায় নিজের ডোমেইন নাম লিখতে পারব। আমার কাছে এটিও সন্তোষজনক নয় যে, সময়গুলো এভাবে কেন চলে গেল। কেন এমনটি কেবল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই হয়। যে রাষ্ট্রের জন্ম বাংলা ভাষার জন্য সেই রাষ্ট্রে কি এমনটি হওয়া উচিত? আমরা বাংলা ভাষার নামে দেশটা তৈরি করেছি। বাংলা ভাষার সঙ্গে সাহিত্য ও সংস্কৃতি মিলে এই জাতির নিজস্ব সত্তা তৈরি হয়েছে। সেই সত্তাকে স্বাধীনতা পূর্বকালে যেমনি আঘাত করা হয়েছে তেমনি এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। আমি বহুবার বলেছি যে, স্বাধীন হবার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেসব দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তাকে জিয়াউর রহমান ধুলায় মিশিয়ে দেন। এরশাদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আইন করলেও বাংলা ভাষা এখনও সর্বস্তরের ভাষা নয়। এদেশে বেসরকারী বড় ব্যবসা, ব্যাঙ্কসহ বাণিজ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয় না। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষা নিষিদ্ধ। ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে শিশুরাও মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা নেই। এমনকি ডিজিটাল রূপান্তরের নামে বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাংলা হরফকেও বিদায় করা হয়েছে। সরকারের কেউ কেউ রোমান হরফে বাংলা লেখাকে উৎসাহিত করে। আমরা সারা দুনিয়ার মতো নিজেদের ভাষা নিয়ে ইন্টারনেটেও চ্যালেঞ্জে রয়েছি। ইউনিকোডে বাংলার সমর্থন থাকায় আমরা এখন সকল অপারেটিং সিস্টেম ও ডিজিটাল ডিভাইসে বাংলা লিখতে পারি। তবে ইন্টারনেটে বাংলার চর্চা কতটা হয় সেটি ফেসবুক-টুইটার-গুগল প্লাস দেখলে বোঝা যায়। সরকারী সাইটগুলোতে বাংলা অবহেলিত ভাষা হিসেবে ব্যবহার হয়। সরকারী ফরম ইত্যাদিতে এখন ডিজিটাল রূপান্তরের নামে ইংরেজী ব্যবহৃত হয়। যদি আমাদের ডট বাংলা ডোমেইন আসে তবে আমি আমার নিজের ওয়েবসাইটটিকে বাংলায় প্রকাশ করে এই ভাষার যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম সেটি সম্ভবত সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল অনুভব করেননি। ধরা যাক বিজয় হচ্ছে আমার একটি প্রকাশনার নাম। আমি এখন ইন্টারনেটে রোমান হরফে এই নামটি লিখি। কিন্তু আমার যদি ডট বাংলা ডোমেইন পাবার অবস্থা থাকত তবে বাংলা হরফেই আমি এই নামটাকে প্রকাশ করতে পারতাম। আমরা হতভাগা এজন্য যে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেটি এসএমএস হোক বা কম্পিউটারে হোক কিংবা স্মার্ট ফোনেই হোক রোমান হরফে বাংলা লেখাকে গ্রহণ করে ফেলেছি। যে জাতি পাকিস্তান আমলে আরবী হরফে বাংলা লিখতে রাজি হয়নি বা রোমান হরফকে বাংলা ভাষার বাহন হতে দেয়নি সেই দেশটি স্বাধীন হবার পর ইন্টারনেটের নামটাকে বাংলা করার সুযোগ পেয়েও সেটি ব্যবহার করতে পারছি না এই কষ্ট রাখার কি কোন ঠাঁই আছে? আমি মনে করি যাদের অবহেলায় চার বছরে ডট বাংলা ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি তাদের চিহ্নিত করা উচিত এবং তাদের জন্য বাঙালী জাতি, তার ভাষা ও হরফের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য শাস্তি দেয়া উচিত। সংবিধানের তিন নং ধারার আলোকে বাংলা ব্যবহার না করা অসাংবিধানিক। আমি মনে করি জাতিকে বাংলা ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়াতে অবহেলা করা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কারণ রাষ্ট্রটাই বাংলার ওপর দাঁড়ানো। আমি সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আবেদন করব তারা যেন কেবল অবহেলার খোঁজই করেন না, অবিলম্বে ডট বাংলা ব্যবহার করতে পারার অধিকারটি অর্জনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমি ইন্টারনেটে আমার নাম থেকে বাংলা হরফকে হারানোর যে যাতনার মাঝে বাস করি তার চূড়ান্ত অবসান চাই। একই সঙ্গে তাদের একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ডট বাংলা ডোমেইনের ব্যবস্থাপনাকে মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য করবেন না। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ইচ্ছা থাকার পরও এখন ডট বিডি ডোমেইন সহজে নিবন্ধন করা যায় না। বিটিসিএল এটিকে এমন জটিলতায় বেঁধে রেখেছে যে, হয়রানির জন্য কেউ বাংলাদেশের পরিচয়ে ডোমেইন না নিয়ে আমেরিকার ডোমেইন গ্রহণ করে। আমি ডট বাংলাকে ইউএস ডোমেইন নিবন্ধন ও হোস্ট করার মতো সহজ করার দাবি জানাই। আমি ঠিক জানি না, আমাদের আরও একটি ফেব্রুয়ারি অবধি ডট বাংলা ডোমেইন লেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কি-না। কামনা করি এমন দুঃসময় বাংলা ভাষার না হোক। ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×