ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

‘ওরে সাম্পানওয়ালা...’

কর্ণফুলীর হাজার বছরের ঐতিহ্য সাম্পান

নয়ন চক্রবর্ত্তী

প্রকাশিত: ০০:৩৮, ৮ জুলাই ২০২৫

কর্ণফুলীর হাজার বছরের ঐতিহ্য সাম্পান

ঐতিহ্যবাহী সাম্পান। কক্সবাজার উপকূলে বিশেষ ধরনের এ নৌকা এক সময় মালামাল পরিবহন ও যাত্রী পারাপারের কাজে ব্যবহার হতো

‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানি/ লুসাই পাহাড়ত্তুন নামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী (ছোট ছোট ঢেউ তুলে পানি লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এসে চলে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদী) চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আঞ্চলিক গানের ছন্দে চলে আসছে কর্ণফুলী নদীতে হাজার বছরের ঐতিহ্যের সাম্পান। এই সাম্পান নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি কালজয়ী গান ‘ও রে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা।’ লোকজ গান ও সংস্কৃতিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে সাম্পান।
সাম্পান বলতেই চোখে ভেসে ওঠে চট্টগ্রাম ও উচ্ছল কর্ণফুলী নদীর বুকে ব্যতিক্রমী জলযানটির কথা। সঙ্গে লোকজ সংস্কৃতি ও হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা। এক কথায় চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের স্মারক সাম্পান। তবে সময়ের পরিক্রমায় জৌলুস হারালেও এ অঞ্চলের হাজারো পরিবারের জীবিকা এবং অর্থনীতিতে এর অবদান এখনো কম নয়। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা এবং শহরের কয়েকটি এলাকার হাজার হাজার মানুষের জলপথের জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম সাম্পান।
এখনো ১০ থেকে ১৫ টাকায় কর্ণফুলী পারাপার করে সাম্পান। তবে যুগের বির্বতনে সাম্পান চলছে ইঞ্জিনের সাহায্যে। আগের মতো হাত দিয়ে চালিত চট্টগ্রামের সাম্পান চালানোর সময় ‘কেঁ কুরুত’ শব্দ শোনা যায় না। এ শব্দটি এখন শুধু কোনো যাত্রী সাম্পান কয়েক ঘণ্টার জন্য ভাড়া করলে তবেই শোনা যায়। কারণ, যাত্রীরা মাঝিকে বলে বৈঠা দিয়ে সাম্পান চালাতে অনুরোধ করেন। এখন সব সাম্পানই ইঞ্জিনচালিত। সাম্পান টিকে থাকলেও তা হয়তো কয়েক বছর পর থাকবে হাতেগোনা।
নগরীর ব্রিজঘাট ও অভয়মিত্র ঘাটে প্রতিদিন নোঙর করা থাকে শতাধিক সাম্পান। এছাড়া ফিশারিঘাট, নতুন ব্রিজ, ভেড়ামার্কেট, রাজাখালী, চাক্তাই, ১৫ নম্বর ঘাট, পতেঙ্গা, কাট্টলী, রাউজানের লাম্বুরহাট, বোয়ালখালীর খরণদ্বীপ, তাঁতঘরসহ বিভিন্ন ঘাটে সাম্পান চলাচল করে ভোর থেকে গভীর রাত অবদি। ঈদ, বিভিন্ন  উৎসব ও সরকারি ছুটিতে কর্ণফুলী নদীতে সাম্পান ভ্রমণের কারণে  তখন সাম্পানের ব্যাপক চাহিদা থাকে। তখন কর্ণফুলীর দুইপাড়ে যাত্রীদের উপস্থিতিও থাকে সরব। তবে উৎসব ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে নগরীর ব্রিজঘাট টু ফেরিঘাটসহ বিভিন্ন ঘাটে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী পারাপার হয়। সাম্পান চট্টগ্রামের বাণিজ্য, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এবার আসা যাক সাম্পান এলো কোত্থেকে। শব্দটিই বিদেশি। চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে এসেছে। যার অর্থ তিন মাথা। চট্টগ্রামে সাম্পান কিন্তু তিনমাথা। এ রকম আকৃতির নৌযান অন্য কোথাও নেই। তবে হ্যাঁ এটি প্রথম আসে মিয়ানমারের রেঙ্গুন থেকে। তখন রেঙ্গুনের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য ছিল । সওদাগররাই রেঙ্গুন থেকে এ সাম্পান আনেন। যা ধীরে ধীরে এদেশে তৈরি হয়। এখন হাতেগোনা সাম্পান তৈরি হয়।
যেখানে নির্মাণ করা হয় সাম্পান ॥ চট্টগ্রামের নতুন ফিসারিঘাট,  কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড়,  রাজাখালী, ফিশারিঘাট, কাট্টলী, পতেঙ্গা, আনোয়ারা,  শঙ্খের পাড়, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের মহেশখালী, বদরখালী, কুতুবদিয়ায় এখনও সাম্পান তৈরি হয়। তবে এক সময় পটিয়া, মাতারবাড়ি, টেকনাফ,  রামু, গুনধুম, হ্নীলাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের সব উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নদীর তীর এবং খালপাড়েই সাম্পান তৈরির বড় বড় কারখানা ছিল। আরাকান ও টেকনাফের সাম্পানগুলোর বেশিরভাগই সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। এক সময় ১০ থেকে ১২ হাজার সাম্পান থাকলেও এখন তা নেমে এসেছে ১ হাজার ১শ’তে।
চট্টগ্রামে সাম্পানকে উপজীব্য করে সমৃদ্ধ ছিল অর্থনীতি। এখন আগের মতো না হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় উল্লেখ্যযোগ্য পণ্য ও যাত্রী পারাপার হয় সাম্পানের মাধ্যমে। যার বহর দেখা মেলে কর্ণফুলীতে প্রতিদিন।
বোয়ালখালী, কর্ণফুলী, আনোয়ারা, রাঙ্গুনিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নেওয়া হয় সাম্পানে। একইভাবে কর্ণফুলীতে ও পতেঙ্গার মোহনা ও আনোয়ারায় হাজার হাজার যাত্রী পারাপারে ব্যবহৃত হয় সাম্পান।
সাম্পানকে উপজীব্য করে এ অঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে হাজার বছর, যা এখনো অম্লান। রচিত হয়েছে নানা রূপকথার গল্প, নাটক ও গান। সেই এক বিখ্যাত গান ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা’
সাম্পান দেখতে যেমন ॥ সাম্পানের নির্মাণশৈলী অন্য সব নৌযান বা নৌকা থেকে বেশ ব্যতিক্রম। সাম্পানের সামনের দিকটা বাঁকানো চাঁদের মতো, যাতে নদী ও সমুদ্রের ঢেউ অতিক্রম করে সামনের দিকে যেতে পারে। আর পেছনের দিকটা সোজা আর অনেকটা শিংয়ের মতো। তবে সাম্পানের আকৃতি অনেকটা হাঁসের মতো বলা যায়। চট্টগ্রামের ছোট সাম্পানগুলো নগরীতে দেখা গেলেও বড় আকৃতির সাম্পান দেখা যায় সাগর উপকূলের উপজেলা ও কক্সবাজারে। 
এদিকে কর্ণফুলীতে এখনো যে সব সাম্পান মাঝি তাদের বাপ- দাদার পেশা টিকিয়ে রেখেছে, তাদের অধিকাংশের বাড়ি মইজ্জ্যারটেক ও কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে। ব্রিজঘাট ও ফেরিঘাটকেন্দ্রিক তাদের আনাগোনা। অনেকে অন্যের সাম্পান ভাড়া নিয়ে চালালেও বেশিরভাগই নিজের সাম্পান নিয়েই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্ণফুলীর পারাপারের কাজটিই করেন। তবে আক্ষেপ, তাদের এ পেশার মর্যাদা দিন দিন বিলুপ্তির পথে। কেননা, ইঞ্জিনচালিত সাম্পানের তোপে এখন পেশা ঠিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ। 
কর্ণফুলী নদী সাম্পান চালক কল্যাণ সমিতি ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন, তারা ১০টি ঘাটে সাম্পান চালান। তবে ইজারাসহ বিভিন্ন জটিলতায় এখন পেশা হারিয়ে যাওয়ার পথে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন রকমের চাঁদাবাজি। বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে তারা বংশপরম্পরায় এখনো কর্ণফুলীর বুকে রাতদিন সাম্পান নিয়ে নামে। ঈদ-উৎসব ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া তেমন ভাড়া ওঠে না দাবি সাম্পান মাঝিদের। তবে সাম্পান মাঝিরা কর্ণফুলী রক্ষা ও দূষণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। তারা কর্ণফুলীকে বাঁচিয়ে রাখতে সাম্পান যাত্রা, নৌকা বাইচ, সভা-প্রতিবাদ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।

প্যানেল হু

×