
বকেয়া বেতন দাবিতে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ‘মার্চ টু যমুনা’
বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে পল্টন থেকে মিছিল নিয়ে কাকরাইল মোড়ে উপস্থিত হন টিএনজেড গ্রুপের ৮টি প্রতিষ্ঠানের কয়েক শতাধিক গার্মেন্টস শ্রমিক। এ সময় যমুনা অভিমুখে যাত্রায় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে কাকরাইল মোড়েই অবস্থান নেন তারা।
সেখানে অবস্থানকালে বৃষ্টি শুরু হলেও ভিজেই দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। আন্দোলনকারীরা ত্রিপক্ষীয় চুক্তি মোতাবেক শ্রমিক-কর্মচারীদের সব পাওনা পরিশোধের দাবি জানান। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সড়ক ছাড়বেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এদিকে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি অবরোধ করে আন্দোলনের ফলে সেখানকার সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ওই এলাকা ও আশপাশের সড়কেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
জানা যায়, বকেয়া বেতনের দাবিতে টানা ৯ দিন ধরে বিজয় নগরের শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নেন আশুলিয়ায় অবস্থিত চেইন অ্যাপারেলস লিমিটেড, গাজীপুরে অবস্থিত টিএনজেড গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠান ও ডার্ড গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা। সেখানকার সড়ক অবরোধ করেও আন্দোলন করেছিলেন তারা। এর পর সচিবালয়ের সামনেও দাবি নিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু দুই জায়গায় টানা নয় দিন হাঁটাহাঁটি করেও কোনো সুরাহা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে যমুনা ঘেরাও কর্মসূচি দেন তারা, এমনটি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
পূর্ব ঘোষণার অংশ হিসেবে দুপুর আড়াইটার পর রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে যমুনা অভিমুখে যেতে থাকেন কয়েকশ’ গার্মেন্টস শ্রমিক ও শ্রমিক নেতারা। বিকেল ৩টায় মিছিলটি কাকরাইল মসজিদ মোড়ে এলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাতে বাধা দেয়। এর পর থেকে তারা সেখানেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
এতে কাকরাইল মসজিদ থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালমুখী রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া মৎস্যভবন থেকে কাকরাইলমুখী সড়কে চলাচলকারী যানাহনও আংশিক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিকেল সোয়া ৩টায় বৃষ্টি শুরু হলেও অবস্থান ছাড়েননি পোশাক শ্রমিকরা। বৃষ্টিতে ভিজেই তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে দেখা যায়।
আন্দোলনকারী গার্মেন্টস শ্রমিক লুৎফর জানান, তিনি ৮ বছর চেইন অ্যাপারেলস লিমিটেডে চাকরি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি ৩ মাস ধরে কোনো বেতন দিচ্ছে না। এমনকি তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করেনি। এর আগেও গাজীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে তারা আন্দোলন করেছেন। তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে অনেক শ্রমিক আহত হন।
লাঠিচার্জ করে আহত করার ঘটনাও কিছু হয়নি, বেতনেও পাইনি। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ৩/৪ মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। চাল-ডাল, তরকারি কেনার টাকা নেই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এক প্রকারে না খেয়ে আছি। দেওয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। হয় এখান থেকে বেতন নিয়ে যাব, না হয় লাশ যাবে।
আরেক শ্রমিক সুমাইয়া ইয়াসমিন বলেন, আমরা শ্রমের মূল্য চাইতে আসছি। ভিক্ষা চাইতে আসিনি। শ্রমের মূল্য দিলে আমরা পরিবারের কাছে ফিরে যাব। অন্যথায় যমুনা ঘেরাও করা হবে, রাজপথ ছাড়ব না।
সরেজমিন দেখা যায়, পুলিশ কাকরাইল মসজিদ বরাবর পূর্ব পাশের সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। সেখানে অসংখ্য পুলিশ সদস্য ব্যারিকেড ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যারিকেডের বাইরে শ্রমিকরা অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন। বিকেল ৩টার দিকে বৃষ্টি এলেও শ্রমিকদের কেউ সড়ক থেকে সরেনি। তাদের হাতে থাকা বড় বড় ব্যানার মাথায় ধরেন। তাতেও কাজ হচ্ছিল না।
বৃষ্টিতে সবাই ভিজে যান। এর মধ্যেই বিক্ষোভ করতে থাকেন আর বলতে থাকেন- ‘বেতন চাই, বোনাস চাই, চূড়ান্ত হিসাব আজই চাই’, ‘১৮ মাসের ঘাম কোথায়? টিএনজেড জবাব চাই!’, ‘মেহনতি মানুষের ঘাম বৃথা যেতে পারে না’, ‘যেখানে বেতন নেই, সেখানে শান্তি নেই!’, ‘আমরা চাই না দয়া, চাই ন্যায্য পাওনা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এদিকে বৃষ্টির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাময়িকভাবে কিছুটা পেছনে সরে গেলেও পরে আবার বৃষ্টির পরই আগের অবস্থানে ফিরে আসেন।
ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘিরে কাকরাইল ও আশপাশে যে কোনো ধরনের আন্দোলন ও মিছিল নিষিদ্ধ। তবে তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছে, তাই আপাতত কোনো সমস্যা নেই। যদি কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কিংবা পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্তও শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সড়ক ছাড়বেন না।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি অবরোধ করে আন্দোলনের ফলে ওখানকার সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ওই এলাকা ও আশপাশের সড়কেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গুলিস্তান-সদরঘাট থেকে আসা যানবাহন মৎস্য ভবন দিয়ে ঘুরিয়ে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। মিন্টো রোড থেকে কাকরাইলের দিকে যাওয়া যানবাহন পল্টন দিক দিয়ে যেতে দেওয়া হয়।
এদিকে কারওয়ান বাজার থেকে যাওয়া যান হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের আগ দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। আবার শাহবাগ ছাত্রদলের অবরোধের ফলে ওখান দিয়েও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শাহবাগ, মৎস্য ভবন, কাকরাইলসহ আশপাশের এলাকা বন্ধ থাকায় নগরীতে যানজটের সৃষ্টি হয়, যা নগরীর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তবে আন্দোলনকারীরা কখন সড়ক ছাড়বেন তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। আন্দোলনকারীরাও সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দেন।