ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লায়লা সামাদ এক বিস্ময়কর প্রতিভা

মেরীনা চৌধুরী

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ২১ এপ্রিল ২০২৩

লায়লা সামাদ এক বিস্ময়কর প্রতিভা

লায়লা সামাদ

বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এক বিশিষ্ট ও অতি পরিচিত নাম ‘লায়লা সামাদ’ যে নাম আজ প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে। সেই যুগে যখন এদেশের শিক্ষিত মেয়েদের সংখ্যা হাতের আঙ্গুলে গোনা যায় তখন তিনি দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে ধ্রুব তারার মতো  জ্বল জ্বল করেছেন। তিনি সাংবাদিকতায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে স্বর্ণপদক লাভ করেন। সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প লিখেছেন, রচনা করেছেন উপন্যাস। নাটক রচনা করেছেন, অভিনয় করেছেন মঞ্চে, নাটক অনুবাদ ও পরিচালনা করেছেন। সম্পাদনা করেছেন মাসিক পত্রিকা, কলাম লিখেছেন সৌন্দর্য চর্চা নিয়ে।

ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। লায়লা সামাদ আমাদের সমাজের এক বিস্ময়কর প্রতিভার অন্য নাম। এই গুণী নারিকে প্রথম দেখি যখন আমার বয়স পাঁচ। আমাদের বগুলাগাড়ির গ্রামের বাড়িতে। তিনি ছিলেন আমার চাচির বড় বোনের মেয়ে। এই প্রথম শহরের একজন সুদর্শন, ফ্যাশনেবল মহিলাকে অবাক বিস্ময়ে তাকাই। তিনি আমার বোন মোমেনা ছালেককে জিজ্ঞাসা করেন-মেয়েটি কে? 
-আমার ছোট বোন
-ভারি মিষ্টি মেয়ে তো?
দীর্ঘদিন পর আবার তাকে দেখি কোলকাতায় পার্ক সার্কাসের মর্জিনা করিমের বাসায়। তিনি ছিলেন লায়লা সামাদের ছোট খালা। তখন আমি কিশোরী। তাকে দেখে আবার অবাক হই। নতুন করে দেখি সেই প্রাণচাঞ্চল্যে অফুরন্ত জীবন রসে ভরপুর সদাব্যস্ত এক সজীব মহিলাকে। বয়স যাকে পরাজিত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন আমাদের আইকন।
লায়লা সামাদের জন্ম ১৯২৮ সালের  ৩ এপ্রিল। তিনি জন্মগ্রহণ করেন কোলকাতায়। যদিও তার পৈতৃক নিবাস ছিল দিনাজপুরের মির্জাপুর গ্রামে। তার পিতার নাম খান বাহাদুর আমিনুল হক। তিনি ছিলেন জেলার বিখ্যাত মির্জাপরিবারের সন্তান। আমিনুল হক ছিলেন সংস্কৃতিমনা যুক্তিবাদী প্রগতিশীল ভাবধারায় প্রভাবিত এবং সাহিত্যনুরাগী। 
তিনি ‘তারা যা ভাবে’ ও ‘টাইগার হিল’ নামে দুটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তার মায়ের নাম তাহমিনা হক। তিনি শের শাহের প্রধান সেনাপাতি দানিয়েল খানের বংশধর। তিনি সেই সময় রক্ষণশীল মহিলাদের তুলনায় অনেকটা এগিয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন, এস্রাজ বাজাতেন এবং সমাজ কল্যাণমূলক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। এ ধরনের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি লায়লা সামাদের প্রবল অনুরাগ জন্মায়। 
লায়লা সামাদ প্রথমে জলপাইগুড়ি মিশনারি স্কুলে পরে কোলকাতার ডায়মেনসন স্কুল পরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  আশুতোষ ও লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে পড়াশোনা করেন কিছুৃকাল। পরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করেন। 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে লায়লা সামাদের বাবা যুদ্ধে তহবিল গঠনের জন্য ১৯৩৯ সালে সেলস ট্যাক্স এসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে কোলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি বদলি হয়ে যান। সেখানেই লায়লা সামাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরু। 
লায়লা সামাদের বিবাহপূর্ব নাম লায়লা আমিনা হক। ১৯৪৬ সালের ১৯ মে কোলকাতায় তার বিয়ে হয় চাচাত ভাই মির্জা সামাদের সাথে। এরপর থেকেই তিনি লায়লা সামাদ নামে পরিচিত হন। মির্জা সামাদ তখন বামপন্থী রাজনৈতিক ভাবধারায় প্রভাবিত বিখ্যাত ছাত্র নেতা। বিয়ের পর লায়লা সামাদও স্বামীর সঙ্গে এই পার্টিতে একাত্ম হয়ে কাজ করতে থাকেন। সে সময় তিনি নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির জুঁইফুল রায়ের সঙ্গেও কাজ করতেন। 
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ১৪ মার্চ লায়লা ও মির্জা সামাদ ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসেই তিনি সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার কর্মক্ষেত্র বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হতে থাকে। কেবল নারীমুক্তি আন্দোলনই নয়, এ দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রবহমান ধারার সঙ্গে সেই পঞ্চাশ দশক থেকেই নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সংগ্রামী চিন্তা-চেতনা এবং বিপ্লবের আদর্শে উজ্জীবিত এক ব্যক্তিত্ব।
সাংবাদিক শায়লা সামাদ ‘বেগম’ পত্রিকায় কিছুকাল কাজ করার পর তিনি সংবাদ পত্রিকার মহিলা বিভাগে পরিচালিকা হিসেবে যোগদান করেন। পরে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে বার্তা বিভাগে যোগ দেন। তিনি কিছুকাল চিত্রালী পত্রিকার ‘রূপশ্রী’ বিভাগটি সম্পাদনা করেন। কিছুদিন পর তিনি নিজে ‘অনন্যা’ নামে মেয়েদের জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ সময় দেশে ৯২-ক ধারা জারি হওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে লায়লা সামাদ স্বামীসহ কোলকাতা চলে যান।
১৯৬০ সালে লায়লা সামাদ ঢাকায় ফিরে কিছুকাল পারিবারিক ট্রাভেল এজেন্সী ‘ট্রাভেলস এ কাজ করেন। কিছুদিন তিনি পূর্বদেশ পত্রিকার ‘চাঁদের হাট’ বিভাগটিও পরিচালনা করেন। 
কেবল সাংবাদিকতাই নয় তিনি বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। লায়লা সামাদ ঢাকা লেডিস ক্লাবের সাহিত্য সম্পাদিকা, মহিলা পরিষদ ও কর্মজীবী মহিলা ক্লাবের সহসভানেত্রী এবং জোন্টা ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। শেষ জীবনে দারুণ অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। 
নাটকের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি রেডিও, টেলিভিশন ও মঞ্চের জন্য প্রচুর নাটক লিখেছেন। কেবল নাটক লিখেই তৃপ্ত হননি, বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেছেন। সেই পঞ্চাশ দশকে এদেশের গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজের ভ্রƒকুটি অগ্রাহ্য করে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করে তিনি যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা তুলনাহীন। তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেড়া তার’ নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে তুমুল আলোড়ন তোলেন ও পুরস্কৃত হন। সে সময় ঢাকার মঞ্চে কোনো মহিলার অভিনয় ছিল অভাবনীয় ঘটনা। পুরুষরাই সাধারণত মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করতেন। পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে তিনি ও তার সঙ্গীরা শকুন্তলা, মেঘদূত ইত্যাদি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করে যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছেন তেমনি এক বিশেষ শ্রেণির রোষানলেও পড়েছিলেন। নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান বলেনÑ রক্ষণশীল সমাজের ভ্রƒকুটিকে তুচ্ছ করে তিনি এদেশে মেয়েদের নৃত্যচর্চার পথ সুগম করে দিয়ে গেছেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত স্মরণোৎসবে মাইকেল মধূসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসন নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন লায়লা সামাদ। তা ছাড়া চীনা নাটক রেড ল্যান্টার্ন ও হোয়াইট হেয়ার্ড গার্ল’-এর অনুবাদ ও পরিচালনা করেন। নাটক তাকে এতটাই আকর্ষণ করত যে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নিজ উদ্যোগে এবং অর্থ ব্যয়ে প্রযোজনা করেছেন। লায়লা সামাদ নিজস্ব নাট্যগোষ্ঠীও গড়ে তুলেছিলেনÑ নাম ‘চারণিক’।
সাহিত্য অঙ্গনে লায়লা সামাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা তাঁর সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি নাটক রচনা করেছেন, লিখেছেন শিশুদের জন্য বই, ছোট গল্প লিখেছেন প্রচুর, বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং শেষে ভ্রমণকাহিনী রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তার প্রকাশিত নাটকের নাম বিচিত্রা (১৯৬০), প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম ‘আপনার শিশুকে জানুন (১৯৬২), তার রচিত ছোট গল্পগ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে দুঃস্বপ্নের অন্ধকারে (শ্রাবণ ১৩৭৩), কুয়াশার নদী (আশ্বিন ১৩৭৬), কড়চা (১৯৭৫), অরণ্যে নক্ষত্রের আলো (১৯৭৫), অমূর্ত আকাক্সক্ষা (১৯৭৮) বেগম সাহেবা (১৯৭৮)। তার শিশুতোষ গ্রন্থের সংখ্যাÑ২। তিনি একটি মাত্র ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেছিলেনÑ যুক্তরাষ্ট্রের দিন (১৯৮৫)। এই ভ্রমণ কাহিনী তার প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ।
লায়লা সামাদের সৃজনশীল রচনায় তার জীবনদৃষ্টির পরিচয় মেলে। তিনি মানুষের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, হতাশা ও ব্যর্থতার খ-চিত্র এঁকেছেন তার গল্পগ্রন্থে।
অপরিসীম মনোবল ও নিরলস কর্মী লায়লা সামাদ জীবনের মাঝপথেই থেমে গেলেন। ১৯৮০ সালের ১০ আগস্ট এদেশে সংস্কৃতি-সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ভুবনে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো। রেখে গেলেন স্বামী মির্জা সামাদ ও একমাত্র কন্যা লিটাকে। 
লায়লা সামাদ প্রথা শাসিত সমাজের নিষেধের উত্তোলিত অঙ্গুলি অগ্রাহ্য করে এদেশের অন্ধ নারী সমাজের জন্য যিনি অকুতোভয়ে তৈরি করেছিলেন আলোকিত নতুন পথ, মেয়েদের জন্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আধুনিক জীবনের ধারণা। তার সেই আদর্শিক চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে আমরা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। বস্মৃতপ্রায় লায়লা সামাদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য।

×