ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মঙ্গল শোভাযাত্রা

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ০১:২৮, ১৪ এপ্রিল ২০২৩

মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে আয়োজিত একটি নতুন ধরনের বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে আয়োজিত একটি নতুন ধরনের বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের আয়োজনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সহোযোগিতায় প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।] এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়।

এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে প্রায় প্রতি জেলাসদরে এবং বেশ কিছু উপজেলা সদরে পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আয়োজিত হওয়ায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বাংলাদেশের নবতর সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউটের বর্তমানে চারুকলা অনুষদের ১৯৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষের কতিপয় শিক্ষার্থী ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা করে। অবশ্য তখন সেটির নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রার একটা পটভূমি আছে।

১৯৮৮ সালে সারাদেশের ভয়াবহ বন্যা হয়। চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নিসার হোসেন এবং আজিজ শরাফীর নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ১৯৮৬-৮৭ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা ত্রাণ তৎপরতা চালায়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা থেকে কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা, খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে বন্যা দুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করে। তাদের সঙ্গে ৮৫-৮৬ ব্যাচ এবং ৮৭-৮৮ ব্যাচের কিছু ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে। সে সময় ভিন্ন মতাবলম্বী কিছু সিনিয়র ছাত্র নিসার স্যারের বিরোধিতা করে এবং লাঞ্ছিত করে।

এতে ক্ষুব্ধ ৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজন নিসার স্যারের বাসায় দেখা করে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু নিসার স্যার ভালো কিছু করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করার পরামর্শ দেন। তখন নিসার স্যারের বাবা ভাষাসৈনিক এমদাদ হোসেন যশোরের পৌষ মেলার প্রসঙ্গে কথা বলেন।
১৯৮৮ সালে চারুকলার ৮৬-৮৭ ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী নিজেদের সামর্থ্যে এবং আয়োজনে বাঁশের চটা, পুরাতন খবরের কাগজ এবং গমের আঠা দিয়ে চারটি ঘোড়া অনেক মুখোশ এবং মুকুট, অনেক বিশাল আকারের পেনসিল, দুটি বড় তুলি ও প্যালেট বানায়। ২৯ ডিসেম্বর তারিখ সকাল ৮টায় একটি ঢাকের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বকুলতলার পেছনের থিওরিরুম থেকে মাথায় গলায় ফেস্টুন ঝুলিয়ে হৈ হৈ করে একটি দল চারুকলা থেকে বের হয়ে টিএসসি এবং অপরাজেয় বাংলা ঘুরে চারুকলায় ফিরে আসে। যার বিরোধিতা করেছিল তারাও এই র‌্যালিতে অংশ নেয়।

শোভাযাত্রা ব্যানারে নাম ছিল জয়নুল জন্মোৎসব ৮৮। এই উৎসবে যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তারা হলোÑ মাহাবুব রহমান, সাখাওয়াৎ হোসেন, ফরিদুল কাদের, কামরুল আহসান খান, শহীদ আহাম্মেদ মিঠু, এসএম ফারুকুজ্জান হেলাল, হানিফ তালুকদার কালাম, মনিরুজ্জামান শিপু, আহসান হাবীব, লিপু, আলপ্তগীন তুষার প্রমুখ। পরে ৮৭-৮৮ ব্যাচের কয়েকজন মাহাবুব জামাল শামীম, শিল্পী তরুণ ঘোষ, কাঞ্চন প্রমুখ শিল্পীগণ ৮৯ এর পহেলা বৈশাখের উদযাপন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

প্রথম সেই র‌্যালির নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। তখন প্রচারের জন্য এর পোস্টার ডিজাইন করেছিল তরুণ ঘোষ। ৫০টিরও বেশি মুখোশ অসংখ্য মুকুট বানানো হয়েছিল। শিল্পী তরুণ ঘোষ এবং শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের সঙ্গে মুখোশ ডেকোরেশন অংশ নিয়েছিল ৮৬-৮৭ ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরাও। সকাল ৮টায় ঢাকের তালে র‌্যালির উদ্বোধন করেন সাংবাদিক ফয়েজ আহম্মেদ।

স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পর ’৯০ ও ৯১ সালেও মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা। ৯১ সালে দুটি মুভিং ডেকোরেটিভ কচ্ছপ বানিয়েছিল। আলপ্তগীন তুষার এবং মোহাম্মদ আলী পাপ্পু মিলে। প্রথম পহেলা বৈশাখ যারা প্রত্যেকে কাজ করেছিল তারা হলো ’৮৬-৮৭ (এরপর ১৮ পৃষ্ঠায়)
ব্যাচের মাহাবুর রহমান, সাখাওয়াৎ হোসেন, কামরুল হাসান খান, ফরিদুল কাদের, হানিফ তালুকদার, আহসান হাবীব লিপু, মনিরুজ্জামান শিপু, সালেহ মাহমুদ, হালিমুল ইসলাম খোকন, আলপ্তগীন তুষার, অনিতা ইসলাম, তৈয়বা বেগম লিপি, মিলি। নতুন ১ম বর্ষের শোভা, লাভলী চাকমা, আমিনুল ইসলাম লিটু, আদিব সাঈদ শিপু। সিনিয়রদের মধ্যে ছিলেন মাহাবুব জামাল শামীম ফজলুর রহমান কাঞ্চন, সাইদুল হক জুইস শিল্পী তরুণ ঘোষ প্রমুখ।
 ১৯৯৩ সালে বাংলা ১৪০০ সালে ব্যাপক আকারে বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে শোভাযাত্রা করা হয়। আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে সঙ্গীতশিল্পী ওয়াহিদুল হক এবং ভাষাসৈনিক এমদাদ হোসেনের প্রস্তাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম রাখা হয়। আগের শোভাযাত্রাগুলো শুধু ছাত্রছাত্রী এবং জুনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

সে বছর সকল শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় যারা সহযোগিতা করেন তারা হলেন- ভাষাসৈনিক এমদাদ হোসেন, কামাল লোহানী মহিউদ্দিন আলমগীর, কেরামত মাওলা, মামুনুর রশীদ, আসাদুজ্জামান নূর, সানজিদা খাতুন, আক্কু চৌধুরী প্রমুখ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে উপাচার্য অধ্যাপক আবু ইউসুফ স্যারের নেতৃত্বে। ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের নেতৃত্বে।
পরবর্তী প্রজন্মের মাধ্যমে এভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা সারাদেশে জেলা ও উপজেলা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে। বর্ষবরণ বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এক সার্বজনীন প্রাণের উৎসব। বাঙালির কণ্ঠে এভাবেই ধ্বনিত হয় তার চেতনা, চরিত্র এবং আকাক্সক্ষার বিষয়সমূহ সাবলীলভাবে। অসংখ্য ঝড়-ঝাপটা আর বাধাবিপত্তির পরেও বাঙালির মৌল প্রেরণা থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছেদ ঘটেনি।

বাংলার কৃষক জনতা শ্রমিক বুদ্ধিজীবীসহ সকল ধরনের পেশা-ধর্ম-বর্ণের মানুষ একাত্ম হওয়ার এই উৎসবে কালে কালে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা, নতুন নতুন অনুষঙ্গ। বর্ষবরণ উপলক্ষে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা এই নতুন মাত্রার এক উজ্জ্বল সংযোজন। এ ধারা অব্যাহত থাকুক যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কারান্তরে।

×