
ছবি: সংগৃহীত
১৯৫৪ সালের হজ মৌসুম। জেদ্দা বন্দরে অপেক্ষমাণ একদল ক্লান্ত, রোদে পোড়া, দুর্বল মানুষ—তাঁরা সবাই হজ পালন শেষে ফিরে যাচ্ছেন বাংলায়। সেই ইতিহাসের জীবন্ত দলিল হয়ে আছে আইরিশ নাবিক নরম্যান ফ্রিম্যানের লেখা প্রবন্ধ ‘অ্যান আইরিশম্যানস ডায়েরি অন আ পিলগ্রিম শিপ টু জেদ্দা’, যা প্রকাশিত হয় আইরিশ টাইমস পত্রিকায়।
প্রবন্ধে উঠে এসেছে তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ সারধানা-তে ফ্রিম্যানের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তিনি ১,৫০০ জন হজযাত্রীকে জেদ্দা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় বিমান পরিবহনের প্রচলন বাড়লেও, কিছু হজযাত্রা এখনো সমুদ্রপথেই সম্পন্ন হতো।
রোদে পোড়া, কঙ্কালসার মানুষগুলো
জেদ্দা বন্দরে পৌঁছে ফ্রিম্যান ও তাঁর ক্রুরা দেখতে পান, খোলা আকাশের নিচে ইহরামের কাপড়ে গাদাগাদি করে বসে আছেন হজযাত্রীরা। সৌদি পুলিশের কড়া তত্ত্বাবধানে এ মানবেতর অবস্থায় অনেকে প্রায় কঙ্কালসার। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য তরুণ নাবিক ফ্রিম্যান ও তাঁর সহকর্মীদের গভীরভাবে নাড়া দেয়।
জাহাজে উঠতে শুরু করেন দুর্বল ও অসুস্থ হজযাত্রীরা। অনেককে সহায়তা করে তোলা হয়। ধীরে ধীরে পূর্ণ হয় সারধানার নিচের ডেক—দড়ির বিছানা, কাঠের মেঝে ও ম্যাটে গাদাগাদি করে বসানো হয় যাত্রীদের।
জাহাজে ইমাম, আজান আর নামাজের দৃশ্য
এই যাত্রায় ছিলেন এক প্রজ্ঞাবান ইমাম, যিনি প্রতিদিন জাহাজের মাইকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আজান দিতেন। হজযাত্রীরা জাহাজের সামনের ডেকে নামাজ আদায় করতেন। কাঠের মেঝেতে সারি সারি জায়নামাজে তখন ছড়িয়ে থাকত ধর্মীয় এক অনন্য আবহ।
অপুষ্টি, ক্লান্তি ও অসুস্থতায় চারজন হজযাত্রী জাহাজেই মারা যান। যদিও ফ্রিম্যানের মতে, এটি অন্যান্য সমুদ্রযাত্রার তুলনায় অনেক কম। ইমামের নেতৃত্বে জানাজা পড়ে মৃতদের ইহরামের কাপড়েই কাফন দিয়ে সমুদ্রেই দাফন করা হয়। ক্যানভাসে মুড়িয়ে, ভারী সিসা বেঁধে মৃতদেহ সাগরের ঢেউয়ে সমর্পণ করা হয়।
ফিরে আসা বাংলায়—মর্যাদার আসনে হজযাত্রীরা
দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর সারধানা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত যাত্রীরা ধীরে ধীরে নেমে যান। তাঁদের চোখেমুখে হজ পালন শেষে ফেরা এক গর্বময় অভিজ্ঞতার ছাপ। নাবিক ফ্রিম্যান নিজেই লেখেন, এই যাত্রা তাঁর জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে—একটি জাহাজ, কিছু প্রার্থনামুখর মানুষ, আর বিস্তৃত সাগরের বুক চিরে ফেরা ঘরে।
এত বছর পরেও ইতিহাসের এই অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলার মানুষের ধর্মীয় নিষ্ঠা, কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা এবং বিশ্বাসের দৃঢ়তা—যা এক যুগান্তকারী ঐতিহ্যের ধারক।
সুত্র: প্রথম আলো।
রাকিব