.
কালিদহ সাগরের বুকে জেগে ওঠা সমগ্র সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য ও পর্যটন সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জে পাঁচটি সংসদীয় আসন। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর প্রার্থীদের পদচারণায় পাঁচটি আসনেই নির্বাচনী উৎসবে মেতে উঠেছেন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও সাধারণ ভোটাররা।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলই তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। দল সমর্থিত প্রার্থীরা ইতোমধ্যে তাদের মনোনয়নপত্রও জমা দিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় এবার চমক এসেছে। পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই নতুন প্রার্থী দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। সুনামগঞ্জ-৪ আসনে বিগত দুই নির্বাচনে মহাজোটের সমঝোতায় জাপাকে ছাড় দেওয়া হলেও এবার এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিককে। সব আসনে নৌকার মাঝি ঠিক করে দিলেও নির্বাচনী মাঠে তারা খুব একটা স্বস্তিতে নেই। কেননা বাকি দুটি আসনে নৌকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান সংসদ সদস্যরা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। নতুন প্রার্থীর পাশাপাশি দলের মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান এমপির প্রতিযোগিতায় ইতোমধ্যে জমে উঠেছে নির্বাচনী উৎসব।
সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারা) আসনেও আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সুনামগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবং সুনামগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা।
সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৪১ জন প্রার্থী। এর আগে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন ৪৬ জন। জমা দেওয়ার শেষ দিন দাখিল করেছেন ৪১ জন। এতে দেখা গেছে, পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটি আসনেই ভোটের মাঠে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই।
এদিকে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ছিলেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। এবার এই আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। গেল দুই নির্বাচনের মতো এবারও শরিকদের ছাড়লে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন।
এদিকে সুনামগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাঁচবারের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শামীম চৌধুরী। তবে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নানের আসনে দলের অন্য কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেননি।
জেলা নির্বাচন কমিশন থেকে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন ১০ জন, দাখিল করেছেন নয়জন। সুনামগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহকারী ছয়জনই মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। সুনামগঞ্জ-৩ আসনেও মনোনয়নপত্র সংগ্রহকারী ছয়জনই মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। সুনামগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন নয়জন, দাখিল করেছেন আটজন। সুনামগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন ১৫ জন, দাখিল করেছেন ১২ জন।
সুনামগঞ্জ-১ ॥ এই আসনে নতুন প্রার্থী দিয়ে চমক এনেছে আওয়ামী লীগ। এবার নৌকার নতুন মাঝি হয়েছেন রনজিত সরকার। মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। ফলে এই আসনে এবার আওয়ামী লীগের মুখোমুখি আওয়ামী লীগই। তারা দুজন ছাড়াও মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য, সুনামগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি সেলিম আহমদ, জাপার আব্দুল মান্নান, বিকল্পধারার মো. রফিকুল ইসলাম, গণফ্রন্টের জাহানুর রশীদ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের সালেহ আহমদ, তৃণমূল বিএনপির মো. আশরাফ আলী, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির হারিছ মিয়া। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেননি আরেক মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নতুন মুখ আনলেও বর্তমান এমপিও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। নৌকা প্রতীক পেয়ে মনোনয়ন দাখিল করা রনজিত সরকারের পক্ষে আওয়ামী লীগের বিরাট একটি অংশ থাকলেও বর্তমান এমপিরও রয়েছে বিশাল ভোট ব্যাংক। তাই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান এমপির জমজমাট লড়াই হতে পারে।
সুনামগঞ্জ-২ ॥ এই আসন থেকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ও রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তার মৃত্যুর পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্তা। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বর্তমান এমপি এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ এই আসনে প্রার্থী করেছে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে। মনোনয়নবঞ্চিত হলেও নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন ড. জয়া সেনগুপ্তা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনিও এই আসন থেকে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এই দুজন ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ড. মো. সামসুল হক চৌধুরী, ঋতেশ রঞ্জন দেব, মো. মিজানুর রহমান ও গণতন্ত্রী পার্টির মিহির রঞ্জন দাস। ফলে আগামী নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তার সঙ্গেই নৌকার নতুন প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মাহমুদের মূল ভোটের লড়াই হবে।
সুনামগঞ্জ-৩ ॥ পাঁচটি আসনের মধ্যে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগ অনেকটাই চিন্তামুক্ত। এই আসনে আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতা এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ছাড়াও মনোয়নপত্র দাখিল করেছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী, জাপার তৌফিক আলী মিনার, জাতীয় গণফ্রন্টের তালুকদার মকবুল হোসেন, জাকের পার্টির মো. নজরুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মাহফুজুর রহমান খালেদ। ফলে আগামী নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপির সঙ্গেই আওয়ামী লীগের ভোটের লড়াই হবে।
সুনামগঞ্জ-৪ ॥ গত দুটি নির্বাচনে মহাজোটের সমঝোতায় এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন পীর ফজলুর রহমান। কিন্তু এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই আসন থেকে দলের মনোনয়ন দিয়েছেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিককে। তিনি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তার মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
অন্যদিকে, এই আসনে তৃতীয়বারের মতো বর্তমান সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছে জাপা। ইতোমধ্যে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে লড়তে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই আসনে অন্য প্রার্থীরা হলেন মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্য ব্যারিস্টার এম. এনামুল কবীর ইমন, স্বতন্ত্র প্রার্থী মোবারক হোসেন, জাসদের আবু তাহের মো. রুহুল তুহিন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মোহাম্মদ দিলোয়ার, বিএনএমের দেওয়ান শামসুল আবেদীন ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির আবুল ফজল মো. মাসউদ। তবে জমা দেননি মনোনয়ন বঞ্চিত জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. মতিউর রহমান।
সুনামগঞ্জ-৫ ॥ আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি সুনামগঞ্জ-৫ আসনে ষষ্ঠবারের মতো নৌকার মাঝি হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক। এর আগে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তবে ভোটের মাঠে এবার তাকে ছাড় দেননি মনোনয়নবঞ্চিত জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য শামীম আহমেদ চৌধুরী।
নির্বাচনে লড়তে আরও মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন গণফোরামের আইয়ুব করম আলী, জাপার মো. নাজমুল হুদা হিমেল, সুপ্রিম পার্টির আবু সালেহ, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সাচ্চু বিশ্বাস, ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের মো. আশরাফ হোসেন, জাকের পার্টির শেখ ইয়াকুব আলী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আজিজুল হক, মনির উদ্দিন ও কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের হাজী আব্দুল জলিল। তবে মনোনয়নপত্র নিলেও জমা দেননি জাপার আবু লেইস, রুহুল আমিন, ইউনাইটেড ইসলামী পার্টির বদরুল আলম।
ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুহিবুর রহমান মানিকের রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও ভোটব্যাংক। প্রতিবারই তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাই আগামী নির্বাচনে মানিকের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা অন্য প্রার্থীদের পক্ষে কঠিন হবে।
