ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট টানার প্রত্যাশা দলটির

আগামী দিনের শক্তিশালী বিরোধী দল হতে পারবে জাতীয় পার্টি!

বিকাশ দত্ত

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ২৮ নভেম্বর ২০২৩

আগামী দিনের শক্তিশালী বিরোধী দল হতে পারবে জাতীয় পার্টি!

জাতীয় পার্টিই হতে পারে আগামী দিনের শক্তিশালী বিরোধী দল

জাতীয় পার্টিই হতে পারে আগামী দিনের শক্তিশালী বিরোধী দল। অন্তত দলের নেতা-কর্মীদের আশা তেমনই। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপার পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর দলের ঐক্যের বিষয়টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। তালিকায় রওশন এরশাদ-শাদ এরশাদসহ অনেকের নাম স্থান পায়নি। 
জনবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক কর্মসূচির কারণে ক্রমে বিএনপি তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এক কথায় তারা অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। এক সময় বিএনপিকে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মতো ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে চলছে নানামুখী খেলা। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় পার্টিতে দেবর- ভাবির দ্বন্দ্ব মিটিয়ে এক ছাতার তলে আসলে একটি শক্তিশালী দল হতে পারত। সঠিক নেতৃত্ব দিলে, বিশেষ করে জনমুখী রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারলে, পরবর্তী ২০২৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলটি ক্ষমতার শিখরে আসলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু হতো না। জাতীয় পার্টি এখনো দেশের রাজনৈতিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দল। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় আসীন। 
জাতীয় পার্টিতে একটি অংশ ঐক্য চাইলেও অপর অংশ ঐক্যের পক্ষে নয়। দুই গ্রুপ এখন অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে। এদিকে জাতীয় পার্টির রাজনীতির খেলায় শেষ পর্যন্ত কি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে হেরে গেলেন পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ? রাজনৈতিক অঙ্গনে এমনটিই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী তালিকায় নাম নেই বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, তার ছেলে রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, বিরোধী দলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব ও সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ, দলের সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন রাজুসহ পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার। এর পরেও কি জাপা ঐক্যবদ্ধভাবে চলবে। 
জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রধানপৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বৈঠকে অনেকেই ্ইতিবাচক দেখছেন। যখন দেবর-ভাবির মধ্যে টানপোড়েন চলছে, ঠিক সেই সময় হলো এই বৈঠক। গত শনিবার রাতে জি এম কাদের প্রধানপৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। জাপা চেয়ারম্যান শনিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষকের গুলশানের বাসায় যান। তারা দুজন পারিবারিকভাবে বৈঠক করেন। সেখানে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়।

এতে জানানো হয়, দুই নেতার মধ্যে এক ঘণ্টারও বেশি সময় বৈঠক চলে। জিএম কাদের একাই কথা বলেন রওশন এরশাদের সঙ্গে। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, দুই শীর্ষ নেতা এক সঙ্গে নির্বাচন করতে রাজি হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত জিএম কাদের তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। রওশন এরশাদকে নিয়ে এক সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনায় সম্মত হয়েছেন। জাতীয় পার্টি কিভাবে নির্বাচন করবে, জোটে নাকি আলাদা, কত আসনে মনোনয়ন দেবেন, কোন কোন আসনে সরকারি দলকে ছাড় দেওয়া হবে এ বিষয়ে দুই নেতার কথা হয়েছে। সোমবার যখন জাপার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয় তখন রওশন এরশাদসহ শাদ এরশাদ পন্থিদের নাম না থাকায় দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। 
ওই দিনই রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ সাংবাদিকদের বলেন, আবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে জাতীয় পার্টি। দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদকে ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে দলটি। এই পরিস্থিতিতে রওশন এরশাদ নির্বাচনে যাবেন না। মসীহ বলেন, আজ আমাদের জন্য খুবই দুঃখের দিন। এটা আমরা আশা করিনি। জাতীয় পার্টি এর আগেও চারবার ভেঙেছে। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই জাতীয় পার্টিতে ভাঙন দেখা দেয়। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রওশন এরশাদ আমাকে বিকেলে জানিয়েছেন, তোমরা চিন্তা করো না, যা করি না কেন একসঙ্গেই থাকব।

বিকেলে জিএম কাদের একতরফাভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করলেন, এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। পার্টি পঞ্চমবারের মতো ভেঙেছে বলতে পারেন। গোলাম মসীহ বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেছেন। এক কথায় নির্বাচন থেকে তাকে মাইনাস করা হয়েছে। সাদ এরশাদের আসনে জি এম কাদের নিজেই মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তিনি ওখান থেকে নির্বাচন করবেন।’ রওশন এরশাদ দলটিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। এবার জি এম কাদের নিজেই দলটি ভাঙনের সৃষ্টির পথ করে দিলেন।’
সোমবার জাতীয় পার্টি ২৮৯টি তালিকা প্রকাশ করলেও এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। ঘোষিত তালিকায় দেখা গেছে, দলটির পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। এছাড়া তালিকায় জায়গা পাননি বর্তমান তিন এমপি। তারা হলেন- রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা, পিরোজপুর-৩ আসনের রুস্তম আলী ফরাজী ও রংপুর-৩ আসনের সাদ এরশাদ। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রওশনপন্থি এক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, রওশন এরশাদ কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। উনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়েছেন। সময় এখনো পাননি। রওশন ও সাদ এরশাদকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তারা আমাদের বাদ দিয়ে ভোট করবেন না। করলে তো আরও আগেই মনোনয়ন নিতেন। আমাদের দিক থেকে ম্যাডাম, সাদ এরশাদ ও রাঙ্গাসহ ২০-২২ জন আছে।
দেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী অনেক ভোট রয়েছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর কথায় তা স্পষ্ট হয়েছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে এখন আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের সংখ্যা বেশি। এই ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারলে জাতীয় পার্টি আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যা ভোট আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি এন্টি আওয়ামী লীগ ভোট। কেন্দ্রে যদি ভোটার আসতে পারে।

তাহলে আমার মনে হয় ৩০০ আসনে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেও পারি। আর যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাই, সরকার গঠন করতে পারি-তাহলে আমাদের দেশ চালানোর যোগ্যতা আছে। আমাদের অনেকে মন্ত্রী ছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতা আছে। আমরা দেশে সুশাসন দিতে পারব। তার ওই বক্তব্যে এখন স্পষ্ট বোঝা যায় জাপা এখন তার শক্ত অবস্থানে আছে। 
সোমবার জাতীয় পার্টি ২৮৯ আসনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। জাতীয় পার্টি ছাড়াও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৬টিই। আওয়ামী লীগও নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে। আর বিএনপি একদফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে আছে। বিএনপিসহ ৯টি নিবন্ধিত দল এখনো ভোট বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড়। বাকি ৯টি দল এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। তবে এদের বেশিরভাগই শর্তসাপেক্ষে ভোটে আসার পক্ষে। সে হিসাবে নিবন্ধিত দলের প্রায় ৮০ শতাংশই অংশ নিচ্ছে ভোটে। তবু কারও কারও প্রশ্ন, বিএনপি ছাড়া এ ভোট কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে!
আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোনো রাজনৈতিক দলের মুখ্য বিষয় হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বর্তমানে জাতীয় পার্টি তিনশত আসনে প্রার্থী দিয়েছে। আমি মনে করি, আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি না আসে তা হলে জাতীয় পার্টিই হবে একমাত্র বিরোধী দল। বিএনপি জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করতে পারছে না। তারা একসময় অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। আর বিএনপির জায়গাটা পূরন করবে জাতীয় পার্টি। 
তরিকত ফেডারেশেনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী জনকণ্ঠকে বলেন , বিএনপির যে অবস্থা তাতে আগামী কয়েক বছর পর তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। উপরন্তু হরতাল অবরোধ দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত নির্বাচনে না এসে আরেকটা ভুল করেছে। আমি মনে করি, জাতীয় পার্টি হবে আগামী দিনের প্রধান বিরোধী দল। 
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল। কিন্ত আগামী দিনে কি অবস্থা হয় তা বলা মুশকিল। তবে বিএনপির নির্বাচন বর্জনটা সুখকর নয়। জাপা সব সমস্যা দূর করে সারাদেশে তিনশ’ আসনে সঠিক মনোনয়ন দিতে পারলে জাতীয় সংসদে ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারবে। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক কো-চেয়ারম্যান জনকণ্ঠকে বলেন , সারাদেশে জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। কিন্ত জাপার মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে তা হয়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপা এখন আর নেই। এখনো জাপা যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তা হলে আগামীতে সরকার গঠন করারও ক্ষমতা রাখে। 
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ইতোমধ্যে তিনশত আসনে প্রার্থী দিয়েছেন। সোমবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন। তবে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ তার পন্থিরা এখনো মনোনয়ন নেন নি।

×