ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

বিদেশের মাটি, বিষণ্ণতার ছায়া: প্রবাসে আত্মহত্যার উদ্বেগজনক বাস্তবতা

শরিফুল খান প্লাবন

প্রকাশিত: ২০:১৩, ২৯ জুলাই ২০২৫

বিদেশের মাটি, বিষণ্ণতার ছায়া: প্রবাসে আত্মহত্যার উদ্বেগজনক বাস্তবতা

ছবি: সংগৃহীত

প্রবাস—একটি শব্দ, যার সঙ্গে স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ত্যাগের এক গভীর মেলবন্ধন রয়েছে। দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা বলা হয় প্রবাসীদের। তারা ঘাম ঝরিয়ে রেমিট্যান্স পাঠায়, দেশে চালিত হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। অথচ সেই প্রবাসেই দিন দিন বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা—যা একটি গভীর সংকেত বহন করে।

সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান কিংবা কাতার—প্রায় প্রতিটি গালফ দেশেই এখন নিয়মিত শোনা যায় আত্মহত্যার সংবাদ। ফেসবুক বা ইউটিউবে ভাইরাল হয় কোনো বাংলাদেশির ঝুলন্ত দেহ, কখনো বিষ পান করে আত্মহত্যা, কখনো আত্মহননের পূর্ব মুহূর্তের ভিডিও। প্রশ্ন জাগে—এই মৃত্যুদের পেছনে কী লুকিয়ে থাকে?

প্রবাসে চাপ আর নিঃসঙ্গতার বাস্তবতা
একজন প্রবাসীর জীবন বাইরে থেকে যতটা চকচকে মনে হয়, বাস্তবে তা ততটাই রুক্ষ। কর্মস্থলে দীর্ঘ সময় কাজ, মালিকের খামখেয়ালি মনোভাব, ওভারটাইমের নাম করে শোষণ, বেতন আটকে রাখা কিংবা নিয়মিত ছুটি না পাওয়া—সব মিলিয়ে মানসিক চাপ ভয়াবহ রূপ নেয়।

পরিবারের থেকে দূরে থাকা, ভাষাগত বাধা, একাকীত্ব এবং দেশীয় বন্ধু বা আত্মীয়দের অভাব থেকে তৈরি হয় নির্জনতা ও বিষণ্নতা, যা ধীরে ধীরে একজন মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও প্রতারণা
অনেকেই প্রতারিত হয়ে প্রবাসে যান। ভিসা দেওয়ার সময় এক ধরনের কাজের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন কাজ, স্বল্প বেতন কিংবা কাজই নেই। হাজার হাজার টাকা ঋণ করে বিদেশে পাড়ি জমানো প্রবাসী হঠাৎ কাজহীন হয়ে পড়লে নিজেকে অক্ষম মনে করেন। লজ্জা, অপমান আর পরিবারকে মুখ দেখানোর ভয় তাকে ঠেলে দেয় চরম সিদ্ধান্তে।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেই বললেই চলে
প্রবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কেউ ভাবে না। মালিকরা শুধু কাজ চায়, রাষ্ট্র শুধু রেমিট্যান্স চায়। কিন্তু একজন মানুষ যখন দিনের পর দিন অবজ্ঞা, অসম্মান আর অবসাদে ডুবে থাকেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন বিষণ্নতার শিকার। উন্নত দেশগুলোতে কর্মীদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে এমন কোনো সেবার সুযোগ নেই।

পারিবারিক টানাপোড়েন
বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকে বছরের পর বছর দেশে ফিরতে পারেন না। এই ব্যবধানে স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, সন্তান বাবাকে ভুলে যায়, বাবা-মা মৃত্যুবরণ করেন—সবকিছু মিলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন অনেকেই। আবার কেউ কেউ শুনতে পান স্ত্রী তাকে ফেলে দিয়েছে, সন্তান তাকে মেনে নিচ্ছে না, অথবা দেশে তার জায়গায় কেউ অন্য কিছু করছে—এই খবরগুলো অনেক সময় দুঃখের বদলে জন্ম দেয় ভয়ানক হতাশা।

কাজের অনিশ্চয়তা ও আইনগত জটিলতা
বহু প্রবাসী অবৈধ হয়ে পড়েন ভিসা নবায়ন না করতে পারায় বা কোম্পানির রিলিজ না পেয়ে। তারা হয়ে ওঠেন ‘মুকিম’ বা ‘হারাম শ্রমিক’। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকা, নিয়মিত হয়রানির শিকার হওয়া এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু সহজ মনে হয় অনেকের কাছে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?
এই আত্মহত্যাগুলো নিছক “ব্যক্তিগত দুর্বলতা” হিসেবে দেখলে হবে না। এটি একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। প্রবাসীদের জন্য নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা জরুরি। দূতাবাসগুলোতে হটলাইন, প্রবাসী কাউন্সেলিং সেল, এবং আইনি পরামর্শ কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত।

বাংলাদেশ সরকারকে প্রবাসীদের সুরক্ষা ও মর্যাদার বিষয়ে আরও জোর দিতে হবে। শুধু রেমিট্যান্স নয়, মানুষটা মূল্যবান—এই দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

সবশেষে বলতে হয়—প্রবাসে একজন মানুষ যখন আত্মহত্যা করেন, তখন শুধু একজন নয়, মারা যায় একটা স্বপ্ন, একটা পরিবারের ভরসা, একটা দেশের প্রত্যাশা। তাই এই সংকটকে অবহেলা নয়, গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। প্রবাসীদের ভালো রাখা মানেই দেশের ভবিষ্যৎ ভালো রাখা।

 

লেখক:

শরিফুল খান প্লাবন

সাংবাদিক ও কলাম লেখক

আবির

×