ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন

জান্নাতুন নূর সারা

প্রকাশিত: ১৮:১০, ২৯ জুলাই ২০২৫

পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। যদিও এর প্রধান কারণ হিসেবে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবিবেচিত ব্যবহারকে দায়ী করা হয়, এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার হচ্ছে মূলত বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো- যেগুলো অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছু উন্নত দেশ সাময়িকভাবে কিছু সুবিধা পেতে পারে। যেমন: শীতপ্রধান দেশগুলোতে বরফ গলে যাওয়ায় শস্য ফলন বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বরফাবৃত এলাকাগুলোতে নৌযান চলাচল সহজতর হবে, ফলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বন্যার ঝুঁকিতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলতে থাকায় বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্নভূমিগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। মালদ্বীপ এর প্রতিরোধে পানির নিচে বসবাসের ব্যবস্থা করলেও বাংলাদেশের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। মালদ্বীপের মতো তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, খরা, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। অনেক অঞ্চলে শস্য উৎপাদন হ্রাস পাবে, ফলে দেখা দেবে খাদ্যসংকট। বন্যপ্রাণী হারাবে তাদের আবাসস্থল, অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এবং জনস্বাস্থ্য গুরুতর ঝুঁকিতে পড়বে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করছে। গ্রীষ্মকালে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শীতকাল হ্রাস, মিঠা পানির সংকট, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও আকস্মিক বন্যা কৃষি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে, যা খরার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ খাদ্যসংকটের আশঙ্কা তৈরি করছে। এছাড়া, বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ জনগণের অসচেতনতা ও অবহেলা। আমরা নিজেরাই আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করছি। যেমন, ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা নদী এখন দেশের অন্যতম দূষিত নদী। রাজধানীর প্রায় ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ৪০ লক্ষাধিক মানুষ এই নদীর ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু কেরানীগঞ্জ, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ট্যানারি ও গার্মেন্টস শিল্পের অপরিশোধিত বর্জ্য, গৃহস্থালি আবর্জনা, নৌযানের তেল ও রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি নদীতে পড়ে নদীটিকে মৃতপ্রায় করে তুলেছে। একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা, তুরাগসহ আরও অনেক নদী। নদীগুলোর পানি এতটাই দূষিত যে দুর্গন্ধের কারণে পাশে দাঁড়ানো যায় না, পানির রংও অত্যধিক কালো হয়ে গেছে। এর ফলে দেশের মৎস্য সম্পদও বিপন্ন হচ্ছে।
এই সংকট তাৎক্ষণিকভাবে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও, সচেতন ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব। শিল্প-কারখানায় বাধ্যতামূলকভাবে ইটিপি (Effluent Treatment Plant) চালু করতে হবে, নদীর পাশের অবৈধ সুয়ারেজ লাইন নিষিদ্ধ করতে হবে এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও তরুণদের পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, রাস্তায়-নদীতে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা, এবং পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। আমাদের দেশে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের মতো ঋৎরফধুং ভড়ৎ ঋঁঃঁৎব আন্দোলনের অনুকরণে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ‘বেলা’, ‘বাপা’ ইত্যাদি পরিবেশবাদী সংগঠনের মতো নতুন সংগঠন গড়ে তুলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের সচেতন অংশগ্রহণই পারে পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে বাস্তব পরিবর্তন আনতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল/মো.

×