
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা—নামটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য: কোনো এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ধূলিধূসরিত শহরে তারা দাঁড়িয়ে আছে মানবতার পতাকা হাতে। কাঁধে রিপোর্টের ফাইল, চোখে উদ্বেগের ছাপ, মুখে মানবাধিকারের বুলি।
এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে রক্ষা করা, রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা, বৈষম্যের অবসান ঘটানো। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, তারা যেখানে ‘মানবাধিকার’ নিয়ে উপস্থিত হয়, সেখানেই যেন শুরু হয় এক নতুন দুঃস্বপ্ন। গৃহযুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ, রক্তপাত, উদ্বাস্তু আর অশান্তির গল্প।
নামমাত্র কয়েকটি দেশের কথা তুলে ধরছি—
আফগানিস্তান: তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ২০০১ সালে সেখানে ঢুকল মার্কিন বাহিনী। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা পাশ থেকে বলল, “নারীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে, বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” শুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু দুই দশক পরে দেশটির কী অবস্থা? দুই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু। নারী-শিশুরা আজও অনিরাপদ। তাহলে মানবাধিকার গেল কোথায়?
ইরাক: গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নাম করে একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা তখন বলল, “সাদ্দাম মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।” পরে দেখা গেল, কোনো অস্ত্রই ছিল না। ছিল না কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য। কিন্তু ততদিনে ১০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আবু ঘরাইবের নির্যাতনের দৃশ্যগুলো আজও ইতিহাসের কুৎসিত চিত্র হয়ে চোখের সামনে ভাসছে।
লিবিয়া: গাদ্দাফিকে সরানোর জন্য ন্যাটো অভিযান চালাল। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা আগে থেকেই বলেছিল, “গাদ্দাফি মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করছে।” তারপর যা ঘটল তা এক কথায় ভয়াবহ। গাদ্দাফি চলে গেলেন, কিন্তু দেশে ফিরল বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ, দাসবাজার আর চোরাকারবারিদের রমরমা রাজত্ব।
সিরিয়া: আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হতেই মানবাধিকার সংস্থা মুখ খুলল। বলল, “মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে।” এই কথার ফলাফল কী হলো? যুদ্ধ, আগুন, ধ্বংস আর শরণার্থীর স্রোত। পাঁচ লাখেররও বেশি মানুষ নিহত। এক কোটি মানুষ ঘরছাড়া। মানবাধিকারের নামে যেন এক সভ্যতাই মুছে ফেলা হলো।
ফিলিস্তিন: ইসরায়েল যখন শিশু হত্যা করে, বসতবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়, হাসপাতাল উড়িয়ে দেয়—তখন মানবাধিকার সংস্থা কি চুপ করে থাকে না? কখনো একটা বিবৃতি দেয়, কখনো উদ্বেগ জানায়। তারপর? কিছুই না। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। তাহলে এটা কেমন মানবাধিকার?
এই জায়গায় এসে প্রশ্ন তুলতেই হয়―জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা আসলে কার পক্ষে? জালিমদের, না মজলুমদের? এটা কি সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষ, না কি বড় শক্তিগুলোর হাতের ‘সফট পাওয়ার’? মানবাধিকার শব্দটা কি এখন কেবল একটা নরম অস্ত্র, যার মাধ্যমে তৈরি করা হয় জনমত, বৈধতা আর হস্তক্ষেপের পথ?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কি কখনো এ প্রশ্ন তুলেছে? তাদের কি একবারও মনে হয়েছে—যেখানে এই সংস্থা যায়, সেখানে শান্তির বদলে রক্ত ঝরে কেন?
আমরা কি এই প্রশ্ন তুলতে পারি না―ফিলিস্তিনে আপনাদের মানবাধিকার কোথায়? লিবিয়ার বিভীষিকার দায় কে নেবে? সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কে বলবে—“আমরা ভুল করেছিলাম”?
বাংলাদেশে যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাদেরকেও একবার ভাবতে হবে—এই শব্দটা কেবল একটা আন্তর্জাতিক টার্ম না, এর পেছনে রয়েছে এক ভয়ংকর রাজনীতি। এই ‘অধিকার’ যখন শুধু একপক্ষের জন্যে কাজ করে, তখন সেটা আর অধিকার থাকে না—তা হয়ে ওঠে আধিপত্যের ছদ্মবেশ। মানবাধিকার—এটা যদি সত্যিই মানুষের জন্য হতো, তাহলে এত মানুষ মরত না। এত দেশ ধ্বংস হতো না। আমার ফিলিস্তিনি ভাই-বোনদের জীবন এভাবে বোমার আঘাতে উড়ে যেতো না।
লেখক:
মুহাম্মাদ মিযানুর রহমান তালুকদার
শিক্ষক, আশরাফুল উলুম মাদরাসা, মিরপুর ১, ঢাকা
আবির