ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়া চিনি, কিন্তু বয়ামটা ঝাঁকাচ্ছে কে?

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১০:০৫, ২৪ জুলাই ২০২৫

লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়া চিনি, কিন্তু বয়ামটা ঝাঁকাচ্ছে কে?

ছ‌বি: প্রতীকী

আমরা মানুষ। একে অপরের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো থাকুক, শান্তি থাকুক, সেটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা প্রায়ই দেখি, হঠাৎ করে দুই দল, দুই পক্ষ বা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আগে যাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা ছিল না, তারাও আচমকা একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। কে ভালো, কে মন্দ— এসব নিয়ে শুরু হয় তর্ক, সন্দেহ আর রেষারেষি। অথচ, তারা নিজেরাও বুঝে না, হঠাৎ এমন পরিবর্তনের পেছনে কাজ করছে কোন অদৃশ্য হাত। ঠিক যেমনটা ঘটে লাল আর কালো পিঁপড়ার গল্পে।

একটি বয়ামের মধ্যে ১০০টি লাল পিঁপড়া আর ১০০টি কালো পিঁপড়া একসাথে শান্তিতে বসবাস করছিল। কেউ কাউকে কিছু বলছিল না। কিন্তু হঠাৎ যদি কেউ এসে বয়ামটি ঝাঁকিয়ে দেয়, তাহলে সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। একদল আরেক দলকে শত্রু ভেবে আক্রমণ শুরু করে। অথচ, তারা ভুলে যায় যে, সমস্যার মূল কারণ তাদের কেউ না— সমস্যার আসল কারণ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে বয়ামটি ঝাঁকিয়ে দিয়েছে।

আমাদের সমাজেও ঠিক এমনটাই ঘটে। আমরা ভাবি, আমাদের সমস্যার জন্য দোষী পাশের মানুষটি, প্রতিবেশী, সহকর্মী বা অন্য ধর্ম বা জাতির কেউ। কিন্তু আমরা কি একবারও ভাবি না, এই বিভেদ কে তৈরি করছে? কে আমাদের মনকে এমন করে দিচ্ছে যে, আমরা একে অপরকে সন্দেহ করছি? এই প্রশ্নটাই আজ জরুরি হয়ে উঠেছে— বয়ামটা কে ঝাঁকাচ্ছে?

রাজনীতি, মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম— এই তিনটি জায়গা থেকেই অনেক সময় এমন "ঝাঁকুনি" আসে। যখনই কোনো মহল চায়, মানুষ বিভক্ত থাকুক, ঝগড়া করুক, তখনই তারা নানাভাবে উস্কানি দেয়। ফেসবুকে মিথ্যা খবর ছড়ানো হয়, টক শোতে ভুল তথ্য তুলে ধরা হয়, রাজনৈতিক বক্তব্যে সাধারণ মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। এতে করে তারা নিজেরা থাকে নিরাপদে, আর সাধারণ মানুষ নিজেদের শত্রু বানিয়ে ফেলে।

একজন মানুষ যখন বারবার শুনতে পায়, “তোমার সমস্যার জন্য দায়ী অন্য ধর্মের লোকেরা”, তখন সে তা বিশ্বাস করতে শুরু করে। যখন বলা হয়, “তোমার চাকরি পাচ্ছে না কারণ ওরা তোমার জায়গা দখল করেছে”, তখন সেই মানুষ মনে করে, ওরাই আমার শত্রু। অথচ, সত্যি বলতে, চাকরির অভাব, দারিদ্র্য বা নিরাপত্তাহীনতার জন্য দায়ী কেউ অন্য সাধারণ মানুষ না। দায়ী হচ্ছে সেই শক্তি বা গোষ্ঠী, যারা চায় আমরা একে অপরকে দোষ দেই, মারামারি করি, যাতে তারা আড়ালে থেকে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

তৃতীয় পক্ষের এই ‘বয়াম ঝাঁকানোর’ কৌশল খুব পুরনো। ব্রিটিশ শাসনকালেও “Divide and Rule” বা “বিভক্ত করে শাসন করো” নীতি ছিল। তারা হিন্দু-মুসলমানকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে নিজেরা শাসন করেছে। আজও অনেক শাসক বা ক্ষমতাধর ব্যক্তি সেই একই কৌশল ব্যবহার করে। কখনো ধর্মের নামে, কখনো ভাষার নামে, কখনো অঞ্চল বা রাজনৈতিক দলের নামে মানুষকে ভাগ করে ফেলে।

এই বিভক্তির খেলায় আমরা সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমাদের বাড়ি পোড়ে, আমাদের সন্তানরা অনিরাপদ হয়, আমাদের সমাজে আসে অবিশ্বাস আর ভয়ের বাতাস। অথচ যারা বয়াম ঝাঁকিয়ে দেয়, তারা তখন চুপচাপ বসে হেসে নেয় তাদের সুবিধা।

তাই এখনই সময় নিজেদের মধ্যে সন্দেহ না ছড়িয়ে বরং প্রশ্ন তোলা— কে আমাদের মধ্যে বিভেদ ছড়াচ্ছে? কে বয়ামটা ঝাঁকাচ্ছে? আমরা যদি এই প্রশ্ন করতে শিখি, যদি নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনি, তাহলে কেউ আর আমাদের দিয়ে খেলতে পারবে না। আমরা যদি একে অপরের দিকে নয়, বরং সেই তৃতীয় পক্ষের দিকে তাকাই যারা আমাদের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়, তাহলে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে।

লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়া তো আসলে শত্রু নয়, শত্রু হলো সেই হাত, যে বয়ামটা নাড়িয়ে দেয়। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, একে অপরকে দোষ না দিয়ে, সেই হাতটা চেনা আর তাকে থামানো। তাহলেই আমরা সবাই শান্তিতে থাকতে পারবো, যেমনটা ছিলাম বয়ামটা না নড়ানো পর্যন্ত।

লেখক:

সাব-এডিটর, দৈনিক জনকণ্ঠ

এম.কে.

×