ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম!

জান্নাতুল মাওয়া

প্রকাশিত: ১৭:৫৩, ১৭ জুলাই ২০২৫

শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম!

বর্তমান সমাজে প্রবীণ এক অভিশাপেরই নাম। সামাজে যেন তাদের থাকার কোনো স্থায়ী আবাস নেই। এক সময় যেই সন্তানরা বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরে স্বাবলম্বী হয়, বৃদ্ধ বয়সে তারাই তাদের জন্য বোঝা হয়ে রয়। এমন এক সমাজের অধিবাসী এখন আমরা সবাই। প্রতিটি স্বাবলম্বী ছেলেমেয়েরা এখন চায় ছোট পরিবার। ফলে তাদের কাছে বাবা-মা হয়ে উঠে নিছক বাড়তি ঝামেলা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান যুগে বাংলাদেশের রাজধানীর প্রতিটি ঘর তৈরি করা হয় ছোট পরিবারের জন্য। যেখানে সন্তানের তো জায়গা হয়, জায়গা হয় না শুধু পরম স্নেহের বাবা-মায়ের। অথচ বাবা-মায়েদের রক্তকণার শেষ উক্তিতে এটিই পাওয়া যায়- ‘তারা তো আমার গর্ভের, আমি তো তাদের ছাড়তে পারব না। অথচ আধুনিকতার এ যুগে প্রবীণ শব্দটা এক শোকের ছায়া, এক দুঃখের, দুর্বিষহের কথা বর্ণনা করে। জীবনের নিয়ম মেনে শরীর যখন অসাড়তায় আড়ষ্ট হয়, কর্মক্ষমতা লোপ পায়, উপার্জন ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায় তখনই সমাজ দাঁড়ায় তাদের বিপরীতে। আর তারা হয়ে যায় সমাজের বোঝারূপে। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ের প্রবীণ একটা সময় ছিল- শিশু, বালক, কিশোর ও প্রৌঢ়। কিন্তু বর্তমানে তারা জীবন চক্রের শেষ ধাপ-বৃদ্ধে পরিণত হয়েছেন। আজ যার নামকরণ করা হয়েছে প্রবীণ বা বৃদ্ধ। যাকে প্রবীণ বলা হচ্ছে একটা সময় এই প্রবীণই ছিল ছোট্ট সন্তানের একমাত্র অবলম্বন। যার হাত ধরে শিশুটি প্রথম হাঁটতে শেখে, যার মুখের ভাষা শুনে জীবনের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করে, যার কথা শুনে শিশুটি প্রথম বলতে শেখে, ছোট্ট শিশুর সেই অস্পষ্ট ভাষাকে বাবা-মা শ্রুতিমধুর করে তোলে, যাদের কণ্ঠ শুনে শুনে ছোট্ট শিশুটি ‘হাট্টিমাটিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তাদের খাড়া দুটো শিং, তারা হাট্টিমাটিম টিম’ কবিতাটি আবৃতি করতে শিখে। এই ছোট্ট শিশুটিই যখন  বাবা-মায়ের নিরলস পরিশ্রমের ফসলস্বরূপ পূর্ণাঙ্গ স্বাবলম্বী হতে শিখে যায়, ঠিক সে সময়েই বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে বাবা-মা, তারা আর চলতে পারেন না, স্পষ্ট কথা বলতে পারেন না, চোখে দেখতে পায় না, উপার্জন করতে পারেন না। তখনই তারা হয়ে যায় অসহায় বৃদ্ধ, প্রবীণ আর সন্তানের চোখেরবালি। যে হাত ধরে সন্তান হাঁটতে শেখে, সেই পা দিয়ে হেঁটেই সন্তান বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। আর বৃদ্ধাশ্রমই হয় বৃদ্ধাদের শেষ আশ্রয়স্থল।
সমাজে বাবা-মায়ের অবস্থান স্পষ্ট বুঝতে নচিকেতা চক্রবর্তীর গানের কলিগুলো হৃদয় অকপটে দোলা দিয়ে যায়- ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামিদামি, সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম,
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’
আমাদের সমাজের বহুল আলোচিত ও খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, চাকরিজীবী, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাহিত্যিকসহ সর্বস্তরের অনেকেরই আজ স্থায়ী বাসস্থান বৃদ্ধাশ্রম। নিজের সর্বস্ব উজাড় করে যারা সন্তানদের পেছনে খরচ করতে কার্পণ্য করেননি, সেই পিতা-মাতাই এখন অনাহারি, আশ্রয়হীন, অধিকারহীন ও অমর্যাদিত। আর এরূপ অসহায় মা-বাবার সংখ্যা আমাদের সমাজে মহামারির ন্যায় অধিকতর হচ্ছে। এমনকি বর্তমান সমাজের আধিপতিরা মা-বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা সভ্য হওয়ার বিপরীতে অমানবিক ও উচ্ছৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হচ্ছে। এর পেছনে আধুনিক সভ্যতা সংমিশ্রণ ছাড়াও রয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে বাবা-মায়েরা তাদের পরম স্নেহের সন্তানকে দূর-দূরান্তে শিক্ষা অর্জনের জন্য পাঠান। ফলে দূরত্বই তাদের সম্পর্কের তীব্র বন্ধনকে দুর্বল করে ফেলে। একটা পর্যায়ে গিয়ে সন্তানরা আর তাদের বাবা-মায়ের প্রতি হৃদয় সংযোগ উপলব্ধি করতে পারেন না। এছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো প্রযুক্তি ব্যবহারে আসক্তি। এর ফলে তারা হাজারো ভিড়ের মাঝে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে, তাদের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা কমে যায়, সহনশীলতা লোপ পায়, ধৈর্যের মাত্রা বিলুপ্ত হয়ে যায়, মনোযোগ হ্রাস পায় এবং পারিবারিক সময়ের ঘাটতি দেখা দেয়। যার ফলে তারা সঠিক মর্মের পারিবারিক বন্ধন বুঝতে পারে না। এর ফলে কলহ লেগে থাকে। এক পর্যায়ে তা বিচ্ছিন্নতায় রূপ নেয়। দেশের সর্বত্র স্থানে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে প্রবীণদের প্রতি অমানবিক অত্যাচারের সংবাদ।
২০২৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬০ বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বেড়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩২টির মতো বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে, যেখানে প্রবীণ নারী-পুরুষ বসবাস করেন। 
এভাবেই তারা জীবনের অন্তিম সময় পার করেন অপরিচিতদের ভিড়ে, ছিন্ন হৃদয়ের তৃণে, অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ সময়গুলো পার করেন।
সন্তানদের নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে বাবা-মায়ের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, সম্পর্কে দূরত্বের সৃষ্টি হওয়া, প্রযুক্তির অধিক ব্যবহারের ফলে বিক্ষিপ্ত মন-মানসিকতা এবং পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া প্রবীণদের প্রতি উপেক্ষা ও অবহেলার অন্যতম কারণ। সমাজকে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে, পরিবারের গুরুত্ব বোঝাতে নিউক্লিয়ার পরিবার গঠনের মনস্তত্ত্বতা গুঁড়িয়ে দিতে হবে। বাবা-মায়ের ছায়ায় সব সুখের মূল। পরিবার সুখের হয় বন্ধন গঠনে, ভালোবাসা থাকলে দুঃখ গুছে সবখানে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ

প্যানেল/মো.

×