
আমাদের নবীজী সর্ববিষয়ে আমাদের আদর্শ। তিনি আদর্শ শিশুদের, বৃদ্ধদের, পারিবারিক ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার আদর্শ অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তার যৌবনকাল আমাদের যুব সমাজের জন্য আদর্শ। তিনি যৌবনে কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা প্রদর্শন করেননি। হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই বলতেন, আমি কোনোদিন জাহিলিয়াতের কোনো আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করিনি। অন্ধযুগীয় কোনো পাপ কর্মও করিনি। মাওলানা শাহ আবদুল আযীয (রা.) বলেন, নবীজীর বক্ষ-বিদারণ চারবার ঘটেছে। প্রথমবার শৈশবে, দ্বিতীয়বার যৌবনের প্রাক্কালে। মানুষের স্বাভাবিক যেসব কামনা-বাসনা যৌবনের প্রারম্ভে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, বক্ষ-বিদারণ মারফত সেই কলুষ-স্পৃহা বের করে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল। তাই আঁ-হজরতের যৌবনকালীন প্রতিটি কাজকর্মে ও ব্যবহারে ফুটে উঠেছিল ভদ্রতা, শিষ্টতা, সততা ও ধার্মিকতা। হজরতের বয়স যখন চৌদ্দ অথবা পনরো বছর, ‘হারবে ফুজজার’ নামে একটি যুদ্ধ ভীষণ আকার ধারণ করে। সামান্য একটি স্ত্রী উটের ব্যাপারে বায়ায ইবনে কাইছ উরওয়াকে হত্যা করে। তখন ‘আশহুরে হুরুম’- সম্মাানিত মাস! ‘উক্কায’ বাজারে মেলা বসিয়াছিল। এই সময়ে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও নরহত্যা করা মহা অন্যায় এবং সেই অন্ধযুগেও আরববাসীরা এই মাসের খাতিরে হত্যা-লুণ্ঠন করা ইত্যাদি বন্ধ রাখত। উক্ত হত্যাকাণ্ডটি ভীষণ অন্যায় বিবেচিত হওয়ায় যুদ্ধটিই খ্যাত হয়েছে ‘ফুজজার’ অর্থাৎ মহা অন্যায় কর্ম’ নামে। বনী কাইস ও কেনানার মধ্যে যুদ্ধ। কুরায়শীরা পূর্ব হতে বনী কেনানার সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ ছিল। তাই তারা এই যুদ্ধে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেনি। প্রতিপক্ষও কুরাইশীদিগকে শত্রু ধরে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধাচরণে প্রবৃত্ত হয়। কাজেই আত্মরক্ষার খাতিরে কুরায়শীরা কেনানা’র সাহায্য করতে লাগল। অনেকদিন ধরে যুদ্ধ চলল। দুই চারবার মাত্র আঁ-হজরত (সা.) চাচাগণের সঙ্গে সঙ্গে থেকে তাদের তীর এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, বহুদিন পর দুই দলে সন্ধি হলে বহু ক্ষয়-ক্ষতির পর যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হয়। আরবীয়দের মূর্খতা, বাচালতা, অন্যায়, কুকর্ম, অত্যাচার, হত্যা-লুণ্ঠন, মারামারি, কাটাকারি, আত্মগর্ব, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি দেখে মাহবুবে খোদা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রেমবিগলিত মন প্রায়ই কেঁদে উঠত। কীভাবে এই সব অন্যায় বিদূরিত হবে, কীভাবে জনসমাজ কলুষমুক্ত হবে- এটিই তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন। বিশেষ করে অতি সামান্য ব্যাপারে হারবে ফুজজারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মানুষের প্রাণ নষ্ট হলে, তা দেখে তিনি আরও অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি কৃতসংকল্প হলেন যে, এ সকল অনাচারের মূলোৎপাটন করতে হবে।
কিন্তু অন্যায় ও অধর্মের প্রচণ্ড তুফানের মুখে শুধু মৌখিক উপদেশ যে হাওয়ায় উড়ে যাবে এটা তিনি উপলব্ধি করলেন। তিনি এটি বুঝলেন যে, কথায় না, কাজে এই অন্ধ সমাজকে নতুন আলোর সন্ধান দিতে হবে। বালক মুহাম্মদ (সা.) পূর্ব হতে অত্যাচারিত ও অভাবক্লিষ্ট জনগণের সেবা করে আসছিলেন। অতঃপর তিনি সুপরিকল্পিতভাবে জনসেবায় ব্রতী হলেন। আল্লাহর মেহেরবানীতে আরও কতিপয় ভদ্র সম্ভ্রান্ত যুবক এই সেবাকার্যে তাঁর সহযোগী হন। এমনিভাবে আরবের পাপ পঙ্কিলতার কেন্দ্রে গড়ে উঠে এক শুদ্ধি আন্দোলন। সেবাসংঘের ন্যায় স্থাপিত হলো একটি মিশন। স্থপতি হলেন ভাবী নবী বালক মুহাম্মদ (সা.)।
যুবক মুহাম্মদের সেবক বাহিনী একনিষ্ঠভাবে নিপীড়িত জনের সেবা করে চলল। তাদের নিকট আত্মীয়-আনাত্মীয়ের কোনো পার্থক্য ছিল না আর ছিল না সবল ও দুর্বলের কোনো প্রভেদ, লক্ষ্য ছিল ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জুলুমের বিপক্ষে মজলুমের পক্ষে। অনেকে প্রথম প্রথম বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না যে, কুরাইশীদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে কিংবা কুরাইশীরা কোনো অন্যায় করলে মুহাম্মদ (সা.) তাদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করবেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই কাজে কর্মে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মুহাম্মদ স্বজন-পরজন বুঝে না। যে কোনো দুঃখী, যে কোনো বিপন্ন লোক অনাহারে তার কাছে আশ্রয় ও সাহায্য কামনা করতে পারে।
এ সকল কারণে মক্কার জনসাধারণ হজরতকে ‘আল আমীন’ নামে সম্বোধন করতে থাকে। সম্মুখে এবং অগোচরে সকলেই তখন আল আমীনকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে লাগল। আজ আমাদের যুবসমাজ নেশাগ্রস্ত, কর্মবিমুখ, ধর্মহীন, ভোগবাদী। তাদের সামনে মহানবীর (সা.) জীবনকে উপস্থাপন করা সম্ভব হলে আরব জাহেলিয়াতে যেমন গরিব-দুঃখী মজলুম মানুষগণ যুবক মুহাম্মদ (সা.) ও তার পুণ্যাত্মা বন্ধুদের হাতে নিরাপত্তা পেয়েছিল তেমনি আজও ফিরে আসবে মানুষের মুখে হাসি; সমাজ হবে কর্মময়, সুন্দর, সুশীল। যুবকরা শক্তি, যুবকরা বল। একথা সর্বযুগের সর্বকালের। খারাপ সমাজের যুবকরা যুগে যুগে সমাজকে অন্যায় বিশৃঙ্খলা অশলীলতা নিপীড়ন নানা অপকর্মের দিকে তুফান হয়ে বয়ে গেছে। আবার দেশে দেশে সুসমাজে যুবকরা ছিল সুশাসন, স্বাধীনতা ও বিজয়ের অতন্দ্রপ্রহরী। আমাদের নবীজী জাহেলী সমাজে গড়ে নিতে পেরেছিলেন এক ঝাঁক জিন্দাদীল পরকালীন ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত এবং নবীর সন্তুষ্টি অর্জনে প্রাণোৎসর্গিত যুবসমাজ। যার কারণে তিনি দিগি¦দিক অতিদ্রুত সভ্যতার বিজয় নিশান উড়াতে পেরেছিলেন। কোনো কোনো বিরুদ্ধবাদী শক্তিশালী যুবককে ঘৃণা না করে তিনি তার হেদায়েতের জন্য দোয়া করতেন। যেমন প্রতাপী হজরত উমার (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেননি তখন তিনি তাকে তাঁর পাশে পাওয়ার জন্য খোদার সাহায্য চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আল্লাহুম্মা আইযযিল ইসলামা বি উমরা. আল্লাহ উমরের মাধ্যমে ইসলামের সম্মান বৃদ্ধি কর।’
সত্যি তাই হয়েছিল। উমর হজরতের দোয়ার পর তার কদমে জীবন যৌবন সঁপে দিয়েছিল। উমর হয়েছেন ধন্য। ধন্য হয়েছে ইসলাম। উমর যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সেদিন থেকে নির্ভয়ে মুয়াজ্জিন মিনারে আজান ফুঁকারেছিল। নজরুল তাই বলেছিলেন: আমিরুল মু’মিনীন/ তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি/ জানে না মুয়াজ্জিন...।
আজ আমরা ইসলামের সোনালি যুগের যুব সমাজের সেই সৎ নেতৃত্বের কথা অনুধাবনের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত করতে পারি এ অবক্ষয় সমাজে।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]
প্যানেল/মো.