
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইউএনএফপিএর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গত ৭ জুলাই সকালে রাজধানীর গুলশানে জাতিসংঘ ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘বিশ^ জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউএনএফপিএর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং উক্ত প্রতিবেদন উন্মোচন করে বলেন, ২০২৫ সালে বিশ^ জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮.২ বিলিয়নে। আর বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৭৫.৭ মিলিয়ন, যার অর্ধেক নারী এবং দুই-তৃতীয়াংশ (১১৫ মিলিয়ন) কর্মক্ষম। এটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জনের একটি সুযোগ। এ প্রেক্ষাপটে বাস্তবতাভিত্তিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে কিছু না কিছুর আবর্তে ন্যূনতম দু-একবার সুযোগ আসে। আর সেটাকে কাজে লাগাতে না পারলে সারাটি জীবন কেবল হা-হুতাশ করে চলতে হয়। এই সূত্র ধরে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকটি জাতির জীবদ্দশায় একবারই জনসংখ্যার সোনালি ধাপ (Demgraphic Dividend) সংবলিত সুযোগ আসে, যার সদ্ব্যবহার করতে না পারলে যে লাউ সেই কদুতে অবস্থান করে থাকতে হয়। দুঃখ এবং দুর্দশা আর ছাড়ে না, যা লেগেই থাকে। যেমনটি হয়েছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কতিপয় দেশে। অথচ এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাপান, কোরিয়া ও মালয়েশিয়াসহ কিছু দেশ কত যে উপরে অবস্থান নিয়েছে, তা সবারই কম-বেশি জানা? হয়তো আপনাদের মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, জিনিসটা কি? আসলে এটা আর কিছু নয়, ‘যখন নির্ভরশীল হিসেবে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে কর্মক্ষম জনসংখ্যা সর্বাধিক অবস্থায় অবস্থান নেয়।’
পূর্বাপর গবেষণায় এই মর্মে অবহিত করা হয়েছে যে, এই কিছুকাল আগ থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যার সোনালি ধাপে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছে। এটি বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশীদের জন্য সত্যিই বিরাট একটি সুসংবাদ। কারণ যে কোনো জাতির ভাগ্যাকাশে এই সোনালি সময়কাল নিয়ে রবি একবারই উদিত হয়। তাই এই সময়কাল যথাযথভাবে সদ্ব্যবহার করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এই বিরল সুযোগের যথাযথ বাস্তবায়ন করা না হয়; তাহলে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মতো অবস্থা হবে। সেহেতু সবকিছু বিবেচনায় এনে দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা সহসা গ্রহণ করা আবশ্যক। সাধারণত এ ধাপের পরিধি ৩০ বছর ব্যাপী হতে পারে। অবশ্য অবস্থাভেদে কম-বেশি হতেও পারে। মূলত এক্ষেত্রে জন্মহার কমে এবং যুগপৎ শিশু ও কিশোরের মৃত্যুহার হ্রাস পায়। তাছাড়া বয়স্ক লোকের সংখ্যাও তেমন থাকে না। এ প্রেক্ষাপটে মহিলাসহ পরিবার যখন বুঝতে পারে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতির কারণে সামান্যসংখ্যক শিশু মারা যাবে। তখন তারা কমসংখ্যক সন্তান নেয়া শুরু করে। ফলে শিশু হিসেবে নির্ভরশীলের সংখ্যা কমে আসে। এদিকে জনসংখ্যা হারের পতন এবং আয়ু বৃদ্ধির কারণে প্রকারান্তরে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ সূত্র ধরে নির্ভরশীলতার সংখ্যা হ্রাস পেলে ব্যয় কমে আসে; যা তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে থাকে। এদিকে দুটি প্রজন্মের মধ্যে স্ফীত অংশ আপাতদৃষ্টিতে বোঝা মনে হলেও পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমার নানা রকম প্যারামিটারে সুবাদে এক সময়ে উৎপাদনশীল হিসেবে ম্যানপাওয়ার বহরে যোগ হয়। আশীর্বাদ হিসেবে জনসংখ্যায় এ ধরনের পরিবর্তন সোনালি ধাপের সূচনাপূর্বক আগাতে থাকে। আর এ ধাপ দুটি যেমন- প্রথম ডিভিডেন্ড ও দ্বিতীয় ডিভিডেন্ড। এক্ষেত্রে প্রথম ডিভিন্ডের আওতার মধ্যে লক্ষণীয় যে, এ ধাপে জনসংখ্যা পরিবর্তনের সারথী ধরে জন্মহার হ্রাস পায়। ফলে নির্ভরশীল জনসংখ্যার তুলনায় কর্মী ও দক্ষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই সোনালি পর্বে মাথা পিছু আয় দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে কল্যাণমূলক বিনিয়োগ বাড়ে এবং এরই পথ ধরে উন্নয়ন কার্যক্রমের গতি সঞ্চারিত হয়। এই সময়কাল কয়েক দশক সময় ধরে বিদ্যমান থাকে। এক্ষেত্রে মজার ব্যাপার হলো যে, এ পর্বে জন্মহার হ্রাস পায় বলে কর্মশক্তি বৃদ্ধি ব্যাহত করে। তবে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ার বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যাদের কর্মশক্তি কিছুটা হলেও কাজে লাগে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক সময় নেতিবাচক দিকে মোড় নিলেও টপ কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও সমোপযোগী কার্যক্রম গ্রহণের ঠিক হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় ডিভিডেন্ড এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনসংখ্যা তৈরি হয়, যা বয়স্ক কর্মশক্তির দিকে ধাবিত হয় এবং এই সরণি ধরে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে পরিবার তথা সরকার দ্বারা জনগণের প্রায় চাহিদা মিটানো সম্ভব হয়। তাছাড়া অতিরিক্ত সম্পদের মজুত বাড়ে। আর এ সম্পদ দেশের মধ্যে বা বাইরে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে এবং এরই সুবাদে জাতীয় আয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম সুবর্ণ ধাপে কিছুটা সুযোগের সৃষ্টি হয়। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সম্পদে পরিণত হয় দ্বিতীয় ধাপে। এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন ঘটে। প্রথম ধাপ যখন শেষ হয়। তখন দ্বিতীয় ধাপ এগিয়ে আসে। অনেক সময় দুটি ধাপ একসঙ্গে ঘটে থাকে। উল্লেখ্য, জনসংখ্যার সুবর্ণ ধাপ অর্জনের নিমিত্ত কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। এটা সত্য যে, নানা দেশের জনসংখ্যার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে। মোটামুটি এই পরিবর্তনের ধারা চারটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে থাকে। জনসংখ্যার প্রথম পর্যায়ে উচ্চ জন্মহার ও উচ্চ মৃত্যুহার উভয়ই থাকে। এতে প্রকারান্তরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কম হয়ে থাকে। আফ্রিকার কিছু দেশ এখনো সেই পর্যায়ে রয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে চিকিৎসাবিদ্যা এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে মৃত্যুহার কমতে থাকে। তবে জন্মহার যথারীতি চলতে থাকে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো উন্নয়নশীল দেশসমূহ। অথচ তৃতীয় পর্যায়ে এসে বাবা-মা তথা পরিবার বুঝতে পারে যে, অধিকসংখ্যক সন্তানের ভরণ-পোষণ এবং লেখাপড়ার খরচা বহন করা কষ্টসাধ্য। সেহেতু এক্ষেত্রে কমসংখ্যক ছেলে মেয়ে জন্ম দেয় এবং এই সুবাদে জন্ম হার হ্রাস পায়। এভাবে জন্মহার বেশ কমে যায়, বলতে গেলে জিরো পর্যায়ে চলে আসে। এক্ষেত্রে বিচার বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, বাংলাদেশ তৃতীয় পর্যায়ে সবে প্রবেশ করেছে। এদিকে জনসংখ্যার চতুর্থ পর্যায়ে জন্মহার ও মৃত্যুহার খুবই কমে যায়। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি স্থগিত থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে জনসংখ্যা কমতে থাকে। বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে জার্মানিসহ ইউরোপের কিছু দেশে জনসংখ্যা এ পর্যায়ভুক্ত। উল্লেখ্য, জনসংখ্যা রূপান্তরের আওতায় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলতে গেলে তৃতীয় পর্যায় থেকে শুরু হয়ে থাকে। কারণ এ পর্যায়ে জন্মহার ও মৃত্যুহার উভয়ই তুলনামূলক কম হওয়ায় কর্মক্ষম জনশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। শুধু পুরুষ নয়; এ পর্যায়ে দেশের নারীদের কর্মজগতে আগমন ঘটে। ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদের সৃষ্টি এবং বিনিয়োগে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
এদিকে জনসংখ্যার সুবর্ণ ধাপ এমন একটা অবস্থা যার কৌশলগত (Strategy) কার্যধারায় দেশের অর্থনীতি গড়ে তুলতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত চারটি কৌশলের মাধ্যম সুবিধা দিয়ে থাকে। প্রথম কৌশগত সুবিধা হলো শ্রমশক্তি সরবরাহ। উল্লেখ্য, শিশুরা উচ্চ জন্মহারের প্রাক্কালে জন্মগ্রহণ করলেও পরবর্তীতে তারাই নির্ভরশীলতা অতিক্রম করে প্রশিক্ষিত জনসম্পদে রূপান্তরিত হয়। এতদ্ব্যতীত নারীরা কম সন্তান নেয়ায় হাতে যথেষ্ট সময় পায়। তাই তারা ঘরের বাইরে নানা কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এমন সজাগ হয়ে দাঁড়ায় যে, অনেক সময় বিবাহের পূর্বাহ্নেই তারা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের তৈরি করে, এভাবে তারা উৎপাদনশীল কর্মশক্তিতে পরিণত হয়। দ্বিতীয় কৌশলগত সুবিধার আওতায় তরুণদের তুলনায় অন্য বয়সী জনগণ অধিক সচেতন বিধায় কম অপচয় করে। ফলে আমানতের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। আর আমানত বৃদ্ধি বিনিয়োগের দিকে নিয়ে যায়; যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য। তৃতীয় সুবিধা হলো মানব সম্পদ। এক্ষেত্রে কম সন্তান নেয়ার কারণে মহিলাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও স্বাধীনতা বৃদ্ধি করে। যেহেতু কম সন্তান থাকে সেহেতু ভরণ-পোষণের খরচা কমে যায়। এতে সাশ্রয়কৃত অর্থ দিয়ে উন্নত খাবারসহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য জন্য অধিক ব্যয় করা সম্ভব হয়। আর এভাবে দক্ষ কর্মঠ এবং সম্ভাবনাময় মানব সম্পদ গড়ে উঠতে থাকে। জনসংখ্যার এ অবস্থায় মাথাপিছু আয় এবং জিডিপি বৃদ্ধি পায়। শিশু ও অধিক বয়স্ক লোকদের সংখ্যা কম হওয়ায় নির্ভরশীলতার অনুপাত তুলনামূলকভাবে হ্রাস পায়। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং নির্ভরশীলতার হ্রাসপ্রাপ্ত অনুপাত অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়িয়ে তুলে এবং সূত্র ধরে পুঁজি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাছাড়া জীবনযাত্রার মানও বেড়ে যায়। আশ্চার্য বিষয় হলো যে, ইদানীং বৃদ্ধ মানুষের মধ্যে কাজের প্রতি আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া নতুন নতুন ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ কাজ এত বিভিন্ন ধর্মীর পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যে এখন খেতমুজুর পর্যন্ত তেমন পাওয়া যায় না।
আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। এখন বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের তৃতীয় ধাপে অবস্থান নিয়েছে। আসলে ট্রানজিশনের তৃতীয় ধাপ থেকেই প্রথম ডিভিডেন্ড শুরু হয়। এক্ষেত্রে যতদূর প্রতীয়মান হয়, তাতে দেখা যায় যে বাংলাদেশ কয়েক বছর আগেই আঁটঘাট বেঁধে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ফুল ও ফলের বাগান রচনা করে ফেলেছে। এর সুগন্ধি এখন বইতে শুরু করেছে। পূর্বাপর হিসাব করে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ ২০০ মিলিয়নের ওপরে পৌঁছাবে। আর যুবক বয়স থেকে বৃদ্ধ বয়সের দিকে ধাবমানের কারণে উচ্চ মৃত্যুহার ও উচ্চ জন্মহার হ্রাস পেয়ে নিম্ন মৃত্যুহার এবং নিম্ন জন্মহারে পৌঁছাবে। সঙ্গতকারণেই নিম্ন শিশু জন্মহারের কারণে নির্ভরশীলতা আনুপাতিক হারে কমে আসবে। এ সময় জন্মগ্রহণকারী শিশুরা শিশু থাকবে না। তারা কিছু দিন পর যুবক হয়ে কর্মশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। যতদূর জানা যায়, তাতে বুঝা যায় ১৫ বছরের মধ্যে নির্ভরশীলতার অনুপাত ০.৫৫ থেকে ০.৪৫ তে নেমে আসবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সবচেয়ে কম শিশু এবং বৃদ্ধ নির্ভরশীলতার অনুপাত অতিক্রম করছে। এটি আগামী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আসলে বাংলাদেশে ১৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১১৫ মিলিয়নই যুবক, যা কম কথা নয়? এর ফলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডর আওতায় বিশাল কর্মশক্তির সৃষ্টি হয়েছে, যা দ্রুত কাজে লাগানো আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে এত বড় কর্মশক্তি হলেও এরা তেমন প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ নয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করলেও ইতোপূর্বে সর্বোচ্চ টপ কর্তৃপক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাই কেমন যেন উদাসী ছিলেন। তাঁরা দক্ষ কর্মশক্তি তৈরির জন্য তেমন পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন না বলে অনেক অর্থনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ যে অবস্থায় আছে। তাতে নেতিবাচক অবস্থা কম নয়? আর তা থেকে উত্তরণ হতে না পারলে, এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কোন কাজে আসবে না। বাংলাদেশে অদ্যাবধি উৎপাদনমুখী ও পেশাভিত্তিক খাত তৈরি করতে পারেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ শ্রমশক্তি তৈরি হলেও কর্মে প্রবেশ করতে পারে অর্ধেকেরও কিছুটা বেশি। এতে কোটি কোটি লোক বেকার তো আছেই। তাছাড়া ছদ্মবেশী বেকার তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। উচ্চ শিক্ষিত তথা স্নাতকদের মধ্যেও প্রায় অর্ধেক বেকার, যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এদিকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতি রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে পারেনি। তাছাড়া বাংলাদেশে যে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। মজার ব্যাপার হলো, তাত্ত্বিক বিদ্যা সংবলিত প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ নেই। কেবল বড় বড় ডিগ্রি প্রাপ্ত যুবক বের করছে, যা পেশাগত কাজে অনুপোযোগী। আর এরা প্রকারান্তরে সমাজের দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের কাজ না থাকায় নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, যা সামাজিক বিশেষজ্ঞরা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিচ্ছে। এদিকে শুধু জনশক্তি কোন দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে না। এর জন্য চাই প্রশিক্ষিত জনবল। উল্লেখ্য, দেড় কোটির মতো বাংলাদেশিরা বিদেশে কর্মরত। এদের অধিকাংশই অদক্ষ। যদি সবাই দক্ষ হতো তাহলে রেমিটেন্স ডাবল হতো বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। যাহোক, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে সেখানে এই সুবর্ণ ধাপ কাজে লাগাতে পারেনি বলে আজও নানা রকম জটিলতার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে জনবল নিয়োগের সুযোগ অপ্রতুল। ফলে অধিকাংশ শ্রমশক্তিই কম উৎপাদনশীল অনানুষ্ঠানিক খাতগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তাই এগুলো জিডিপি বৃদ্ধিতে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। বরং তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, কর্মশক্তির ৮০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি আনুষ্ঠানিক ও উৎপাদনশীল কর্মক্ষেত্র তৈরি না করা যায়। তাহলে এরা দায় হয়ে দাঁড়ানোর কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে অদ্যাবধি জনসংখ্যার ব্যাপারে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি। সেহেতু জনসংখ্যা কাম্য মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ না করে এই সোনালি ধাপের সুযোগ নিতে গেলে উল্টো ফল তথা হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের দেশের মতো অনেক দেশেই এমন জনবল নেই। অথচ আমরা হেলায় উপেক্ষা করছি। এখন আর হাতে সময় নেই। শ্রমশক্তি যেন সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত ও কর্মপ্রাপ্ত হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। মুক্তবাজার অর্থনীতি, নমনীয় শ্রমশক্তি এবং আধুনিক প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপর জোর দিতে হবে; নারী শিক্ষার ওপর আরও জোর দিতে হবে; নারীরা যেন লেখাপড়া শেষে নিরাপত্তাসহ ভালো বেতনে চাকরি করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে; ব্যষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে; অর্থনীতিতে যেন উচ্চ মূল্যস্ফীতি না ঘটে, সেদিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি রপ্তানির ওপর জোর দিতে হবে; বহির্বিশ্বের দেশসমূহ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে; দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসূহের সংস্কার সাধন করতে হবে; মানি মার্কেটকে ঢেলে সাজাতে হবে; কালো টাকা যাতে বাইরে না যায়, সে ব্যাপারে পলিসি গ্রহণ করতে হবে। ব্রেন ড্রেন যাতে না হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে আইনগত ও বৈধ সংস্কার নিয়ে আসতে হবে এবং শক্তিশালী ও বিনিয়োগযোগ্য অবকাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে; বিদেশী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যেন বিনিয়োগে আগ্রহী হয় সেজন্য বিনিয়োগ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং সর্বোপরি দেশের চলমান সংস্কৃতিসহ আর্থ-সামাজিক প্যারামিটারগুলো বিবেচনায় এনে ফলপ্রদ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আর এর জন্য আবশ্যক হলো দেশের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক ইতিবাচক পরিবেশ।
এক্ষেত্রে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সূচি (DDI) প্রণয়নপূর্বক কার্যক্রম গ্রহণ করা সমীচীন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে নিজেদের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সবার উপরে। তাই দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানসহ কর্ণধারদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মানপূর্বক সদয় অবহিত করতে চাই যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন আঙ্গিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে সঠিক এবং নির্মল নেতৃত্ব সবচয়ে বেশি অপরিহার্য। কারণ জনসংখ্যার সুর্বণ ধাপ একবারই আসে। আর সেটাকে মাথায় রেখে আমরা প্রায় ১৮ কোটি মানুষ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোর মতো হতে চাই না।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত
প্যানেল/মো.