
সৃষ্টিকর্তার সেরা প্রাণীর শরীরে বয়ে চলা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের নাম হচ্ছে রক্ত, যা একটি প্রাণীর বাহ্যিক কাঠামোর অভ্যন্তরে প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে শারীরকার্য সম্পন্ন করে থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরে থাকাটা যতটা অপরিহার্য ঠিক তেমনি একটি অসুস্থ ব্যক্তির শরীরকে সুস্থ করার অভিপ্রায়ে সুস্থ ব্যক্তির শরীর হতে রক্ত নিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রদান করাও ততখানি-ই অপরিসীম। রক্ত প্রদান করা মানেই হচ্ছে একজন ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। বছরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসের মধ্যে অন্যতম দিবসের নাম হচ্ছে- ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।’ যেদিনটিকে ঘিরে সমগ্র দেশে ঐক্যতার সহিত উৎযাপিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস এবং খুবই গর্বের সাথে সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে সেই অজানা বীরদের যারা এই দিবসটিকে তাঁদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান (রক্ত) দান করার মাধ্যমে অলংকৃত করেছেন।
বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালনের উদ্দেশ্য
বিশ্ব রক্তদাতা দিবস যার ইংরেজি পরিভাষা হলো World Blood Donate Day সংক্ষেপে (WBDD) প্রতি বছর ১৪ জুন পালিত হয়। এই দিবসটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্বের দেশজুড়ে পালন করার সর্বোৎকৃষ্ট উদ্দেশ্য হচ্ছে- দেশের সমগ্র ব্যক্তি এই মহৎ কাজের (রক্তদান) প্রতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত হয় এবং তাঁদের সহযোগিতায় যেনো ফিরে পায় একটি তাজা প্রাণ। কেননা সুস্থতা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নিয়ামত। এই নিয়ামতের কদর অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত অনুধাবন করা যায় না। সহজ পরিভাষায় বলতে গেলে, যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে (অজানা বীর) লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য। আর সে জন্যই বলা হয়- তবে চলুন জেনে যাক- রক্ত কী, রক্তের গঠন ও রক্তদান করার ফলে রক্তদাতার উপকারিতা সম্পর্কে।
রক্ত কী ও এর গঠন
রক্ত হলো এমন এক ধরনের তরল যোজক কলা যা মানুষ ও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর সংবহন তন্ত্রের একটি দৈহিক তরল যা কোষে প্রয়োজনীয় পদার্থসমূহ যেমন: পুষ্টিদায়ক পদার্থ ও অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং কোষ থেকে বিপাকীয় রেচন পদার্থ কোষসমূহ থেকে দূরে বহন করে নিয়ে যায়। প্রযুক্তিগতভাবে বিশ্লেষণ করলে এরূপ দাঁড়ায়- রক্ত হলো এমন একটি পরিবহন তরল যা হৃৎপিণ্ড দ্বারা শরীরের সমস্ত অংশে পাম্প করা হয়, তারপর প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করার জন্য এটি হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। রক্ত মূলত রক্তরসে ঝুলন্ত রক্তকণিকা দিয়ে গঠিত।
রক্তদান করার ফলে রক্তদাতার উপকারিতা
১। রক্তদানের প্রথম এবং প্রধান কারণ: একজনের দানকৃত রক্ত আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচাবে।
২। রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং রক্তদানের ২ সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বছরে ৩ বার রক্তদান আপনার শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলার সাথে সাথে নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য, রক্তদান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
৩। নিয়মিত রক্তদান করলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
৪। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, যারা বছরে দুই বার রক্ত দেয়, অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিলক্ষিত হয়েছে। চার বছর ধরে ১২০০ লোকের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়েছিল।
৫। নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীরে বড় কোনো রোগ আছে কিনা তা বিনা খরচে জানা যায়। যেমন: হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) ইত্যাদি।
৬। প্রতি পাইন্ট (এক গ্যালনের আট ভাগের এক ভাগ) রক্ত দিলে ৬৫০ ক্যালরি করে শক্তি খরচ হয়। অর্থাৎ ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৭। রক্তদান উচ্চরক্তচাপ কমায়।
৮। মানুষ এবং সমাজের উপকারের স্বার্থে রক্তদান অন্যতম কর্তব্য। রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীর ঠিক থাকে এবং অন্যের জীবন বাঁচে।
কবে থেকে রক্তদান দিবস পালিত হয়
১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল ‘বিশ্ব রক্তদান দিবস।’ ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক চিহ্নিত ১১টি সরকারি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য প্রচারণার মধ্যে একটি যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে জনসচেতনতার এক মহান উদ্যোগ।
স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষ কতটা আগ্রহী
পরিসংখ্যানে প্রতি বছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়। অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের যা মোটেও কাম্য নয়। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি (HIV) ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম থাকে। রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে সঠিকভাবে রক্তদাতা নির্বাচিত না করে রক্ত নিলে জীবন বিপন্নও হতে পারে। নিরাপদ রক্তের প্রাপ্যতা নির্ভর করে সঠিক রক্তদাতা নির্বাচন, নির্ভরযোগ্য স্ক্রিনিং ও রক্তের উপাদানের সঠিক ব্যবহারের ওপর।
আদর্শ রক্তদাতার বৈশিষ্ট্য হওয়া চাই এরূপ
১। রক্তদাতার বয়স ১৮-৬০ বছরের মধ্যে হতে হবে।
২। দৈহিক ও মানসিকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আগ্রহী হতে হবে।
৩। ওজন ন্যূনতম ৪৫ কেজি বা ১০০ পাউন্ড।
৪। নাড়ির গতি প্রতি মিনিটে ৬০-১০০-এর মধ্যে থাকে প্রভৃতি।
রক্তদান কেন করা হয় এবং এর তাৎপর্য
রক্ত এবং রক্তজাত দ্রব্যের সঞ্চালন প্রতি বছর লাখ লাখ জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে থাকে। কোনো ব্যক্তি রক্তের অভাবে হুমকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভুগছেন এমন রোগীদের দীর্ঘজীবী হতে এবং উন্নত মানের জীবনযাপন করতে রক্তদান সাহায্য করতে পারে। জটিল চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে রক্তদান জরুরি। মাতৃত্বকালীন এবং প্রসবকালীন যত্নে এই কাজের অপরিহার্য ও জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা রয়েছে। নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত রক্ত এবং রক্তজাত দ্রব্যের অ্যাক্সেস প্রসবের সময় এবং প্রসবের পরে তীব্র রক্তপাতের কারণে মৃত্যু এবং অক্ষমতার হার কমাতে সাহায্য করতে পারে রক্তদান কর্মসূচী।
সুতরাং নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচবোধে আমরা প্রত্যেকে এই প্রত্যয়ে বলিষ্ঠ থাকবো যে- ‘তুচ্ছ নয় রক্ত দান, বাঁচতে পারে একটি প্রাণ’। কেননা, ‘রক্ত দান করার মাধ্যমে অর্থের খরচ হয় না। বরং খরচ হয় শুধু ভালোবাসা।’ আর এই সামান্য লাল ভালোবাসার (Red Love or Life) মাধ্যমে ফিরে পাবে মুমূর্ষু ব্যক্তি তার তাঁজা প্রাণ।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
প্যানেল