
বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্রিল্যান্সিং একটি জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় ও লোভনীয় শব্দ। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গÐি না পেরুতেই ঘরে বসে হাজার হাজার ডলারের স্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে। ইউটিউবে শত শত ভিডিওতে দেখা মেলে লাখ লাখ টাকা আয়ের গোপন পদ্ধতি। এছাড়া নামে বেনামে বহু ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞাপন সারাক্ষণ চোখের সামনে ভাসতে থাকে। মাসে কে কত বেশি টাকা আয় করেছে এবং কত সহজে ও কম বয়সে করেছেÑ সেসব দেখে যুবকরা দিন দিন আরও বেশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। বড় স্বপ্ন দেখা অবশ্যই ভালো। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবতা বিবর্জিত হলে সমস্যা। বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে স্রেফ ব্যাবসার উদ্দেশ্যে। তাদের কাজই হলো তরুণদের আকাশ পরিমাণ আশা জাগিয়ে নিজেদের ব্যবসা সফল করা। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কোর্স বিক্রি করাই তাদের আসল লক্ষ্য।
তরুণরাও পরিবারকে চাপ দিয়ে কোর্সের টাকা জোগাড় করে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে লাখ টাকা খরচ করে তাদের ফাঁদে পা দেয়। কোর্স শুরু করে কোনো একটা কাজে সামান্য দক্ষতা অর্জন করতে না করতেই ডলারের আশায় অনলাইন মার্কেটপ্লেস upwork, fiverr ইত্যাদিতে একান্ট খুলে কাজ খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে যায় এবং মটিভেশন হারিয়ে ফেলে। এখানে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, অনেকে মনে করে অনলাইনে কাজ পাওয়া অনেক সহজ। তাই পড়ালেখা ছেড়ে পর্যন্ত এদিকে ঝুঁকে যাওয়ার প্রবনতা দিনকে দিন বাড়ছে। অথচ অনলাইন মার্কেট প্লেসে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। দেশে চাকরির জন্য শুধু দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। কিন্তু অনলাইন গেøাবাল মার্কেট প্লেস সেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষরাও কাজের জন্য প্রতিযোগিতা করে। সুতরাং অনলাইনে কাজ পাওয়া তুলনামূলক কঠিন।
১৬ বছর একাডেমিক পড়ালেখা করেই যেমন চাকরি পাওয়া যায় না বরং চাকরির জন্য আরো অনেক পড়ালেখা করতে হয় তেমনি কয়েক মাসের কোর্স করেই কেউ ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হয়ে যায় না। এর পেছনে অনেক সময়, শ্রম ও ধৈর্য ব্যয় করতে হয়। একজন সফল ফ্রিল্যান্সারের সফলতার পেছনের সংগ্রামী গল্প আমরা জানতে পারি না। কত রাত দিন একাকার করে পরিশ্রমের পর দক্ষতা অর্জন করেছে। শতবার ব্যর্থ হয়েও ধৈর্যের সাথে লেগে থেকেছে, ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে অবশেষে সফল হয়েছে। আমরা তার এসব পরিশ্রম বা কষ্টের ঘটনাগুলো না জেনেই মনে করে বসি সে যেহেতু লাখ টাকা আয় করছে আমিও একটা কোর্স করলে আয় করতে পারবো। অথচ একটা প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন কোর্স করলে হয়তো দু-একজন সফল হয়। এখন প্রতিষ্ঠানটি সফল হওয়া সেই দুজনের গল্পই সবার মাঝে বিজ্ঞাপন দিয়ে পৌঁছাবে। এগুলো দেখে তরুণরা মনে করে কোর্স করলে মনে হয় আমিও সফল হয়ে যাব। ডলার আয় করতে পারব। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান বাকি ৯৮ জনের গল্প বা বাস্তবতা কখনোই সামনে আনে না। হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সারের ব্যর্থতার গল্পও কেউ সহজে বলে না।
তাই বিজ্ঞাপনে দেখানো এক দুজনের সফলতা দিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করলে মারাত্মক ভুল হবে। কারণ দেশে লক্ষ লক্ষ ফ্রিল্যান্সার আছে। সবাই কি সফলতা পাচ্ছে? অনেকে বহু বছর চেষ্টা করেও কাক্সিক্ষত সফলতা পায় না। কারণ এখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। তাই সামান্য যোগ্যতা দিয়ে বা একটা কোর্স করেই কাজ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। আজকাল তো কাজ না পেয়ে বহু তরুণ-তরুণী টাকার নেশায় অবৈধ অনলাইন বেটিং সাইট বা জুয়ায় পর্যন্ত জড়িয়ে যায়। এখানেও কাজ করে চটকদার বিজ্ঞাপন, ‘যোগ্যতা ছাড়া শুধু অ্যাড দেখে লাখ টাকা আয় করুন, কপি পেস্ট করে শত ডলার আয় করার সহজ উপায়, ১০০ টাকা দিয়ে ১ হাজার টাকা আয় করার পদ্ধতি’ ইত্যাদির ফাঁদে পরেও তরুণরা নিঃস্ব হচ্ছেন। যেটা তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এসব কঠিন বাস্তবতা শুনে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ফ্রিলেন্সিং করে কি তাহলে আয় করা যায় না? অবশ্যই যায়, তবে বাস্তবিক দিক দিয়ে সবকিছু বিচার বিবেচনা করতে হবে। যারা ফ্রিলেন্সিং শুরু করতে চান তাদের খুব ভালোভাবে সব কিছু জেনে বুঝে শুরু করা উচিত। দ্রæত টাকা আয়ের চিন্তা না করে বা চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে না পরে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। পর্যাপ্ত যোগ্যতা ছাড়া কখনোই ঘরে বসে ডলার আয় করা সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার সঠিক দক্ষতা, নিয়মিত চর্চা, নেটওয়ার্কিং বাড়ানো এবং ধৈর্য ধরে লেগে থাকা। পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার মতো বোকামি না করে বরং লেখাপড়ার পাশাপাশি দক্ষতা বাড়িয়ে আয় করার চেষ্টা করা। কারণ ছাত্র জীবনে পড়া লেখাই মূখ্য বিষয়, ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্যও পড়ালেখা গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটা বিষয় সব সময় মাথায় রাখতে হবে ফ্রিল্যান্সিং কোন স্থায়ী পেশা নয়। আজকে ভালো আয় আছে আগামীকাল থেকে সেটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই প্রথমেই সব ছেড়ে একটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানে কাজ হতে পারে না। তরুণ সমাজকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে সফল ফ্রিল্যান্সারদের উচিত প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করা। সরকারের দায়িত্ব বিশাল সম্ভাবনার এ খাতকে সঠিকভাবে তরুণ-যুবকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। প্রতিষ্ঠিত ও সফল ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে কোলাবোরেশন করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং তরুণদের আগ্রহ কাজে লাগিয়ে সঠিক নিয়মে দক্ষতা অর্জনে সহযোগিতার মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া। চটকদার বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও অনলাইন বেটিং বা জুয়ার সাইট বন্ধে প্রয়োজনীয় সরকারি হস্তক্ষেপও অত্যন্ত জরুরি।
সর্বোপরি, কারো সফলতার গল্প শুনে, চটকদার বিজ্ঞাপন বা লোভনীয় ইউটিউব ভিডিও দেখে ফ্রিল্যান্সার হওয়ার স্বপ্ন দেখলে ভুল হয়ে যেতে পারে। সত্যিই সফল ফ্রিল্যান্সার হতে চাইলে আগে ভালো করে জানতে হবে, সচেতন হতে হবে, ধৈর্য ধরে শিখতে হবে, বাস্তবতা বুঝে এবং পর্যাপ্ত সময় দিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজ করার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ
প্যানেল